রামপুরে লিটনের বিশাল কর্মীবাহিনী, নীরব ভোটে বিপ্লবের প্রতীক্ষায় এরশাদ

দলের বড় নেতারা আড়ালে সমর্থন দিচ্ছেন এরশাদকে

চট্টগ্রাম নগরীর ২৫ নম্বর রামপুর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে দলীয় প্রার্থী হিসেবে সাবেক কাউন্সিলর এসএম এরশাদ উল্লাহকে বাদ দিয়ে তার আগের দফায় কাউন্সিলরের দায়িত্ব পালন করা আব্দুস সবুর লিটনকে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। দুজনই ওই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক। মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন এরশাদ উল্লাহ।

এর মধ্যে আব্দুস সবুর লিটন মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী এবং এরশাদ উল্লাহ স্থানীয় সাংসদ আফসারুল আমিন ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। আগের দুই নির্বাচনেও এই দুই প্রার্থীর মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। যেখানে ২০১০ সালে বিজয়ী হন আব্দুস সবুর লিটন এবং পরের বার ২০১৫ সালে বিজয়ী হন এরশাদ উল্লাহ। দুই নির্বাচনেই জয়-পরাজয়ের মধ্যে তাদের ভোটের ব্যবধান ছিল ২০০ থেকে ৩০০ এর মধ্যে।

গত নির্বাচনে পরাজয়ের পর থেকে আব্দুস সবুর লিটন অভিযোগ করে আসছিলেন ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করে তাকে পরাজিত করা হয়েছে। তবে এতদিন পরে এসে এই বিষয়ে কথা বলা অর্থহীন— এমন মন্তব্য করে এরশাদ বলেন, ‘এই অভিযোগ আমিও ২০১০ সালে করতে পারতাম। অভিযোগ যে কেউ করতে পারে। তবে উনার এই দাবি ঠিক নয়।’

এই দুই প্রার্থীর বাইরে রামপুরের ভোটের রাজনীতিতে আরও একজন ব্যক্তি প্রভাব রাখেন। তিনি হলেন হালিশহর থানা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ফয়েজ আহমদ। পর পর দুই বার এই ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়া এই নেতা গত দুই দফা নির্বাচনে লিটন ও এরশাদের দ্বৈরথে খুব একটা সুবিধা করতে না পারলেও বেশ বড় একটা ভোট দুইবারই তুলে নিতে পেরেছিলেন নিজের বাক্সে। এবারের নির্বাচনে প্রার্থী হননি তিনি। এবারের নির্বাচনে তাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে তার অবস্থানও।

দৃশ্যত দলীয় প্রার্থী আব্দুস সবুর লিটনের পক্ষে থাকলেও অতীতের বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ ও গ্রুপ রাজনীতিতে হঠাৎ পিছিয়ে পড়ার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে গোপনে এরশাদ উল্লাহকে সমর্থন দেয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন এখানকার ভোটাররা। এছাড়া এই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক আবুল কাশেম ও অপর যুগ্ম আহ্বায়ক দিলদার খান দিলু সক্রিয়ভাবে সমর্থন দিচ্ছেন আব্দুস সবুর লিটনকে।

স্থানীয় রাজনীতিতে এই দুজনের প্রভাব প্রায় সমানে সমান। তবে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ায় এবং উদারভাবে কর্মীদের সাথে মেলামেশার জন্য কর্মী সমর্থক খানিকটা বেশি লিটনের। অন্যদিকে দলীয় মনোনয়নকে অজুহাত দেখিয়ে বিভিন্নভাবে হুমকিধমকি দিয়ে এরশাদের কর্মীদের দলে ভেড়াচ্ছেন লিটন— এমন কথাও শোনা যাচ্ছে এলাকায়। ফলে খানিকটা কৌশলী হয়ে রয়েসয়ে এগোচ্ছেন এরশাদ। এর সুফলও মিলেছে এর মধ্যে।

কয়েকদিন আগে এই ওয়ার্ডের মধ্য রামপুর পূর্ব সমাজের সর্দার নির্বাচন নিয়ে মুখোমুখি হন এই দুই প্রার্থীর অনুসারীরা। ওই নির্বাচনে সভাপতিসহ সাতটি পদের ছয় পদেই নির্বাচিত হন এরশাদ সমর্থকরা।

সবমিলিয়ে এই ওয়ার্ডে আব্দুস সবুর লিটনের কর্মী সমর্থক বেশি হলেও নীরব ভোট রয়েছে এরশাদের। পাশাপাশি একসময় উদার ও কর্মীবান্ধব নেতা হিসেবে পরিচিত হওয়া আব্দুস সবুর লিটন হঠাৎ করেই অনেক ক্ষমতাবান হয়ে নেতাকর্মীদের এড়িয়ে চলছেন বলে চাপা অভিমানও রয়েছে স্থানীয় অনেকের মধ্যে।

নির্বাচনের সাম্প্রতিক হালচাল নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে হালিশহর থানা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ফয়েজ আহমদ বলেন, ‘আমি তো যেখানে যেখানে বলা দরকার সবখানেই বলেছি একক প্রার্থী নিশ্চিত করতে। যেহেতু দল লিটনকে মনোনয়ন দিয়েছে এবং আমি থানা আওয়ামী লীগের দায়িত্বে আছি সেহেতু তার পক্ষেই আছি আমি। নৌকাকে বিজয়ী করতে যা যা করা দরকার সবই করছি আমি। ফাঁকে ফাঁকে লিটনের কথাও বলছি ভোটারদের। এরশাদকে বলেছি বসে যেতে।’

নির্বাচনের বিষয়ে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আব্দুস সবুর লিটন বলেন, ‘এখানে থানা ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের সবাই একাট্টা দলীয় প্রার্থীকে জেতাতে। বিদ্রোহী পদে যিনি নির্বাচন করছেন তিনিও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক। তিনিই শুধু বাইরে।’

বিদ্রোহী প্রার্থীর ব্যাপারে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কঠোর অবস্থানের কথা তুলে ধরে লিটন বলেন, ‘জানুয়ারির ৩ তারিখ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের বৈঠক আছে। সেখানে বিদ্রোহী প্রার্থীকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য বলা হবে। যদি তিনি তা না করেন তাহলে তাকে বহিষ্কারের জন্য কেন্দ্রীয় কমিটি ও মহানগর কমিটির কাছে লিখিত সুপারিশ করা হবে। এটা আমার না, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত। কারণ নেত্রীর প্রার্থীর বাইরে বিদ্রোহী বলতে কোনো কিছু থাকতে পারবে না রামপুর ওয়ার্ডে।’

দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে দূরত্ব বাড়ছে কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে লিটন বলেন, ‘নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা যেদিন শুরু হবে সেদিন থেকে বলা যাবে এটা। আমি তো শুধু ইলেকশনের রাজনীতি করি না। আমার নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। আমি উনার স্টাইলে রাজনীতি করি।’

তবে নিজেকে আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী দাবি করে এরশাদ উল্লাহ বলেন, ‘১৯৯০ সাল থেকে জীবনবাজি রেখে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি। এখন যেটাকে দলীয় মনোনয়ন বলা হচ্ছে সেটা কি আসলেই দলের ওয়ার্ড বা মহানগর কমিটির সাথে আলাপ করে করা হয়েছে? কিংবা স্থানীয় সাংসদদের মতামত নেওয়া হয়েছে? অনেকে অনেক কথা বলছে। মানুষ কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিলেই বোঝা যাবে কার অবস্থান আসলে কী।’

তিনি বলেন, ‘রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে— আমি সেটা বিশ্বাস করি। লিটনও দলের কর্মী, আমিও। দুজনই নৌকার জন্য কাজ করি। এক সাথে করি। এক টেবিলে বসে সে নৌকা ও কাউন্সিলরে নিজের জন্য ভোট করুক। আমিও নৌকা ও নিজের জন্য করি। ফলাফল যাই হবে আমি মেনে নেবো। আমি তো এরকম মানসিকতাই রাখি।’

মানুষ কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারবে কিনা বা এই ক্ষেত্রে তিনি ভূমিকা রাখতে পারবেন কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে ২০০৫ সালের চসিক নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী মহিউদ্দিন চৌধুরীর নির্বাচন করতে গিয়ে দুই ভাইসহ ছুরিকাহত হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে এরশাদ বলেন, ‘বিএনপির আমলে মহিউদ্দিন ভাইয়ের নির্বাচন করার সময় মানুষের ভোটাধিকার রক্ষা করতে গিয়ে নয়াবাজার কেন্দ্রে আমিসহ আমার দুই ভাইকে ছুরি মেরে রক্তাক্ত করা হয়েছিল। সেদিন হাল ছাড়িনি, আর এখন তো আমার দল ক্ষমতায়। কেন পারবো না? এখানে ভোটের নীরব বিপ্লব হবে।’

এআরটি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!