করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে অনেক কিছুর সাথে বদলে গেছে রাজনৈতিক হিসাবনিকাশও। করোনার কারণে চলতি বছরের মার্চ মাসের স্থগিত হওয়া চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ভোটগ্রহণের নতুন তারিখ নির্ধারণ করেছে নির্বাচন কমিশন। আগামী ২৭ জানুয়ারি চসিকের নির্বাচনের নতুন তারিখ নির্ধারণ করেছে নির্বাচন কমিশন।
ফলে নতুন করে ভোটের হাওয়া বইতে শুরু করেছে নগরে। তবে এর মাঝে বয়ে যাওয়া নয় মাসে বদলে গেছে ভোটের রাজনীতির অনেক হিসাবনিকাশও। আর বদলে যাওয়ার হাওয়া সবচেয়ে বেশি লেগেছে নগরীর ৯ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডে। এবারের চসিক নির্বাচনে এই ওয়ার্ড থেকে বর্তমান কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিমকে বাদ দিয়ে কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে পাহাড়তলী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আবচার মিয়াকে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়া কাউন্সিলরদের মধ্যে প্রথমদিকে জসিম সবচেয়ে ছিলেন নমনীয়। এমনকি তাদের মধ্যে একমাত্র তিনিই প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। যদিও পরে নাটকীয় এক ঘটনায় প্রার্থিতা প্রত্যাহার থেকে সরে আসেন জসিম। তবু স্থগিত হওয়ার আগে নির্বাচন থেকে নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। তবে করোনায় ভোট স্থগিত হওয়ার পর আবার নতুন তারিখ নির্ধারিত হওয়ার মধ্যকার সময়টাতে নিজের অবস্থান অনেকটা গুছিয়ে নিয়েছেন জসিম। ফলে বদলে গেছে জসিমের অবস্থানও। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচন নিয়ে এখন অনেকটা কঠোর অবস্থানে জসিম। এই মুহূর্তে নির্বাচনে জয় ছাড়া বিকল্প কিছুই ভাবছেন না তিনি।
জসিম নিজেও চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে নির্বাচনের বিষয়ে নিজের বর্তমান ভাবনা সম্পর্কে বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে আমাদের ভাবনা হলো যে আমরা নির্বাচন করবো— এটাই মূল কথা। নির্বাচন করার জন্য এলাকার ভোটারদের প্রচণ্ড চাপ আছে। তারাই চাইছে আমরা যাতে নির্বাচন করি। কারণ গত পাঁচ বছর আমরা তাদের সুখে-দুঃখে ছিলাম। করোনাকালেও আমরা মানুষের ঘরে ঘরে গেছি।’
নয় মাসের মাথায় জসিমের এই বদলে যাওয়ার কারণও রয়েছে অনেক। মাঝের এই সময়ে এই ওয়ার্ডটিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক মেরুকরণের সুফল ঘরে তুলেছেন জসিম। এই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক এসএম আলমগীর কয়েকদিন আগে গত হয়েছেন। যিনি সম্পর্কে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নুরুল আবছার মিয়ার চাচা ছিলেন।
এছাড়া স্থানীয় রাজনীতিতে মূলত প্রভাব রাখেন এই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের তিন যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার মোর্শেদ কচি, মোহাম্মদ এরশাদ মামুন ও জহুরুল আলম জসিম। এর মধ্যে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ এরশাদ মামুনের সমর্থনও ঘরে তুলেছেন জসিম। ফলে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার মোর্শেদ কচি ছাড়া এই মুহূর্তে নুরুল আবছার মিয়ার সাথে আর বলার মত কোনো স্থানীয় নেতা নেই।
এর বাইরেও ভিন্ন কিছু হিসাবনিকাশের কথাও উঠে আসছে স্থানীয় সূত্রগুলো থেকে। তালিকাভুক্ত কিশোর গ্যাং লিডার জহুরুল আলম জসিমের বিরুদ্ধে ভূমিদস্যুতা, চাঁদাবাজিসহ ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ছিল। মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে স্বাভাবিকভাবেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রোষানলে পড়ার আতঙ্ক ছিল তার। তবে গত নয় মাসে বিভিন্নভাবে এসব অভিযোগের ব্যাপারে প্রশাসনকে অনেকটাই ‘ম্যানেজ’ করে নিতে পেরেছেন তিনি। ফলে রাজনৈতিক মেরুকরণ ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করার জন্য পাওয়া এই নয় মাস সময়ই মূলত বদলে দিয়েছে এই ওয়ার্ডের নির্বাচনে জসিমের অবস্থান।
এই বিষয়ে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার মোর্শেদ কচি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘উনি তো (জসিম) শুধু বিদ্রোহী প্রার্থী নন, তিনি কিশোর গ্যাংয়ের লিডার, ভূমিদস্যু। আমরা এই এনভায়রনমেন্টটাকে চেঞ্জ করতে চাচ্ছি। আমি শেখ হাসিনা মনোনীত প্রার্থীর পক্ষেই আছি।’
তবে জসিমের এই অবস্থানের বদলে স্বস্তির চেয়ে সংঘাতের আশংকা বাড়ছে সংশ্লিষ্ট মহলে। নির্বাচনকে ঘিরে এই ওয়ার্ডে ব্যাপক সংঘাতের আশংকা করছে আওয়ামী লীগের একটি অংশ। ফলে জসিমকে নির্বাচন করতে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টাও করছেন তারা। যার অংশ হিসেবে গত ২৩ ডিসেম্বরও জসিমকে ডেকে নিয়ে গিয়ে কথা বলেন স্থানীয় সাংসদ দিদারুল আলম। তিনি জসিমকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর অনুরোধ করেন।
যদিও এই সময়ে জসিমের সাথে থাকা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের অপর যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ এরশাদ মামুন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা মূলত গিয়েছিলাম আমাদের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের আহ্বায়কের মেজবানের বিষয়ে আলাপ করতে। বিদ্রোহী নির্বাচন না করার জন্য তো প্রতিনিয়ত বলা হচ্ছে। সেখানেও এই বিষয়ে আলাপ হয়েছে।’
জসিমের সাথে নতুন ঐক্যের কথা স্বীকার করে নিয়ে কাউন্সিলর নির্বাচনে নিজের অবস্থান সম্পর্কে মামুন বলেন, ‘আমি তো দলের বিরুদ্ধে গিয়ে নির্বাচন করবো না। জসিমের সাথে আমার যে ঐক্যটা— তা হলো রাজনৈতিক ঐক্য। আমি জসিমের পক্ষেও না, বিপক্ষেও না।’
ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার মোর্শেদ কচি বলেন, ‘বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে যারা গিয়েছেন তাদের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ, চসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমন্বয়কারী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনসহ সবার কাছে বলা আছে। এখানে দলের প্রার্থীকে জেতাতে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ সবাই ঐক্যবদ্ধ আছে। বিচ্ছিন্নভাবে কেউ কেউ তাদের একটা সিন্ডিকেট করে দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। তবে তাতে কিছু আসে যায় না। কারণ এই ওয়ার্ডে সবসময় আওয়ামী লীগের উর্বর সংগঠন ছিল। এখনও তাই আছে।’
সিপি