‘ঘুষ’ না পেয়ে পরিবহন নেতাকে ‘সোর্স দিয়ে পেটালেন’ সার্জেন্ট, আদালতে মামলা

ডিবিকে তদন্তের নির্দেশ

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) বন্দর ট্রাফিক পুলিশ (প্রসিকিউশন) দপ্তরে গত মাসেই যোগ দেন সার্জেন্ট মো. সুমন উদ্দিন। ওই জোনের আওতায় ট্রাফিক কর্তৃক জব্দ করা গাড়ি ছাড়া দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। কিন্তু তিনি কোনো নিয়ম-নীতি মানেন না। গাড়ি ছাড়াতে গেলেই তাকে অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়। টাকা না দিয়ে প্রতিবাদ করলে পড়তে হয় বিপদে, পেটানো হয় তার সোর্স বাহিনী দিয়ে। তিনি আবার নিজেকে সড়ক ও পরিবহন মন্ত্রীর এলাকার লোক বলেও পরিচয় দেন।

সম্প্রতি এক পরিবহন শ্রমিক নেতা তার রোষানলের শিকার হয়েছেন।

জানা গেছে, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগ চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. ইউসুফ তার একটি জব্দ করা গাড়ি ছাড়াতে যান সিএমপি ট্রাফিক বন্দর প্রসিকিউশন দপ্তরে। সেখানে তার কাছ থেকে বাড়তি টাকা চান সার্জেন্ট সুমন উদ্দিন। টাকা না দিলে চার ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখেন। পরে সুমনের সোর্স বাহিনী দিয়ে পেটানোও হয় তাকে।

এ ঘটনায় বাদি হয়ে আদালতে একটি মামলা করেন পরিবহন শ্রমিক নেতা ইউসুফ। সিএমপির গোয়েন্দা শাখাকে (ডিবি) মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

চট্টগ্রাম বন্দর ট্রাফিক পুলিশ (প্রসিকিউশন) সার্জেন্ট মো. সুমন ছাড়াও মামলায় অভিযুক্ত অপর পুলিশ সদস্যরা হলেন সিএমপি উপপুলিশ কমিশনার কার্যালয়ের (পশ্চিম) ট্রাফিক পুলিশ কনস্টেবল মো. মুসলিম। এছাড়া আরও ৭-৮ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে।

মামলার বিবরণে জানা গেছে, চলতি বছরের ২২ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১১টায় ট্রাফিক পুলিশ কর্তৃক জব্দ করা গাড়ি ছাড়াতে সিএমপি বন্দর ট্রাফিক (প্রসিকিউশন) দপ্তরের সার্জেন্ট মো. সুমন উদ্দিনের কাছে যান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. ইউসুফ ও গাড়ি চালক নুরুল আলম।

গাড়ির চালক নুরুল আলম থেকে জব্দ করা গাড়ির জরিমানা হিসেবে ৬ হাজার ২৫০ টাকা নেওয়ার নিয়ম থাকলেও সেখানে অতিরিক্ত ৬ হাজার টাকা দাবি করেন সার্জেন্ট সুমন। ফলে সুমনের অতিরিক্ত টাকার বিষয়টি জানতে চান পরিবহন শ্রমিক নেতা মো. ইউসুফ।

এ সময় ইউসুফ ভেতরে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে অতিরিক্ত টাকা না নিতে অনুরোধ করেন সার্জেন্ট সুমন উদ্দিনকে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ইউসুফের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন তিনি। এরপর সকাল ১১টা থেকে ইউসুফকে দুপুর পৌনে ৩টা পর্যন্ত দপ্তরের ভেতর অন্যায়ভাবে অবরুদ্ধ করে রাখেন সুমন। ওইসময় সুমনসহ পুলিশ কনস্টেবল মুসলিম নিজেদের বর্তমান সরকারের সড়ক ও পরিবহন মন্ত্রীর লোক হিসেবে পরিচয় দিয়ে ইউসুফকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ তাৎক্ষণিক গুম করার হুমকি দেন। চার ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখার পর ৬ হাজার ২৫০ টাকা নিয়ে জব্দ করা গাড়িটি ছেড়ে দেওয়ার অনুমতির ব্যবস্থা করেন সার্জেন্ট সুমন।

মামলার বিবরণে আরও জানা গেছে, ভুক্তভোগী মো. ইউসুফকে দীর্ঘ চার ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখার পর ৭-৮ জন সোর্সদের হাতে তুলে দেন সুমন। ওইসময় তাকে বাইরে নিয়ে গিয়ে ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে ওই কথিত সোর্সরা। চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় ইউসুফকে সার্জেন্ট সুমন উদ্দিনের কথা মতো এলোপাতাড়ি লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে হাত-পা সহ শরীরের বিভিন্ন অংশে মারাত্মক জখম করা হয়। মারধরের সময় ইউসুফের চিৎকারে আশপাশের লোকজন ও মামলার সাক্ষী সবুর উদ্ধার করতে এগিয়ে আসলে তাদেরও মারধর করা হয়। এতে আবদুর সবুর নামে ওই পরিবহন শ্রমিক নেতা আহত হন।

উদ্ধারের পর ইউসুফ ও আবদুর সবুরকে প্রথমে ডবলমুরিং থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সেখান থেকে দু’জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।

মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে সিএমপি বন্দর ট্রাফিক পুলিশের (প্রসিকিউশন) সার্জেন্ট মো. সুমন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি মামলার বিষয়টি শুনেছি।’

নিয়ম বহির্ভূত অর্থ আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করেন।

এদিকে সার্জেন্ট সুমন প্রতিবেদকের পরিচয় যাচাই করেন দৈনিক আজাদী পত্রিকার ফটো সাংবাদিক অনুপম বড়ুয়ার কাছে। অনুপম বড়ুয়াকে মুঠোফোন নম্বরে বার্তা লিখেন সার্জেন্ট সুমন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ‘দাদা, কল আসছিল, দৈনিক আজাদীর পরিচয় দিয়েছে, নাম নাকি আজাদ।’

তবে প্রতিবেদকের সঙ্গে পূর্বপরিচয় থাকায় কল দিয়ে বিষয়টি প্রতিবেদককে জানান অনুপম বড়ুয়া।

এছাড়া সার্জেন্টের পক্ষে পাঠানো স্ক্রিন শর্টটিও প্রতিবেদকের সংরক্ষণে রয়েছে।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে অনুপম বড়ুয়া বলেন, ওই সার্জেন্ট আপনার নাম আজাদ শুনে হয়তো ভেবেছেন আজাদী পত্রিকার কেউ—এটা হতে পারে।’

প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার চালানোর বিষয়টি জানতে আবারও মুঠোফোনে কল করা হয় সাজের্ন্ট মো. সুমন উদ্দিনকে। এই প্রসঙ্গে সার্জেন্ট সুমন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি এই রকম বলিনি। গত শুক্রবার (৩ মে) আপনার সঙ্গে আমার কি কথা হয়েছিল, শুরুতে তার রেকর্ড খুঁজে দেখার অনুরোধ রইল। ঠিকঠাকভাবে না শুনে এই রকম মিথ্যা বলা কতটুকু ন্যায় সঙ্গত?’

মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে বাদি মো. ইউসুফ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ঘটনার দিন আমি জব্দ করা গাড়ির চালক নুরুল আলমসহ সেখানে গিয়েছিলাম গাড়ি ছাড়াতে। ঘটনার একপর্যায়ে আমাকে প্রসিকিউশন দপ্তরের ভেতরে ডেকে নিয়ে যান সার্জেন্ট সুমন। সেখানে কথা বলার এক পর্যায়ে হঠাৎ করে পুলিশ কনস্টেবল মুসলিম আমার সঙ্গে সার্জেন্ট সুমনের কথার প্রসঙ্গ নিয়ে উচ্চ স্বরে বলেন, সুমন স্যার এবং আর আমি সড়ক ও পরিবহন মন্ত্রীর এলাকার লোক। শ্রমিক নেতা চেনার সময় নেই। যা চাইছে তা দিয়ে গাড়ি নিয়ে যান এবং তিনি হুমকি দেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘পরে দীর্ঘ পৌনে চার ঘণ্টা আমাকে প্রসিকিউশন দপ্তরে অবরুদ্ধ করে রাখেন সার্জেন্ট সুমন। গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার সব ঠিক করে দিয়ে তাদের কথিত সন্ত্রাসী সোর্সদের হাতে আমাকে তুলে দেন সার্জেন্ট সুমন। সন্ত্রাসীরা আমার নিয়ে গিয়ে ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি তুলে আমার ওপরে নির্যাতন চালায়। খবর পেয়ে আমাকে উদ্ধার করতে আসায় আবদুর সবুর নামে সংগঠনের এক নেতাকে তারা মেরেছে। উদ্ধারের পর ওইদিনই সরাসরি থানায় গিয়েছিলাম। মামলা না নেওয়ায় আদালতে মামলা দায়ের করেছি। আমার বক্তব্য একটাই, আমি ন্যায় বিচার চাই। ঘুষখোর অফিসার সার্জেন্ট সুমন ও কনস্টেবল মুসলিমের শাস্তি দাবি করছি।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!