চট্টগ্রামে অপহরণের ঘটনা নিয়ে নাটকে মেতেছে পুলিশ, ‘এসপি-ডিআইজির নির্দেশে’ আসামি ছেড়ে আবার আটক

চট্টগ্রামের আনোয়ারায় এক গার্মেন্টসকর্মীকে অপহরণের ঘটনায় নানা নাটকীয়তার পর তিন আসামিকে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ। তবে ভুক্তভোগীর স্ত্রীসহ স্বজনদের সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেওয়ার পর এক আসামিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

এর আগে গার্মেন্টসকর্মীকে অপহরণের ঘটনায় অপহৃতের স্ত্রীর মামলা নিতে গড়িমসি করে পুলিশ। পরে অপহৃতের শ্যালক অংশু নাথকে বাদি করে মামলা নেয় পুলিশ। মামলার পর অভিযান চালিয়ে চার আসামিকে গ্রেপ্তার ও অপহৃত ব্যক্তিকে উদ্ধার করা হয়। কিন্তু ওই চার আসামিকে ছেড়ে দেয় পুলিশ।

এ ঘটনায় সোমবার (১৮ মার্চ) দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনের ভিডিও ভার্সনে ‘অপহৃত সুমনকে উদ্ধারে পুলিশের দৌড়ঝাপের ইতি ৪ অপহরণকারীকে ছেড়েই’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ হলে নড়েচড়ে বসে আনোয়ারা থানার পুলিশ। আবারও চার আসামিকে গ্রেপ্তার করে তারা। এর মধ্যে ভুক্তভোগীর স্ত্রী ঝুমি দেবী আদালতে গিয়ে মামলা করেন। সেই মামলার তদন্তভার যায় পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) হাতে।

অপহৃত গার্মেন্টসকর্মীর নাম সুমন নাথ (৪০)। তিনি কোরিয়ান ইপিজেডে চাকরি করেন।

মামলার চার আসামি হলেন চন্দনাইশের উত্তর বরকল এলাকার মো. সোলাইমানের ছেলে মো. ফারুক হোসেন (৩৫), শাহ আলমের ছেলে বদিউল আলম (২৬), জামাল আহম্মদের ছেলে মো. সোহান (২২), মফিজুর রহমানের ছেলে মো. সাইফুদ্দিন (২৪)। এদের গ্রেপ্তার করা হলেও পরে পুলিশ সাইফুদ্দিনকে ছেড়ে দেন।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, ভিকটিম সুমন নাথ আনোয়ারা থানার কেইপিজেডের গার্মেন্টসের চাকরিজীবী। এক নম্বর আসামি ফারুক হোসেনের সঙ্গে তার ব্যবসার লেনদেন ছিল।

গত ১৪ মার্চ দুপুরে চিকিৎসার জন্য আনোয়ারা উপজেলার চাতরী-চৌমুহনী যান। ওখানে আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা এজাহারভুক্ত চার আসামিরা জোর করে সুমন নাথকে তুলে নিয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করার পর না পেয়ে পরে তার মোবাইল নম্বরে কল দিলে অপহরণের বিষয়টি জানা যায়।

এসময় মুক্তিপণ হিসেবে অপহরণকারীরা ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। টাকা না দিলে ভিকটিমকে খুন করে লাশ গুম করার হুমকি দেন। পরে ভিকটিমের পরিবার ও তার শালা অংশু নাথ বিষয়টি পুলিশকে জানায়। ওইদিন রাতেই আনোয়ারা থানা পুলিশ তথ্য প্রযুক্তি সহায়তায় চন্দনাইশের মৌলভীবাজার এলাকার একটি ঘর থেকে ভিকটিমকে উদ্ধার করে।

ভিকটিমের স্ত্রী ঝুমি দেবী বলেন, আমার স্বামী গত বৃহস্পতিবার দুপুরে চাতরী-চৌমুহনী বাজারে ওষুধ আনতে যান। বিকাল ৫টার দিকে কারা জানি ফোন করে বলে, তারা আমার স্বামীকে অপহরণ করেছে। তাকে জীবিত চাইলে ৫ লাখ টাকা দিতে হবে।

এ ঘটনায় ঝুমি দেবী তাৎক্ষণিক আনোয়ারা থানায় একটি এজাহার দেন। পরে পুলিশ অপহরণের ৪ ঘণ্টার মধ্যে চন্দনাইশের বরকলে অভিযান চালিয়ে ৪ অপহরণকারীকে গ্রেপ্তার করে এবং ভিকটিমকে উদ্ধার করেন। কিন্তু মধ্যরাতে আসামিদের সঙ্গে ‘রফাদফা’ করে রাতেই অপহরণকারীদের ছেড়ে দেওয়ার খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় বলে জানা গেছে।

ঝুমি দেবী দাবি করেন, ওই অপহরণের ঘটনায় ভিকটিমের পরিবার এজাহার দিলে তখনও পুলিশ মামলা নেয়নি। উল্টো বাদিকে হুমকি দিয়ে খালি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে আসামি ছেড়ে দেওয়া হয়।

ঘটনার দিন রাতে আনোয়ারা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ মহিউদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, সুমন নাথকে অপহরণের পর পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয়। পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৪ অপহরণকারীকে আটক করেন। এ ঘটনায় থানায় মামলা প্রক্রিয়াধীন।

কিন্তু ঘটনার একদিন পর ভিকটিমের স্ত্রী ঝুমি দেবীর দেওয়া এজাহার পাল্টে যায়। আগের এজাহার আর নতুন করে মামলা নেওয়ার এজাহারের সঙ্গে কোনো মিল ছিল না। এমনকি পুলিশ ভিকটিমের স্ত্রী ঝুমি দেবীকে মামলার বাদিও রাখেননি। এর পরিবর্তে সুমন নাথের শ্যালক অংশু নাথকে বাদি করে থানা মামলা নেওয়া হয়। ওই মামলায় মো. ফারুক হোসেন, বদিউল আলম ও মো. সোহানকে গ্রেপ্তার দেখানো হলেও মো. সাইফুদ্দিনকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

আসামি ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে ঝুমি দেবী জানান, পুলিশ তার স্বামীকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসলেও মামলা হবে বলে রাতে তাকে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু রাত ৩টার দিকে পরিদর্শক (তদন্ত) আবারও তাকে বাড়ি থেকে থানায় আনেন। এরপর অপহরণকারীদের ছেড়ে দেয় এবং সাদা স্ট্যাম্পে তাদের স্বাক্ষর নেয়।

ভুক্তভোগী সুমন নাথের স্ত্রী ঝুমি দেবীর এজাহার না নেওয়ায় তিনি আদালতে মামলা করেন। সেখানে তিনি ওই চারজনকেই আসামি করেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাদির আইনজীবী আবু মো. ইউনুস ভুইয়া রোকন বলেন, ভিকটিমের স্ত্রী দায়ের করা মামলাটি আদালত আমলে নিয়ে পিবিআইকে তদন্ত করতে দিয়েছেন।

এ বিষয়ে আনোয়ারা থানার ওসি সোহেল আহাম্মদ বলেন, অপহরণের অভিযোগে মামলা হয়েছে। তিন আসামিকে কোর্টে পাঠানো হয়েছে। বাকিটা তদন্তে জানা যাবে।

সাইফুদ্দিনকে ছেড়ে দেওয়া এবং ভুক্তভোগীর স্ত্রীর এজাহার না নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো কথাই বলতে রাজি হননি ওসি সোহেল। তবে এই প্রসঙ্গে পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ওইসময় বলেন, বাদির জিম্মায় আসামিদের ছেড়ে দিয়েছিলাম। দেন-দরবার করে ছেড়ে দিয়েছি, তাতে কি হইছে? ওসি স্যারের নির্দেশে ছাড়ছি, এসপির স্যারের নির্দেশে ছাড়ছি, ডিআইজি স্যারের নির্দেশে ছাড়ছি। পরে বাদি-বিবাদি বসে সমাধান করবে। যেহেতু ঘটনাটি লেনদেনের।

এ প্রসঙ্গে সহকারী পুলিশ সুপার (আনোয়ারা সার্কেল) সোহানুর রহমান সোহাগ বলেন, অপহরণের অভিযোগে ভিকটিমের শ্যালক একটি মামলা করেছেন। মামলাটির তদন্তাধীন।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!