এস আলমের সুগন্ধার বাড়ি হঠাৎই স্তব্ধ, সুনসান নীরবতা

পরিবার চলে গেল গুলশান-বনানীতে

চট্টগ্রাম নগরীর সুগন্ধা আবাসিক এলাকার ১ নম্বর সড়কে মোহনীয় স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত দালানটি নজর কাড়ে দূর থেকে। আশেপাশের মানুষের অতি চেনা বাড়িটি হঠাৎ করেই এখন আরও বেশি পরিচিত। চলতি পথে পথচারীরাও এই বাড়ির সীমানায় কৌতূহলী চোখ রেখে যায় একপলক। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ এস আলম পরিবারের নিজস্ব এই বাসভবন এমনিতে দিনরাত থাকে কলরবে মুখর। যেন চিরসুখী এক পরিবারের আবাস। অথচ মাঝখানে শুধু বিষাদময় একটি সপ্তাহ, এই এক সপ্তাহেই টানা কিছু দুঃসংবাদ পুরো বদলে দিয়েছে বাড়িটিকে। ১৭ মের এক সন্ধ্যাতেই বাড়িটির ওপর ভর করে কালো মেঘের ছায়া। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতি এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের পরিবারের মোট আটজন সদস্য একে একে সুগন্ধার এই বাসায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে মারা যান তার বড় ভাই মোরশেদুল আলম।

আর গত রোববারের পর সেই বাড়িটি এখন খা খা করছে। পুরো বাড়িই যেন স্তব্ধ। সুনসান নীরবতা। সেই বাড়িতে এখন নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত কিছু আনসার সদস্য এবং জনাকয়েক গৃহকর্মী ছাড়া এস আলম পরিবারের কেউ আর নেই। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুতে ১৮ মার্চ সিঙ্গাপুরে যান ওই বাড়ির প্রধান প্রাণপুরুষ সাইফুল আলম মাসুদ। সিঙ্গাপুর যাত্রাকালে তার সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী ফারজানা পারভীন পপি, মেজ ছেলে আশরাফুল আলম ও ছোট ছেলে মাহির আলম। এখনও তারা সেখানেই আছেন।

শনিবার (২৩ মে) দুপুরে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মা ও বড় ছেলেকে সুগন্ধার এই বাসা থেকে সরিয়ে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় তাদের সঙ্গে আরও ছিলেন ছেলে আহসানুল আলম মারুফের স্ত্রী ও চার মাস বয়সী সন্তান।

এরপর রোববার (২৪ মে) সকাল আটটায় করোনায় শয্যাশায়ী অপর চার ভাই ও এক ভাইয়ের স্ত্রীকে আইসিইউযুক্ত অ্যাম্বুলেন্সযোগে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়।

রোববার সকালে একদিকে আইসিইউযুক্ত অ্যাম্বুলেন্সে এস আলম পরিবারের করোনায় আক্রান্ত চার ভাই ও এক ভাইয়ের স্ত্রী। অন্যদিকে ব্যক্তিগত গাড়ির বহর নিয়ে তাদের সঙ্গে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন সাইফুল আলম মাসুদের পাঁচ ভাইয়ের পুরো পরিবার। সঙ্গে ছিলেন বেশ কয়েকজন গৃহকর্মীও। সব গাড়িই আটটায় রওনা দিয়ে বেলা ১১টার দিকে ঢাকায় পৌঁছে যায়। সেখান থেকে আইসিইউযুক্ত অ্যাম্বুলেন্সগুলো সরাসরি চলে যায় ঢাকার ধানমণ্ডিতে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এর মধ্যে তাদের তিনজনকে ভর্তি করা হয় ওই হাসপাতালের আইসিইউ ওয়ার্ডে। তারও আগে শনিবার থেকে সেখানকার আইসিইউ ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন শিল্পপতি মাসুদের মা ও ছেলে। আইসিইউ সিটের সংকটের কারণে অপর একজন আবদুস সামাদ লাবুকে ভর্তি করা হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে।

অন্যদিকে ব্যক্তিগত গাড়ির বহরটি ঢাকার দুটি পূর্বনির্ধারিত গন্তব্যের দিকে রওনা দেয়। এর মধ্যে গুলশানে এস আলম পরিবারের মালিকানাধীন ভিন্ন ভিন্ন ফ্ল্যাটে উঠেছেন প্রয়াত মোরশেদুল আলম, মোহাম্মদ শহীদুল আলম এবং আবদুস সামাদ লাবুর পরিবারের সদস্যরা। অন্যদিকে বনানীর আলাদা আলাদা বাসায় উঠেছেন রাশেদুল আলম, আবদুল্লাহ হাসান এবং চার মাস বয়সী সন্তানসহ শিল্পপতি মাসুদের বড় ছেলের স্ত্রী।

১৭ মে সাইফুল আলম মাসুদের পরিবারের ৬ সদস্য করোনা পজিটিভ রোগী হিসেবে শনাক্ত হন। এর মধ্যে শুক্রবার (২২ মে) রাত ১০টা ৫০ মিনিটে এস আলম পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্য এবং শিল্পপতি সাইফুল আলম মাসুদের বড় ভাই মোরশেদুল আলম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ ওয়ার্ডে মারা গেছেন। সাইফুল আলম মাসুদের অন্য যে চার ভাই করোনা পজিটিভ শনাক্ত হন তারা হলেন এস আলম গ্রুপের পরিচালক ৬০ বছর বয়সী রাশেদুল আলম, এস আলম গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ৫৩ বছর বয়সী আবদুস সামাদ লাবু, ইউনিয়ন ব্যাংক ও এস আলম গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মদ শহীদুল আলম এবং এস আলম গ্রুপের পরিচালক ৪৫ বছর বয়সী ওসমান গণি। এছাড়া করোনায় আক্রান্ত হন ওই পরিবারের ৩৬ বছর বয়সী এক নারীও— তিনি ওসমান গণির স্ত্রী ফারজানা বেগম।

এরপর ২৩ মে পাঁচ ভাইয়ের পর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেন সাইফুল আলম মাসুদের মা ৮৫ বছর বয়সী চেমন আরা বেগম এবং ২৬ বছর বয়সী ছেলে আহসানুল আলম মারুফও।

এস আলম পরিবারের ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, সোমবার (২৫ মে) সকালেই চিকিৎসাধীন সবারই অক্সিজেন সাপোর্ট সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। করোনায় আক্রান্ত প্রতিটি সদস্য খাবারদাবারও করছেন স্বাভাবিকভাবেই। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের কোনো বিধিনিষেধ নেই জানিয়ে পারিবারিক ওই সূত্র জানিয়েছেন, নিয়মিত ওষুধের পাশাপাশি তারা শুধু গরম পানি খাচ্ছেন ও তার ভাপ নিচ্ছেন। এছাড়া চিকিৎসকরা প্রত্যেককেই টেনশনমুক্ত বিশ্রামের পরামর্শ দিয়েছেন।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!