চট্টগ্রাম কাস্টমসে টাকা হাতানোর চক্রে চার কর্তা, ফ্ল্যাট-প্লটও কিনেছেন একসঙ্গে

পণ্য খালাসের নামে বড় বাণিজ্য

তারা চারজনই কাস্টমস কর্মকর্তা। এর মধ্যে একজন ছাড়া বাকি তিনজনই বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন। আর্থিক সুবিধা নিয়ে কাস্টমসে আটকে থাকা পণ্য ও মালামালগুলো ছাড়ান তারা। তাদের টার্গেট ব্যবসায়ী ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট। বিভিন্ন সোর্সদের মাধ্যমে কব্জায় ফেলে তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন টাকা। কিন্তু চক্রটির কথা মতো পণ্য খালাস কাজ করতে পারলেও অধিকাংশ ব্যবসায়ী ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা উল্টো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

এদিকে কাজ করতে না পারলে আর্থিক লেনদেনের অংক আর ফেরতও দেন না তারা। এতে আর্থিক ও মালামালের দিক থেকেও ক্ষতি হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এভাবে তারা গড়েছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়।

এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে গত ৮ নভেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান বরাবরে সাবেক ও বর্তমান চার কর্মকর্তার নামে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ দিয়েছে ‘ফেয়ার অ্যান্ড সন্স কোম্পানি লিমিটেড’র ইসতিয়াক আহমেদ রেজা নামের ব্যবসায়ী।

অভিযুক্তরা হলেন কাস্টম হাউস চট্টগ্রামের গেইট ডিভিশনের রাজস্ব কর্মকর্তা (আরও) মো. ছাইফুল ইসলাম, কাস্টমস এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট কমিশনারেট ঢাকার (পূর্ব) রাজস্ব কর্মকর্তা তৈয়বুর রহমান, কাস্টমস এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট সার্কেল জামালপুরের রাজস্ব কর্মকর্তা আব্দুস ছামাদ এবং কাস্টমস এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট মানিকগঞ্জের সাবেক সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ভূঁঞা মফিজুর রহমান।

অভিযোগ বিবরণীতে বলা হয়, এক ব্যবসায়ীর একগুচ্ছ কৃষি ও মেশিনারিজ পণ্য দীর্ঘদিন কাস্টমসে আটকে থাকায় ক্ষতির মুখোমুখি হন ওই ব্যবসায়ী। ২০২৩ সালের আগস্টের শেষের দিকে অভিযুক্তদের চারজনের চক্রের একজন ওই পণ্যগুলো খালাস করে দিতে ২৫ লাখ টাকা নেন ওই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে। পরে অর্থ ফেরত না দিয়ে দীর্ঘদিন সময়ক্ষেপণ করেন এবং পণ্য খালাসেও ব্যর্থ হন তারা। সম্প্রতি ওই ব্যবসায়ীর পণ্যগুলো নিলামে তুলে কাস্টমস।

এর আগে দেশের সীমান্ত এলাকায় কাস্টমসের দায়িত্ব পালনকালে বিভিন্ন সময়ে আটককৃত স্বর্ণেরবার জব্দ করার পর সেগুলো কর্তৃপক্ষকে কিছু অংশ জমা দিয়ে বাকিগুলো গায়েব করে ফেলতেন। চক্রটির টার্গেট নিরীহ সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও ব্যবসায়ীরা। অনিয়মের মাধ্যমে আয় থেকে চক্রটির প্রত্যেকেই বেশিরভাগই সম্পদ কিনেছেন একসঙ্গে।

জানা গেছে, ইতোপূর্বে তাদের পণ্য খালাসের ফাঁদে পড়েছেন অনেক ব্যবসায়ী। তারা নামে একাধিক অভিযোগ দুদক কমিশন বরাবরে গেলেও একটিও অনুসন্ধানের মুখ দেখেনি।

চার কর্মকর্তার একত্রে কেনা সম্পদ
যৌথ অংশীদারে কিনা ঢাকার দক্ষিণ খান ফয়দাবাদ মৌজায় মসজিদ রোডে পাঁচ কাঠার জায়গার ওপরে তারা নির্মাণ করেছে সাত তলা ভবন। জমি ও ভবনের বর্তমান বাজারমূল্যে প্রায় ৬ কোটি টাকা। একই মৌজায় ৫ কাঠা জায়গা নিয়ে করেছেন গরুর ফার্ম। ওই ফার্মে বর্তমানে ১০টি গরু রয়েছে। যেগুলোর মূল্যে প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ টাকা। একই এলাকায় বায়তুর রউফ জামে মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় রয়েছে ১৫ কাঠা জায়গা, যার মূল্যে সাড়ে ৭ কোটি টাকা। ওই সম্পত্তির হোল্ডিং ট্যাক্স রশিদের অভিযুক্ত সাবেক ও বর্তমান চার কাস্টমস কর্মকর্তার নাম রয়েছে। ওই এলাকায় লাল মসজিদের পশ্চিম গলিতে ১০ কাঠা জায়গায় রয়েছে। জায়গাটি বর্তমানে গাছ-লতাপাতায় আবৃত অবস্থায় রয়েছে।

চারজনের নামে ফ্ল্যাট
ঢাকা উত্তরায় চারজনরে নামে-বেনামে রয়েছে প্রায় দুই কোটি টাকার মূল্যের একেক জন থেকে ৩ থেকে ৫টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এছাড়া ঢাকা দক্ষিণ ফাইদাবাদ এলাকায় পুলিশ ফাঁড়ির সংলগ্নে তৈয়বুর রহমান ও তার পরিবারের নামে রয়েছে চারটি ফ্ল্যাট। এর মধ্যে একটি ফ্ল্যাট তার মেয়ের জামাইকে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়।

পৃথকভাবে সম্পদের উৎস
ঢাকার দক্ষিণ ফাইদাবাদ এলাকায় বাইতুর রউফ জামে মসজিদের পাশে ১২ কাঠার একটি প্লট ক্রয় করেন চারজন। সেখানে আলাদাভাবে তিন কাঠার একটি প্লট ক্রয় করেন আব্দুস ছামাদ। বর্তমানে ওই এলাকায় প্লটের কাঠা প্রতি বিক্রয় হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা। তার বড় মেয়ে সুমি আকতার ও ছেলের নামেও রয়েছে জায়গা। তার স্ত্রী পারভীর আক্তার নামে রয়েছে কয়েক কোটি টাকার ব্যাংক ব্যালেন্স।

এছাড়া ছাইফুল ইসলামের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার বিদ্যালয়ের মোড়ে রয়েছে ৮ তলার একটি বিলাসবহুল বাড়ি। যার অংশীদার হিসেবে রয়েছেন অভিযুক্ত কর্মকর্তার নাম। বর্তমানে বাড়িটি জায়গাসহ বাজারমূল্যে প্রায় ৫ কোটি টাকা।

অভিযুক্ত চারজনই ৯ম-১০ম গ্রেডের কর্মকর্তা। ধাপে ধাপে পদোন্নতি বাগিয়ে প্রত্যেকে এখন রাজস্ব কর্মকর্তা। এর মধ্যে সম্প্রতি সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা থেকে মফিজুর রহমান অবসরে গেছেন। বাকি তিনজন বর্তমানে কাস্টমসে কর্মরত রয়েছেন। আব্দুস ছামাদের বাড়ি টাঙ্গাইল জেলায়। সেখানে তার নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের কাজ চলমান রয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কাস্টমস এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট সার্কেল জামালপুরের রাজস্ব কর্মকর্তা আব্দুস ছামাদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আপনি আপনার কাজ করুন। আমি আমার কাজ করছি। এই বিষয়ে আর বেশি কিছু বলতে চাই না।’

এ বিষয়ে জানতে কাস্টমস এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট কমিশনারেট ঢাকার (পূর্ব) রাজস্ব কর্মকর্তা তৈয়বুর রহমানকে মুঠোফোনে কল করা হলে রিসিভ করেন তার স্ত্রী। পরে প্রতিবেদককে তৈয়বুর রহমানের মুঠোফোন নম্বর হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাবেন জানিয়ে সংযোগ কেটে দেন। পরে নম্বর না পাঠালে আর বক্তব্য নেওয়া যায়নি।

কাস্টমসের চট্টগ্রামের গেট ডিভিশনের রাজস্ব কর্মকর্তা (আরও) মো. ছাইফুল ইসলাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘গত তিন মাস আগে কাস্টম হাউস থেকে গেট ডিভিশনের বদলি করা হয় আমাকে। আমি অসহায় মানুষ। এসব অভিযোগ মিথ্যা। অভিযোগ সম্পর্কে কিছুই জানি না।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!