ভাই ও পীরের মৃত্যুতে অঝোরে কাঁদলেন সাইফুল আলম মাসুদ

করোনায় তছনছ এস আলম পরিবার

চট্টগ্রামের এস আলম পরিবার যখন পুরো শক্তি নিয়ে লড়ে যাচ্ছে প্রাণঘাতি করোনাভাইরাসের সঙ্গে, তখন সেই পরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্যটি দেশের বাইরে— সিঙ্গাপুরে। তিনি এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ। সেখান থেকেই তিনি অবাক বিস্ময়ে দেখলেন, মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশের শীর্ষস্থানীয় এই বিত্তশালী পরিবারটি এক করোনাঝড়েই রীতিমতো বিধ্বস্তপ্রায়।

সিঙ্গাপুর লিটল ইন্ডিয়ার বাড়িতে বসেই অন্তত সাতটি ব্যাংকের মালিক সাইফুল আলম মাসুদ দেশ থেকে যাওয়া দুঃসংবাদ শুনে যাচ্ছেন ঘন্টায় ঘন্টায়, আঘাত সয়ে চলেছেন একের পর এক। এ সময়ে নিজের বড় ভাইয়ের মৃত্যু ছাড়াও নিজের পীরের মৃত্যুসংবাদ শুনতে তো হয়েছেই, করোনার সঙ্গে মা-ভাই-ছেলের অসম লড়াইয়ের বেদনাও তাকে পোড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত।

গত শনিবারও (২৩ মে) বিমর্ষ সাইফুল আলম মাসুদ দেশে থাকা পরিবারের সদস্যদের ফোন করে বলেছেন একটি কথাই— ‘আল্লাহরে হ’। আল্লাহরে ডাকো। আল্লাহ ছাড়া কেয়াই বাচাইত ন’ পারিব।’ (আল্লাহকে বলো। আল্লাহকে ডাকো। আল্লাহ ছাড়া আর কেউ বাঁচাতে পারবে না।)

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুতে ১৮ মার্চ সিঙ্গাপুরে যান সাইফুল আলম মাসুদ। সিঙ্গাপুর যাত্রাকালে তার সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী ফারজানা পারভীন পপি, মেজ ছেলে আশরাফুল আলম ও ছোট ছেলে মাহির আলম। পারিবারিক সূত্রে এটি শিল্পপতি মাসুদের ‘ব্যবসায়িক সফর’ বলা হলেও অনেকের ধারণা, করোনার কবল থেকে মুক্তি পেতেই দেশ ছাড়েন তিনি। কাকতালীয়ভাবে যেদিন তিনি দেশ ছাড়েন, বাংলাদেশে সেদিনই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম কোনো রোগী মারা যান। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কেবল বড় ছেলে আহসানুল আলম মারুফ তার স্ত্রী ও চার মাস বয়সী সন্তানসহ চট্টগ্রামে থেকে যান। সিঙ্গাপুরে সাইফুল আলম মাসুদের নিজস্ব বাড়ি রয়েছে। পরিবারসহ বর্তমানে সেখানেই অবস্থান করছেন তিনি।

পারিবারিক সূত্রটি বলছে, ব্যবসায়িক কাজে গিয়ে লকডাউনে তিনি আটকা পড়ে যান সিঙ্গাপুরে। এই আটকা পড়ার সময়ে প্রথম আঘাতটি আসে গত রোববার (১৭ মে)। ওইদিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ল্যাবের পরীক্ষায় সাইফুল আলম মাসুদের পরিবারের ৬ সদস্য করোনা পজিটিভ রোগী হিসেবে শনাক্ত হন। এরা হলেন এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের পরিচালক ৬২ বছর বয়সী মোরশেদুল আলম, এস আলম গ্রুপের পরিচালক ৬০ বছর বয়সী রাশেদুল আলম, এস আলম গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ৫৩ বছর বয়সী আবদুস সামাদ লাবু, ইউনিয়ন ব্যাংক ও এস আলম গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মদ শহীদুল আলম এবং এস আলম গ্রুপের পরিচালক ৪৫ বছর বয়সী ওসমান গণি। এছাড়া করোনায় আক্রান্ত হন তার এক ভাইয়ের স্ত্রীও।

এরপর দ্বিতীয় আঘাতটি আসে পরিবারের বাইরে থেকে— বুধবার (২০ মে) বিকেলে। ওইদিন ঢাকার আনোয়ার খান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান চট্টগ্রাম বায়তুশ শরফ দরবার শরীফের পীর মাওলানা কুতুব উদ্দীন। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যায় ভুগলেও মৃত্যুর পর দেওয়া রিপোর্টে তার শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এই পীরের ভ্ক্ত ছিলেন সাইফুল আলম মাসুদসহ পুরো এস আলম পরিবারই। যে কোনো কাজে পীর মাওলানা কুতুব উদ্দীনের দোয়া ও পরামর্শ নিতেন এস আলম পরিবার। নিজের পীরকে চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করার খবর পেয়েই বিমর্ষ ছিলেন শিল্পপতি মাসুদ। এর মাত্র একদিন পর যখন সেই পীরের মৃত্যুসংবাদ সিঙ্গাপুরে পৌঁছালো, তখন রীতিমতো স্তব্ধ সাইফুল আলম মাসুদ। তার পারিবারিক সূত্র বলছেন, ‘পীর কুতুবউদ্দিনের মৃত্যুতে তিনি খুবই শোকাভিভূত ছিলেন। পীরের প্রতি তার অন্তরে অসম্ভব শ্রদ্ধা ছিল সবসময়ই।’

তৃতীয় আঘাতটি আসে শুক্রবার (২২ মে)। ওইদিন রাত ১০টা ৫০ মিনিটে এস আলম পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্য এবং সাইফুল আলম মাসুদের বড় ভাই মোরশেদুল আলম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ ওয়ার্ডে মারা যান। ৬২ বছর বয়সী মোরশেদুল আলম ভাইদের কাছে ছিলেন বাবার মতো। মাথার ওপর থেকে এই ছায়াটি এমনভাবে সরে যাবে— কল্পনাও করতে পারেননি সিঙ্গাপুরে থাকা সাইফুল আলম মাসুদ। চট্টগ্রাম প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপচারিতায় তার পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ওই সূত্রটি বললেন, ‘বড় ভাইয়ের মৃত্যুর কথা শুনে অঝোরে কেঁদেছেন মাসুদ সাহেব।’

সর্বশেষ আঘাতটি এলো শনিবার (২৩ মে)। পাঁচ ভাইয়ের পর এদিন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন ৮৫ বছর বয়সী মা চেমন আরা বেগম এবং ২৬ বছর বয়সী বড় ছেলে আহসানুল আলম মারুফও। মা অন্তঃপ্রাণ সাইফুল আলম মাসুদের জন্য এটি ছিল বড় ধাক্কাই। মূলত সিঙ্গাপুর থেকে তার তদারকিতেই শনিবার দুপুরে চট্টগ্রাম নগরীর সুগন্ধা আবাসিক এলাকার ১ নম্বর রোডের বাসা থেকে আইসিইউযুক্ত অ্যাম্বুলেন্সে করে মা ও পরিবারসহ ছেলেকে ঢাকার গুলশানের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। করোনায় আক্রান্ত অন্য চার ভাইকেও রোববার (২৪ মে) ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে।

সিঙ্গাপুর থেকে বিভ্ন্নি সময়ে ফোনালাপে করোনা পরিস্থিতিতে পরিবারের সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে এবং বাসায় থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন সাইফুল আলম মাসুদ। সেই সঙ্গে পটিয়ার অসহায় মানুষের দুঃখ-দুর্দশার বিষয়েও ফোনে নিয়মিত খোঁজখবর নিয়ে সাহায্য দিতে বলেছেন ঘনিষ্ঠজনদের— জানিয়েছেন শিল্পপতি মাসুদের পারিবারিক সূত্রটি।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!