৭৭১ তরুণী এক ফেসবুক প্রতারকের জালে, রাষ্ট্রপতি থেকে ওসি কেউই রেহাই পাননি

মেয়েদের আইডি উদ্ধারের নামে আরেক প্রতারণা

চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় কর্মরত সাবেক ওসি মোহাম্মদ মহসিন। বর্তমানে আছেন ঢাকার তেজগাঁও থানার ওসির দায়িত্বে। ফেসবুকে তার ভুয়া আইডি খুলে করা হচ্ছিল নানা অপকর্ম। কখনও বিভিন্ন মেয়ের সঙ্গে চ্যাট, কখনও বা আপত্তিকর কথা ও ছবি বিনিময়, আবার কারও কাছ থেকে দাবি করা হচ্ছিল টাকাও। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এসব অপকর্মের সমাপ্তি ঘটলো এবার। ওসি মহসিন সেজে প্রতারণা করে আসা সেই ভুয়া আইডির মালিক ধরা পড়লো এবার পুলিশেরই জালে।

গ্রেপ্তার যুবকের নাম মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন (৩০)। তিনি গাইবান্ধার স্থানীয় একটি প্রিন্টিং প্রেসে সহকারী হিসেবে কাজ করেন।

শুক্রবার (২৬ জানুয়ারি) গাইবান্ধার সদর থানা এলাকার ইসলাম প্রিন্টিং প্রেস নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতারক আনোয়ারকে গ্রেপ্তার করে তেজগাঁও থানা পুলিশ।

জানা গেছে, বেশ কয়েক বছর ধরে ওসি মহসিনের ফেসবুকের অনুরূপ একটি ফেসবুক একাউন্ট খোলেন আনোয়ার। এরপর সত্যিকারের ওসি মহসিনের প্রতিটি ছবি ও ভিডিও অবিকলভাবে নকল ওসি মহসিনের আইডিতে ব্যবহার করতেন তিনি। আর এক সময় গিয়ে নকল আইডিটিও দেখতে আসল আইডিটির মতো হয়ে যাওয়ায় সেই আইডি দিয়ে প্রতারণা চলছিল একের পর এক।

জানা গেছে, মাত্র পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন প্রতারক আনোয়ার। তবে ফেসবুক সম্পর্কে ভালো ধারণা ছিল তার। স্থানীয় কারও ফেসবুক সংক্রান্ত সমস্যা হলেই সবাই ধরনা দিতো আনোয়ারের কাছে। স্থানীয়ভাবে তার পরিচিতিই হয় ‘ফেসবুকের মাস্টার’ হিসেবে।

৭৭১ তরুণী এক প্রতারকের জালে
পুলিশের জালে ধরা পড়ার পর বেরিয়ে আসে, ওসি মহসিনের ফেইক আইডি ব্যবহার করে আনোয়ার ৭৭১ জন মেয়ের সাথে যোগাযোগ রাখতেন। আর সেই যোগাযোগ কখনো প্রেমের, কখনো যৌনতার আবার কখনো টাকা লেনদেনে রূপ নেয়।

ঢাকার তেজগাঁও থানার ওসির দায়িত্বে থাকা ওসি মহসিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে সে আমার নামে ভূয়া আইডি চালিয়ে আসলেও কিছুদিন আগে বিষয়টি নজরে আসে। তাই গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর মিরপুর মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করি। এরপর চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি আমি নিজে বাদি হয়ে তেজগাঁও থানায় সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা করি।’

তিনি বলেন, আনোয়ারের প্রতারণার হাত থেকে রেহাই পাননি স্বয়ং রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে এমপি, নেতা, সিনেমার প্রযোজক, নায়কসহ কেউই।

আনোয়ারের ভুয়া আইডির মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রপতি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রী নসরুল হামিদ, চিত্রনায়ক শান্ত খান, অভিনেতা আব্দুন নুর সজল ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ছাড়াও আরও অনেকে। তবে আইডিগুলোর মধ্যে নসরুল হামিদ ও তারেক রহমানের আইডিটি বর্তমানে ডিজঅ্যাবল অবস্থায় রয়েছে।

নায়িকা বানানোর ধান্ধা
চাঁদপুর জেলার সদর উপজেলার ১০ নং লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিম খানের নামে একটি ভুয়া ফেসবুক আইডি খোলেন আনোয়ার। ওই আইডিতে নিজেকে চলচ্চিত্র প্রযোজক হিসেবে দাবি করেন তিনি। সেই পরিচয় দেখেই তার সাথে বিভিন্ন মেয়ে ম্যাসেঞ্জারে কথা বলেন। মূলত নায়িকা হওয়ার জন্যই তারা যোগাযোগ করতেন। তারা ম্যাসেঞ্জারে সেলিম খান মনে করে আনোয়ারকে বিভিন্ন অনুরোধ জানান। আনোয়ারও এসব মেয়ের সরলতার সুযোগ নিতেন। তিনি নায়িকা বানানোর আশ্বাস দিয়ে তাদেরকে ছবি পাঠাতে বলেন। ছবি দেখে যেসব মেয়ে সুন্দরী, আনোয়ার তাদেরকে নায়িকা বানানোর আশ্বাস দিয়ে দিনের পর দিন কথা চালাতে থাকেন। এক পর্যায়ে গিয়ে কোন কোন মেয়ে নিজেরাই যোগাযোগ বন্ধ করে দিত। আর মাঝে মাঝে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে আনোয়ার নিজেই কোন কোন মেয়েকে ব্লক করে দিতেন। আর বাকিদের আরও স্লিম হতে হবে, স্মার্ট হতে হবে ইত্যাদি বলে এড়িয়ে যেতেন।

মেয়েদের আইডি উদ্ধারের নামে আরেক প্রতারণা
ভুয়া একাউন্ট খুলে প্রতারণাই শুধু নয়, মানুষের আইডি হ্যাক করতেও বিশেষ পারদর্শী ছিলেন আনোয়ার। কারও ফেসবুক আইডি, পাসওয়ার্ড হারিয়ে গেলে তা উদ্ধার করে দিতেন তিনি। এজন্য তার কাছে বিভিন্ন মেয়েরা আইডি-পাসওয়ার্ড উদ্ধারের জন্য যোগাযোগ করতেন। কিন্তু যেসব আইডি তিনি উদ্ধার করে দিতেন সেসব আইডিই আনোয়ারের হয়ে যেত! আনোয়ার বিশেষ একটি কৌশল অবলম্বন করতেন, যার ফলে পরবর্তীতে ওই আইডি আনোয়ারের কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে যেত। পরে আনোয়ার সে আইডিই ব্যবহার করতেন। এসবের মধ্যে যেসব আইডি একটু পুরাতন হয়েছে, সেসব আইডির নাম পরিবর্তন করেই গণ্যমান্য ব্যক্তির নামে ভুয়া আইডি খোলেন। এসব ভুয়া আইডি রিপোর্ট করে বন্ধ করলেও কিছুদিন পর আবারও তা ‘রিকভার’ করে ফেলেন আনোয়ার।

নায়ক যখন গাইবান্ধার হেলপার
গাইবান্ধার স্থানীয় একটি প্রিন্টিং প্রেসে মেশিনের হেলপার হিসেবে আনোয়ার চাকরি করেন। কিন্তু তিনি ফেসবুকে শত শত মেয়ের সাথে কথা বলেন চলচ্চিত্র নায়ক শান্ত খান ও আব্দুন নুর সজল সেজে। এই দুই অভিনেতার নামেও ভুয়া আইডি খোলেন আনোয়ার। সেই আইডি থেকে বিভিন্ন মানুষের স্ট্যাটাসে কমেন্ট করেন তিনি। আর ম্যাসেঞ্জারে বিভিন্ন মেয়ের সাথে চ্যাট করেন। মেয়েরাও অভিনেতা শান্ত ও সজল মনে করে তাদের সাথে কথা বলেন।

এরকম আরও নানাভাবে প্রতারণা করে মানুষের থেকে টাকা হাতিয়ে নিতেন আনোয়ার। পুলিশের জালে ধরা পড়ে আপাতত সেই প্রতারণার ইতি ঘটতে যাচ্ছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!