জীবনঝুঁকি/ জলজটের লজ্জা বাঁচাতে মুরাদপুর ফ্লাইওভারে লোহা কেটে পাইপ!

জলজটের ঝুঁকি এড়াতে নগরবাসীকে প্রাণের ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। চট্টগ্রামের মুরাদপুর-লালখানবাজার ফ্লাইওভারে নকশা না মেনে ইচ্ছেমতো ফ্লোর কেটে বসানো হচ্ছে পাইপ। ফ্লাইওভারের পানি নিষ্কাশনের জন্য আগের ৪ ইঞ্চি ব্যাসের জায়গায় এখন তার দ্বিগুণ ব্যাসের পাইপ বসানোর কাজ চলছে। সিডিএর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামের সময়ে করা এই ফ্লাইওভারটির উদ্বোধনই হয়েছিল নির্মাণক্রটি নিয়ে। এখন সেই ফ্লাইওভারের ফ্লোরে কাণ্ডজ্ঞানহীন খোঁড়াখুঁড়ির কারণে ভবিষ্যতে বড়ো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

টানা কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতেই চট্টগ্রামের মুরাদপুর-লালখানবাজার ফ্লাইওভারে জলজট তৈরি হয়। এ নিয়ে নগরবাসীর মাঝে ক্ষোভের পাশাপাশি ফ্লাইওভারের নির্মাণত্রুটি নিয়েও নানা সময়ে ওঠা প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসেন অনেকে। ফ্লাইওভারের ওপর জমা পানি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনাও হয় ব্যাপক। মূলত সমালোচনা থেকে বাঁচতেই নকশা বর্হিভূতভাবে ফ্লাইওভারের ফ্লোর কেটে বসানো হচ্ছে পাইপ।

৪ ইঞ্চি ব্যাসের জায়গায় এখন তার দ্বিগুণ ব্যাসের পাইপ বসানোর কাজ চলছে।
৪ ইঞ্চি ব্যাসের জায়গায় এখন তার দ্বিগুণ ব্যাসের পাইপ বসানোর কাজ চলছে।

ফ্লাইওভারে গিয়ে দেখা গেছে, আগের পাইপগুলোর চেয়ে দ্বিগুণ বড় ব্যাসার্ধের মোট ৬৪টি পাইপ বসানো হচ্ছে। এতে নির্মাণ ত্রুটি নিয়ে উদ্বোধন হওয়া এই ফ্লাইওভারটির কার্যক্ষমতাও ঝুঁকির মধ্যে পড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বলছেন যদি বিশেষজ্ঞরা এমন ঝুঁকির কথা বলে থাকে তাহলে বিষয়টি নিজেই তদারক করবেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, ফ্লাইওভারের ২ নম্বর গেট থেকে লালখানবাজার পর্যন্ত ফ্লাইওভারের উভয় পাশে থাকা পানি নিষ্কাশনের পাইপগুলোর মুখ দ্বিগুণ করার কাজ করছেন শ্রমিকরা। আগে পানি নিষ্কাশনের জন্য ৪ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ ব্যবহার করা হলেও এর স্থলে ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ বসানোর কাজ চলছে। কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে পুরো ফ্লাইওভারেই এ ধরনের ব্যাস বাড়িয়ে পাইপ বসানো হবে বলে জানিয়েছেন কর্মরত শ্রমিকরা। এ কাজ করতে গিয়ে গার্ডারের পাশেই রেলিং ঘেঁষেই কাটা হচ্ছে ফ্লাইওভারের ফ্লোর। ব্যাসার্ধ বাড়াতে গিয়ে কাটা হচ্ছে কংক্রিটও। ৪ ইঞ্চির জায়গায় ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ বসাতে প্রায় ১২ ইঞ্চির সমপরিমাণ কংক্রিট কেটে ফেলছেন শ্রমিকরা। আগের পাইপগুলো বসাতে গার্ডারের সঙ্গে ফ্লোরের চারটি রড কাটা হলেও নতুন করে পাইপ বসাতে আরো ১৮টি পাইপ কাটা হচ্ছে।

গার্ডারের পাশেই রেলিং ঘেঁষেই কাটা হচ্ছে ফ্লাইওভারের ফ্লোর।
গার্ডারের পাশেই রেলিং ঘেঁষেই কাটা হচ্ছে ফ্লাইওভারের ফ্লোর।

প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় মুরাদপুর-লালখানবাজার ফ্লাইওভার প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। চার লেনবিশিষ্ট ফ্লাইওভারের মোট দৈর্ঘ্য ৫ দশমিক ২ কিলোমিটার। এর নির্মাণ ব্যয় ছিল ৪৬২ কোটি ২১ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। ২০১৪ সালের নভেম্বরে চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ শুরু হয়।

২০১৭ সালের জুলাইয়ে প্রায় ৬ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভারটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। নির্মাণের শেষ পর্যায়ে এসে ৪৬২ কোটি টাকায় নির্মিত ফ্লাইওভারটিতে একটি লুপ ও পাঁচটি র‌্যাম্প সংযুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। ষোলশহর ২ নম্বর গেট এলাকায় একটি লুপ লাইন ও জিইসি মোড়ে পাঁচটি র‌্যাম্প নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৩৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ ফ্লাইওভারটি নির্মাণে সর্বমোট ব্যয় ৬৯৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। তবে ফ্লাইওভার থেকে পানি নিষ্কাশনে চার ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ বসানো হয় শুরু থেকে। কিন্তু এরপরও টানা বৃষ্টিতে ফ্লাইওভারে জলজট সৃষ্টি হচ্ছে।

এর কারণ ব্যাখা করতে গিয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) নির্বাহী প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেছেন, ‘প্রতিদিন রাতের বেলায় ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে কয়েকশত বালির ট্রাক যায়। ঘন্টায় ৩০টিরও বেশি ট্রাক এ পথে যায়। ট্রাক থেকে বালি পড়ে বৃষ্টির পানির সাথে বালি গিয়ে পাইপের জালি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে কিছু সময়ের জন্য ফ্লাইওভারে পানি জমে। আমরা সবসময় পাইপের জালি পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করি। বালির ট্রাক যাওয়া যদি বন্ধ করা যেতো তাহলে এই সমস্যা হতো না। কিন্তু ট্রাক যাওয়া তো বন্ধ করা সম্ভব না।’

তবে ফ্লাইওভার দিয়ে বালির ট্রাক চলাচল বন্ধ করতে না পারায় জলজট নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এই সমালোচনা থেকে বাঁচতে নির্মাণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স-র‌্যাঙ্কিনকে উপায় বের করতে বলে সিডিএ। তারপর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মুরাদপুর ফ্লাইওভারের ৬৪টি স্থানের পাইপের ব্যাসার্ধ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়।

জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার বলেছেন, ‘একটি ফ্লাইওভার নির্মাণের পর সেটির যেকোনো অংশের অপেশাদারভাবে পরিবর্তন অবশ্যই বৃহৎ ওই কাঠামোর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। একটি জমানো কংক্রিটের সবগুলো রড কেটে পাইপ বসানো হলে কোনো না কোনোভাবে এর প্রভাব পড়বেই।’
বরং বড় পাইপ না বসিয়ে নিয়মিত ফ্লাইওভারটি রক্ষণাবেক্ষণ করলে সবচেয়ে ভালো হতো বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ব্যাসার্ধ বাড়াতে গিয়ে কাটা হচ্ছে কংক্রিটও।
ব্যাসার্ধ বাড়াতে গিয়ে কাটা হচ্ছে কংক্রিটও।

তবে এসব কথা মানতে রাজি নন মুরাদপুর-লালখান বাজার ফ্লাইওভার প্রকল্পের পরিচালক ও সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ফ্লাইওভারের দুই পাশে যানবাহন চলাচল সীমিত। ফলে রড কাটলেও সেটি ফ্লাইওভারের মূল অবকাঠামোতে প্রভাব ফেলবে না। এছাড়া পাইপ বসানোর পর সেটি কংক্রিট দিয়ে আবারো বন্ধ করে দেওয়া হবে।’

তবে এ ফ্লাইওভার নির্মাণের আগে ফিজিবিলিটি স্টাডি টিমের অন্যতম সদস্য চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. স্বপন কুমার পালিত সিডিএর এ ব্যাখায় দ্বিমত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এই ফ্লাইওভারের ফিজিবিলিটি স্টাডি করলেও এর ডিজাইন করেছে ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠান ও বিদেশি আরেকটি প্রতিষ্ঠান। তারা তখন নিশ্চয় একটি মেয়াদকাল বিবেচনায় নিয়েই এর ডিজাইন করেছে। কিন্তু চার ইঞ্চি ব্যাসের পাইপের বদলে যখন ব্যস বাড়িয়ে ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি করা হয় তা অবশ্য নেতিবাচক ফেলবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘তবে আমি যেহেতু বিষয়টি দেখিনি তাই মন্তব্যও করতে পারছি না। আপনার কথা ধরে বললে বলবো, এটা অবশ্যই ফ্লাইওভারের জন্য ক্ষতি হবে। নিশ্চয় প্রত্যেক জিনিসের একটি নির্দিষ্ট মেয়াদকাল থাকে। এটার স্বল্পমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব না পড়লেও পরবর্তীতে গিয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সেকারণে এই ফ্লাইওভার যে ঝুঁকির মধ্যে পড়বে না তা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।’

মুরাদপুর ফ্লাইওভারে লোহা কেটে বসানো হচ্ছে পাইপ
মুরাদপুর ফ্লাইওভারে লোহা কেটে বসানো হচ্ছে পাইপ

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ফ্লাইওভারে পানি জমে থাকার কারণে সমালোচনা হওয়ায় আমি প্রকৌশলীদের তা সমাধানের নির্দেশ দিয়েছিলাম। তখন আমাদের প্রকৌশলীরা ঠিকাদারদের তা সমাধানের কথা বলেছেন। হয়তো সেজন্য তারা বড় পাইপ বসানোর জন্য ফ্লাইওভারের ফ্লোর কাটছে।’

এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কার কথা জানালে তখন সিডিএ চেয়ারম্যান বলেন, ‘এখন যেহেতু ফ্লোর কাটায় ফ্লাইওভার ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। সেজন্য কালই আমি ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে বসবো। তাদের মতামত নেবো।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!