শাওয়াল মাসের ছয় রোজার ফজিলত

পবিত্র রমজানব্যাপী যারা সিয়াম সাধনা করেছেন তাদের জন্য শুভ সংবাদ হলো—শাওয়াল মাসে ছয়টি নফল রোজা রাখলেই মিলবে সারা বছর রোজা রাখার সওয়াব। এ ছয়টি রোজা রাখা মোস্তাহাব। এর ফজিলত বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।

হজরত আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) বলেন রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন যে ব্যক্তি রমজান মাসের ফরজ রোজাগুলো রাখল অতঃপর শাওয়াল মাসে আরও ছয়টি রোজা রাখল সে যেন সারাবছর ধরেই রোজা রাখল। (সহিহ মুসলিম : ১১৬৪)

আরবি মাসগুলোর মধ্যে শাওয়াল মাস বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ। এ মাসের বহুবিধ তাৎপর্য রয়েছে। এ মাসের প্রথম তারিখে ঈদুল ফিতর বা রমজানের ঈদ। পয়লা শাওয়াল সদকাতুল ফিতর বা ফিতরা আদায় করা এবং ঈদের নামাজ পড়া হয়। এ মাসের সঙ্গে হজ, ঈদ, রোজা, সদকা ও জাকাতের সংশ্লিষ্টতা আছে। আরবি হিজরি সনের দশম মাস শাওয়াল। এ মাসের আমল তাকওয়াকে শাণিত করে। ১৭ রমজান বদর বিজয় হয়েছিল এবং ৭ শাওয়াল তৃতীয় হিজরি সনে (২৩ মার্চ ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দে) ওহুদ যুদ্ধ হয়েছিল। এ মাস আমল ও ইবাদতের জন্য অত্যন্ত উর্বর ও উপযোগী। তাই এ মাস আমল ও ইবাদতের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। শাওয়াল মাসের ইবাদত আত্মনিয়ন্ত্রণের শক্তি অর্জনে সাহায্য করে পরিপক্বতা ও স্থিতিশীলতা লাভে সহায়ক হয়। রমজানে পূর্ণ মাস রোজা পালন করা ফরজ, শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখা সুন্নত। আল্লাহতাআলা কোরআন মজিদে বলেন যখন তুমি (ফরজ দায়িত্ব পালন থেকে) অবসর হবে তখন (নফল ইবাদতের মাধ্যমে) তোমার রবের প্রতি মনোনিবেশ করো। (সুরা-৯৪ ইনশিরাহ, আয়াত : ৮)

শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.)-বলেন যারা রমজানে রোজা পালন করবে এবং শাওয়ালে আরও ছয়টি রোজা রাখবে তারা যেন সারা বছরই রোজা পালন করল। প্রতিটি নেক আমলের বিনিময়ে আল্লাহতাআলা কমপক্ষে ১০ গুণ প্রতিদান দিয়ে থাকেন। কোরআন করিমের ভাষায় যে সৎকর্ম নিয়ে আসবে তার জন্য রয়েছে তার ১০ গুণ বিনিময়। (সুরা-৬ আনআম, আয়াত : ১৬০)। রমজানে এক মাস রোজা। সে অনুপাতে ৩০০ দিনের সমান। চান্দ্রবর্ষ ৩৫৫ দিনে হয় বলে অবশিষ্ট ৫৫ দিন পূরণের জন্য এই ছয় রোজা। হজরত মুসা (আ.)-৩০ দিন তুর পাহাড়ে ইবাদতে কাটানোর পর আল্লাহতাআলা তাঁকে আরও ১০ দিন পূর্ণ করার নির্দেশ প্রদান করেন।

স্মরণ করো—আমি মুসার জন্য ৩০ দিন নির্ধারণ করেছি এবং আরও ১০ দিবস দ্বারা তা পূর্ণ করেছি। এভাবে তার প্রতিপালকের নির্ধারিত ইবাদতের বিশেষ সময় ৪০ দিনে পরিপূর্ণ হয়। (যা তিনি রোজা, ইতিকাফসহ পালন করেছিলেন)। (সুরা-৭ আরাফ, আয়াত : ১৪২) কারও যদি রমজানের রোজা কাজা থাকে তা শাওয়াল মাসের ছয়টি সুন্নত রোজা পালনের আগে বা পরে আদায় করা যায়। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন (রমজান মাসে) তোমাদের মধ্যে যে (যত দিন) অসুস্থ থাকবে কিংবা সফরে থাকবে সে (রমজানের পর) অন্য দিনগুলোতে (তত দিন) রোজা পালন করবে। (সুরা-২ বাকারা, আয়াত : ১৮৪) তাই যাঁরা সফরের ক্লান্তির কারণে কিংবা অসুস্থ থাকার কারণে রমজানের সব রোজা রাখতে পারেননি অথবা যে নারীরা প্রাকৃতিক কারণে যে কয়টি রোজা পালন করতে পারেননি তাঁরা সেগুলো রমজানের পর অন্য সময়ে আদায় করে নেবেন।

আম্মাজান আয়িশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, আমরা ঋতুকালীন অবস্থায় গেলে রাসুল (সা.)-আমাদের এই রোজা পরে কাজা আদায় করার নির্দেশ দিতেন কিন্তু নামাজ কাজা আদায় করার কথা বলতেন না। (ওই অবস্থায় নামাজ মাফ)। রমজানের কাজা রোজা পরবর্তী রমজান মাস আসার আগ পর্যন্ত যেকোনো সময় আদায় করা যাবে। রমজানের কাজা রোজা রাখার জন্য যথেষ্ট সময় থাকলে তার আগে যেকোনো প্রকার ওয়াজিব সুন্নত বা নফল রোজা রাখা যাবে। যেমন ফরজ নামাজ আদায় করার আগে সময় থাকলে নফল নামাজ আদায় করা যায়। সুতরাং শাওয়ালের ছয়টি সুন্নত রোজা রমজানের কাজা রোজা আদায়ের আগেও রাখা যাবে। তবে সম্ভব হলে আগে ফরজ রোজার কাজা আদায় করা উত্তম।

হজরত আয়িশা (রা.) বলেন, আমার ওপর রমজানের যে কাজা রোজা বাকি থাকত তা পরবর্তী শাবান ব্যতীত আমি আদায় করতে পারতাম না। যেহেতু রমজানে ফরজ রোজা সবাই রাখেন তাই সবার সুবিধার্থে ইফতারের পর একটু বিলম্বে মসজিদে জামাত শুরু করা হয়। রমজান ছাড়া অন্য সময় বিভিন্ন রোজা যেহেতু ব্যাপকভাবে সবাই একসঙ্গে রাখেন না তাই মাগরিবের জামাতের ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে দীর্ঘ ইফতারের জন্য যেন জামাত ছুটে না যায়। বরং এসব ক্ষেত্রে মসজিদে পানি বা সামান্য কিছু দিয়ে ইফতার করে মাগরিবের নামাজ জামাতে আদায় করে পরে সুবিধামতো খাওয়াদাওয়া করা বাঞ্ছনীয়। মনে রাখতে হবে জামাতে নামাজ আদায় করা অন্য সুন্নত নফল অপেক্ষা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ আমল। শাওয়াল মাসের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি আমল হলো ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ আইয়ামে বিদের সুন্নত রোজা রাখা। আম্মাজান উম্মে সালমা (রা.)-বর্ণনা করেছেন প্রিয় নবীজি (সা.)-তিনটি আমল জীবনে কখনো ছাড়েননি। এক. তাহাজ্জুদের নামাজ, দুই. আইয়ামে বিদের রোজা, তিন. রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ। কারও যদি রমজানের রোজা কাজা থাকে তা শাওয়াল মাসের ছয়টি সুন্নত রোজা পালনের আগে বা পরে আদায় করা যায়। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন (রমজান মাসে) তোমাদের মধ্যে যে (যত দিন) অসুস্থ থাকবে কিংবা সফরে থাকবে সে (রমজানের পর) অন্য দিনগুলোতে (তত দিন) রোজা পালন করবে।

হাদিস শরিফে বর্ণিত হজরত আয়েশা (রা.)-বলেন আমার ওপর রমজানের যে কাজা রোজা বাকি থাকত তা পরবর্তী শাবান ব্যতীত আমি আদায় করতে পারতাম না। (বুখারি ও মুসলিম) হাদিসমতে শাওয়াল মাসে বিয়েশাদি সুন্নত যেরূপ শুক্রবার এবং জামে মসজিদ ও বড় মজলিশে আকদ অনুষ্ঠিত হওয়া সুন্নত। কারণ হজরত আয়েশার (রা.)-বিয়ে শাওয়াল মাসের শুক্রবারে মসজিদে নববিতেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ইবনুল কায়্যিম (রহ.)-বলেছেন শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা হওয়ার মধ্যে বিশেষ রহস্য রয়েছে। তা হলো এই ছয়টি রোজা রমজানের রোজার পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। রোজার মধ্যে যেসব ভুল-ত্রুটি হয়েছে অতিরিক্ত রোজাগুলো তা দূর করে দেয়। বিষয়টি ফরজ নামাজের পর সুন্নত ও নফল নামাজের মতো এবং নামাজে ভুল হলে সিজদায়ে সাহু দেওয়ার মতো।

এ ছাড়া প্রতি সপ্তাহে সোমবার ও বৃহস্পতিবারের সুন্নত রোজা রয়েছে যা মক্কা মুকাররমায় ও মদিনা মুনাওয়ারায় অদ্যাবধি অতীব গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হয় এবং অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে রাষ্ট্রীয়ভাবে ও স্থানীয় পর্যায়ে ইফতারির আয়োজন করা হয়। রমজানের রোজার অভ্যাস অব্যাহত থাকা অবস্থায় বেশি বেশি নফল রোজা রাখা যায়। ছয় রোজা যেভাবে রাখতে হয় : শাওয়াল মাসের যেকোনো দিন এই ছয়টি রোজা রাখা যাবে। কেউ চাইলে মাসের শুরুতে রাখতে পারবে। কেউ চাইলে মাসের মধ্য ভাগে কিংবা শেষ অংশেও রাখতে পারবে। কেউ চাইলে তা অল্প অল্প করে পুরো মাসে রাখতে পারবে। এ ক্ষেত্রে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে নফল আমলের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা থাকা উচিত। সেই হিসেবে এই আমলও মাসের শুরুতে করা উত্তম।
হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এই রোজা রাখতেন এবং সাহাবিদের রাখার নির্দেশ দিতেন। হাদিসে আছে যখন কোনো বান্দার আমল আল্লাহতায়ালা কবুল করেন তখন তাকে অন্য আরও নেক আমলের তওফিক দেন। এই রোজাগুলো রাখতে পারা রমজানের রোজা কবুল হওয়ার নিদর্শন। তাই নামাজ, রোজা, তিলাওয়াত ও অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগি বাকি ১১ মাসও বজায় রাখতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে আমল করার তাওফিক দিন। আমিন।

লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!