ফ্লাইওভারে সিডিএর ‘টোল ব্যবসা’ চলবে না, চসিককে হস্তান্তরের নির্দেশ

অবসান হলো সকল তর্ক-বিতর্ক আর জন উৎকণ্ঠার। টোল বসছে না আখতারুজামান ফ্লাইওভারে। আখতারুজামান ফ্লাইওভারে টোল আদায়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। একই সাথে ফ্লাইওভারটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অনুকূলে হস্তান্তর করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। গত ১৪ জুলাই এ সংক্রান্ত একটি চিঠি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব ও চসিক বরাবর পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়।

জানা যায়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের (সিটি করপোরেশন- ২ শাখা) উপ-সচিব মো. এমদাদুল হক চৌধুরী স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘মুরাদপুর, দুই নম্বর গেইট ও জিইসি জংশনে ফ্লাইওভার নির্মাণ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় নির্মিত মুরাদপুর থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত ছয় দশমিক দুই কিলোমিটার আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে টোল আদায় করার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই এবং প্রকল্পের অনুমোদিত ডিপিপিতে টোল আদায়ের বিষয়টি উল্লেখ নেই। এছাড়া স্থানীয় জনগণ এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ টোল আদায়ের বিরোধিতা করছেন বিধায় টোল আদায় করা সমিচীন হবে না।’

ওই চিঠিতে এ অবস্থায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অনুকূলে হস্তান্তর করা হলে করপোরেশন কর্তৃপক্ষ টোল আদায় ছাড়াই নিজস্ব তহবিল থেকে ফ্লাইওভারটির রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবে বলে উল্লেখ করা হয়।

এর আগে সিডিএর প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১২ মার্চ আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে টোল আদায়ের বিষয়ে মতামত চেয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিল গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। বিষয়টি জানাজানি হলে ফ্লাইওভারে টোল আদায় প্রসঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠন টোল আদায়ে জনমনে নানা নেতিবাচক প্রভাবের কথা উল্লেখ করে এর বিরোধিতা করে আসছে। পরবর্তীতে আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভার থেকে টোল আদায়ে আপত্তি জানিয়ে গত ৮ এপ্রিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে চিঠি দিয়েছিলেন চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সামসুদ্দোহা। এর আগে ৩ এপ্রিল ফ্লাইওভারের টোল আদায়ে চসিকের মতামত চেয়ে চিঠি দিয়েছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে সিডিএর ফ্লাইওভার ও ফ্লাইওভারের নিচের সৌন্দর্যবর্ধন কাজ সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করলে টোল আদায় না করেই তার যাবতীয় রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয়ভার বহনে চসিক সম্মত আছে বলে জানানো হয়। এতে মেয়রেরও সম্মতি আছে বলে ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

এদিকে, মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন ফ্লাইওভার ব্যবহারকারী ছাড়াও চট্টগ্রামের সচেতন নাগরিকরা।

মো. জাহাঙ্গীর হোসেন নামে একজন বাইক চালক বলেন, ‘আমার মতো ১৭ কোটি মানুষের ট্যাক্সের টাকায় এই ফ্লাইওভার তৈরি করা হয়েছে। কারো দয়ায় নয়। আমি কেন টোল দেবো? টোল আদায়ের প্রস্তাব ছিল অন্যায্য। আমরা সরকারের সিদ্ধান্তে খুশি হয়েছি।’

এ বিষয়ে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক-টিআবি) চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি এডভোকেট আকতার কবির চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে এমনিতেই গাড়ি উঠতে চায় না। নিচে যে গাড়ি চলাচল করে, তার মাত্র ২০ ভাগের একভাগ ফ্লাইওভারে উঠে। এখন টোল বসানো হলে গাড়ি একেবারেই উঠতেই চাইবে না। এমনিতে গ্যাস, বিদ্যুৎ বাড়ছে। দেশটা ট্যাক্সে ভরে যাচ্ছে। এ অবস্থায় মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তকে আমরা সাধুবাদ জানাই। এটি একটি পজিটিভ সিদ্ধান্ত। পাশাপাশি সিডিএর গণবিরোধী সিদ্ধান্তের নিন্দা জানাাই।’

এ ব্যাপারে ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক ও সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে আমরা কোন পত্র পাইনি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় চসিকের মতামত চেয়েছিল। চসিকের মতামতের ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে। আমাদের মন্ত্রালয় থেকে যতক্ষণ পর্যন্ত কোন নির্দেশনা পাচ্ছি না, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভার চসিকের কাছে হস্তান্তর করবো না।’

এ ব্যাপারে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সামসুদ্দোহা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় মতামত চেয়েছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় আমাদের মতামত চেয়েছিল। আমরা বলেছি, আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের টোল আদায় করা সমীচিন হবে না। এটি আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হলে আমরা টোল ছাড়াই রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবো। আমাদের মতামতের ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি দিয়েছে। এখন টোল আদায় করা বা না করা এবং ফ্লাইওভার চসিকের কাজে হস্তান্তরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।’

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা যে মতামত দিয়েছিলাম, সেটা আমলে নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় টোল আদায় না করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে গৃহায়ণ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে। যেহেতু ফ্লাইওভারটি গৃহায়ণ মন্ত্রণালয় তৈরি করেছে, আমাদের কাছে হস্তান্তরের বিষয়েও তারাই সিদ্ধান্ত দেবে এখন।’

ফ্লাইওভারে টোল আদায়ের প্রস্তাবকারী সিডিএর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম বলেন, ‘আমি থাকাকালীন প্রস্তাবটি করেছিলাম, কিন্তু এখনতো আমি নেই। সরকারি প্রতিষ্ঠানে যদি সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত আসে তা তো প্রতিষ্ঠান হিসেবে সিডিএকে মানতে হবে। আমার সময়ে এ আদেশ আসলে আমাকেও মানতে হতো।’

উল্লেখ্য, ৪৫৭ কোটি টাকায় মুরাদপুর থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত ৬ দশমিক ২ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৫৪ ফুট চওড়া ফ্লাইওভারটি মুরাদপুর এন মোহাম্মদ কনভেনশন সেন্টারের সামনে থেকে উঠে জমিয়তুল ফালাহ মসজিদের পশ্চিম গেটের সামনে এসে নেমেছে। ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স-রেনিকিন জেবি। চালু হওয়া এই ফ্লাইওভারটিতে জিইসি মোড়ে ওঠা ও নামার র‌্যাম্প রয়েছে। তবে বিভিন্ন সময়ে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাতেই এই ফ্লাইওভারে পানি জমে যান চলাচলে দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়। এছাড়া আলোর ব্যবস্থা না থাকায় রাতে বেলায় অন্ধকারের পরিণত হয় ফ্লাইওভারটি।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!