জিম্মি জাহাজে ‘অভিযানে’ নারাজ মালিকপক্ষ ও সরকার, যুদ্ধজাহাজের আনাগোনায় জলদস্যুরা ভীত

সোমালিয়ার পুলিশ ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশের নৌবাহিনীর সদস্যরা একযোগে জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’কে উদ্ধারে অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নেওয়ার খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও এ সম্পর্কে কিছু জানে না জাহাজটির মালিকপক্ষ। ইউরোপীয় নৌবাহিনীর একটি জাহাজ এবং ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি যুদ্ধজাহাজ উদ্ধার অভিযান শুরুর অনুমতি চাইলেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এতে সম্মতি দেয়নি। জাহাজটির মালিকপক্ষ কবির গ্রুপের কর্মকর্তারা বলছেন, নাবিকদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনাই তাদের প্রথম অগ্রাধিকার। জাহাজে থাকা নাবিকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে— এমন যে কোনো তৎপরতা বা অভিযানের বিরোধী তারা।

সোমালিয়ায় জিম্মি হওয়া ‘এমভি আবদুল্লাহ’র মালিকপক্ষ চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগ্রুপ কবির গ্রুপের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নাবিক ও ক্রুদের নিরাপদে তারা দেশে ফিরিয়ে আনতে চান। এজন্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মেরিটাইম সেইফটি ফোর্স ও ভারতীয় নৌবাহিনীর দেওয়া সশস্ত্র উদ্ধার অভিযানের প্রস্তাব তারা আগেই ফিরিয়ে দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে উদ্ধার অভিযানের প্রস্তুতির কথা বলা হলেও সে সম্পর্কে তারা কিছুই জানেন না।

জলদস্যুরা কেন মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে এতো সময় নিচ্ছে— এমন প্রশ্নের উত্তরে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘তারা হয়তো সময়ক্ষেপণ করে দরকষাকষির একটি ক্ষেত্র তৈরি করার চেষ্টা করছে।’

যুদ্ধজাহাজ এখন আরও কাছাকাছি

এদিকে ‘এমভি আবদুল্লাহ’কে ঘিরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মেরিটাইম সেইফটি ফোর্স ও ভারতীয় নৌবাহিনীর তৎপরতার মুখে জিম্মি জাহাজটিকে উপকূলের আরও কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে নাবিকদের দেওয়া তথ্যে জানা গেছে। অন্তত চারবার অবস্থান বদলে সোমালিয়ার গোদোব জিরান উপকূল থেকে এখন মাত্র দুই নটিক্যাল মাইল দূরে নোঙর করানো হয়েছে ‘এমভি আবদুল্লাহ’কে। অন্যদিকে নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজগুলো এখন গোদোব জিরান উপকূল থেকে মাত্র চার নটিক্যাল মাইল দূরে রয়েছে বলে জানা গেছে। এমন কাছাকাছি অবস্থানে জলদস্যুদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে বলে নাবিকরা জানাচ্ছেন। এর ফলে আবার নাবিকদের ওপরও নানাভাবে চাপ বাড়াচ্ছে জলদস্যুরা।

অবস্থান বদল বারবার

গত ১২ মার্চ দুপুর দেড়টার দিকে ভারত মহাসাগর দিয়ে দুবাইয়ের দিকে যাওয়া কবির গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’র নিয়ন্ত্রণ নেয় সোমালিয়ান দস্যুরা। এতে রয়েছেন ২৩ জন বাংলাদেশি নাবিক ও ক্রু। সোমালিয়া উপকূল থেকে প্রায় ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থানরত জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নিতে মাত্র ১৫ মিনিট লাগে জলদস্যুদের। মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই বন্দরে যাচ্ছিল জাহাজটি। ১৪ মার্চ দুপুরে সোমালিয়ার গারাকাদ উপকূলের হোবিও বন্দরে যাওয়ার পর জলদস্যুদের নতুন একটি দল ‘এমভি আবদুল্লাহ’র নিয়ন্ত্রণ নেয়। এর পর থেকে ‘এমভি আবদুল্লাহ’ জাহাজটির অবস্থান বারবার বদল করছে জলদস্যুরা। ১৪ মার্চ থেকে অন্তত চারবার স্থান বদল করেছে এমভি আবদুল্লাহ।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এমভি আবদুল্লাহকে বর্তমানে সোমালিয়ার গোদোব জিরান উপকূল থেকে মাত্র দুই নটিক্যাল মাইল দূরে নোঙর করানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, কোনো দেশের স্থলভাগ থেকে ১২ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে ভিন্ন দেশের জাহাজ ঢুকতে বা অভিযান পরিচালনা করতে সেই দেশের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আবার জিম্মি হওয়া জাহাজ যে দেশের মালিকানাধীন, সেই দেশেরও অনুমতি নিতে হয়।

এর আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব খুরশেদ আলম জানিয়েছিলেন, ১৪ মার্চ ইউরোপীয় ইউনিয়নের মেরিটাইম সেইফটি এজেন্সি নাবিকদের উদ্ধারে অভিযান চালানোর প্রস্তাব দিলেও নিরাপত্তার কথা ভেবে ওই প্রস্তাবে সরকার ও মালিকপক্ষ রাজি হয়নি।

নাবিকদের নিরাপত্তাই প্রথম অগ্রাধিকার

জাহাজটির মালিক প্রতিষ্ঠান কবির গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘এমভি আবদুল্লাহকে উদ্ধারে কোনো ধরনের অভিযানের কথা আমাদের জানা নেই। কোনো ধরনের সামরিক পদক্ষেপকে সমর্থন করি না আমরা। কারণ ২৩ জন নাবিক ও ক্রুর জীবন বিপন্ন করে যে কোনো অভিযানের বিপক্ষে আমরা। এছাড়া বাংলাদেশ সরকারের সুস্পষ্ট বার্তা হচ্ছে, কোনো ধরনের সহিংস অভিযান পরিচালনা করা যাবে না।’

তিনি বলেন, ‘আমরা চাই, শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির সমাধান করতে। অতীত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নাবিকদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনাই আমাদের মূল লক্ষ্য।’

দৈনন্দিন কাজের অনুমতি, কয়লা নিয়ে শঙ্কা কমলো

এদিকে সোমালিয়ায় জিম্মি ‘এমভি আবদুল্লাহ’র নাবিকদের জাহাজের ডেক এবং ইঞ্জিন রুমে দৈনন্দিন কাজ করার অনুমতি দিয়েছে জলদস্যুরা। এর ফলে জাহাজে থাকা ৫৫ হাজার মেট্রিক টন কয়লার তাপমাত্রা বেড়ে বিস্ফোরণের আশঙ্কা অনেকটাই কমেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

এর আগে জাহাজটির প্রধান কর্মকর্তা মো. আতিকউল্লাহ খান জানিয়েছিলেন, জাহাজটি একটু ঝুঁকিপূর্ণ কার্গো। জাহাজে থাকা ৫৫ হাজার মেট্রিক টন কয়লার কারণে এটার মিথেনের ঘনত্ব বাড়তে থাকে। সর্বশেষ অক্সিজেন-লেভেল ৯–১০ শতাংশ ছিল। এটা নিয়মিত আপডেট করতে হয়। বেড়ে গেলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ প্রয়োজন হবে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!