চট্টগ্রামের এক ভূমি অফিসে অবৈধ নামজারির রমরমা, ঘুষ জমা হয় মুরাদপুরের ব্যাংকে

হামিদুর রহমান। চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলা ভূমি অফিসের নাজির হিসেবে কর্মরত আছেন তিনি। আর সেই পদের ক্ষমতায় ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাদের আইডি ও পাসওয়ার্ড নিয়ে করেন দুর্নীতি। অবৈধ নামজারি, সরকারি বরাদ্দের টাকা নয়ছয়সহ প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের দুস্থদের ঘর দিতেও পকেট ভারী করেছিলেন তিনি। এত কিছুর পরও বহাল তবিয়তে আছেন তিনি। তার বড় ভাই আছেন একটি মন্ত্রণালয়ে উপ সচিব পদমর্যাদায়। তার আরেক ভাই ও বোনও চট্টগ্রামের দুই উপজেলা ভূমি অফিসে অফিস সহায়ক হিসেবে কর্মরত আছেন।

এসব কাজে হামিদুর একা নন, একই অফিসের সার্টিফিকেট পেশকার সুদীপ্ত দাশসহ আরও কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন সঙ্গী হিসেবে।

তবে হামিদুরদের এসব অনৈতিক কাজে নিরব সমর্থন দিয়ে গেছেন সদ্য বদলি হওয়া পটিয়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি) বা এসিল্যান্ড ফাহমিদা আফরোজ। মূলত এসব অনিয়মের কারণেই তাকে বদলি হতে হয়েছে বলে গুঞ্জন উঠেছে।

জানা গেছে, এসিল্যান্ড ফাহমিদার সঙ্গে বেশ নিবিড় সম্পর্ক ছিলো হামিদুরের। সে সুবাদে এসিল্যান্ডের সরকারি গাড়িও ব্যবহার করতেন তিনি।

আর সুদীপ্ত অবৈধভাবে ব্রিটিশ আমলের খতিয়ানের নামজারি করিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগেউঠেছে।

যদিও নিজেদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো অস্বীকার করেছেন হামিদুর ও সুদীপ্ত। তাদের দাবি, এগুলো ষড়যন্ত্র। তবে তারা স্বীকার না করলেও তাদের অপকর্মের একাধিক প্রমাণ চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে এসেছে।

আদালতকে ‘বুড়ো আঙুল’
কিছু কিছু দলিলের নামজারি খতিয়ানের এখতিয়ার রয়েছে শুধুমাত্র আদালতের। বিশেষ করে বিট্রিশ আমলের দলিলের ক্ষেত্রে এই বিধি-নিষেধ বেশি। কিন্তু আদালতের সেই নিষেধাজ্ঞা না মেনে হামিদুর-সুদীপ্তের চক্র নামজারি করে। ইউনিয়ন ভূমি অফিসের আইডি-পাসওয়ার্ড নিজেদের কব্জায় নিয়ে এসব দুর্নীতি করেন তারা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৩৮, ১৯৫৭ ও ১৯৬৯ সালের তিনটি দলিলের নামজারির ক্ষেত্রে এই চক্র হাতিয়ে নেন অন্তত ১০ লাখ টাকা।

পটিয়ার টাকা আসে মুরাদপুরের ব্যাংকে
পটিয়া ভূমি অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, পটিয়া ভূমি অফিসের এসব টাকা ভাগ হয় কয়েক দফায়। যার বেশিরভাগ অংশ যায় অফিসপ্রধানের কাছে। আর পটিয়ার সেই টাকাগুলো চলে আসে মুরাদপুরে। হামিদুর রহমান নিজে ব্যাগভর্তি টাকা মুরাদপুর শাখার একটি বেসরকারি ব্যাংকের একাধিক অ্যাকাউন্টে জমা দেন।

টাকা দিলেই নথি ‘হোম ডেলিভারি’
বছরের পর বছর পটিয়ার ভূমি অফিসে ঘুরে যে কাজ করা যায় না, সেসব কাজ টাকার বিনিময়ে হয়ে যায় অল্প সময়েই। এমনকি টাকা দিলে ডকুমেন্টস (নথি) করা হয় হোম ডেলিভারিও। ঘুষের টাকা বনিবনার পর কাজ হয়ে গেলে অফিসের নিম্নশ্রেণির কর্মচারী অথবা দালালদের দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় গ্রাহকের বাড়িতে।

টাকা ছাড়া কলম চলে না সুদীপ্তের
পটিয়ার করল মৌজার সৃজিত ১৪৭৬ নম্বর খতিয়ান, যেটির মূল বিএস নম্বর ২২৯। ১৯৩৮ সালে আলী আহমদের কাছ থেকে খতিয়ানভুক্ত জায়গাটি কিনেন মমতাজ বেগম। এরপর ১৯৬৯ সালে এসে মমতাজ বেগমের ছেলে সাজ্জাদ হোসেন এই জায়গাটি বিক্রি করেন শাহজাহান বেগম নামের আরেক মহিলার কাছে। এই জায়গা দু’বার কেনাবেচা হলেও বিএস করানো হয়নি।

এরপর শাহজাহান বেগমের ছেলেমেয়েরা এই জায়গা বিএস করিয়ে নেন নিজেদের নামে। এক্ষেত্রে আদালতের মাধ্যমে এসব কাজ আইনি প্রক্রিয়ায় করানোর কথা থাকলেও তা করা হয়নি।

অভিযোগ রয়েছে, সুদীপ্ত দাশ পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ খেয়ে নামজারির এই কাজ করেন দেন। এই টাকার ভাগ যায় ওপরের কর্তাদের কাছেও। শুধু খতিয়ান তৈরিই নয়, টাকার বিনিময়ে মিস মামলার নথি নিষ্পত্তির কন্ট্রাক্ট নেন তিনি।

অথচ নিয়ম অনুসারে এই খতিয়ান সৃজনের একমাত্র এখতিয়ার আদালতের।

এদিকে সুদীপ্তের একাধিক সহকর্মীর দাবি, পটিয়া ভূমি অফিসের দালালদের একটি বড় চক্র নিয়মিত যোগাযোগ রাখে সুদীপ্তের সঙ্গে। মূলত দালালদের মাধ্যমেই গ্রাহকের সঙ্গে টাকার চুক্তি করে কাজ করেন তিনি।

এসব দুর্নীতির বিষয়ে জানতে ভূমি অফিসে ভারপ্রাপ্ত এসিল্যান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করা পটিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আলউদ্দীন ভূঞা জনীকে একাধিকবার ফোন করা হয়। কিন্তু তিনি একবারও ফোন কল রিসিভ করেননি।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!