চট্টগ্রাম কারা হাসপাতালে ফ্রিজিং ছাড়াই ইনজেকশন-ওষুধ, দেখতে গিয়ে সিভিল সার্জনও অবাক

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের হাসপাতালে নির্ধারিত তাপমাত্রায় ওষুধ সংরক্ষণ করা হচ্ছে না। হাসপাতালে কোনো ফ্রিজিংয়ের ব্যবস্থাও নেই। বন্দিদের জন্য সরকার বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ করলেও তা আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সংরক্ষণ হচ্ছে না। ফলে দামি ইনজেকশনসহ বিভিন্ন ধরনের ওষুধের গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে। আর এসব ওষুধ ও ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে হাসপাতালের রোগীদের।

চট্টগ্রাম কারা হাসপাতালে ফ্রিজিং ছাড়াই ইনজেকশন-ওষুধ, দেখতে গিয়ে সিভিল সার্জনও অবাক 1

এছাড়া কারা হাসপাতালে ২০১১ সাল থেকে বাক্সবন্দি অবস্থায় পড়ে আছে এক্স-রে, আলট্রাসাউন্ড, সিআর সেট কম্পিউটারাইজড রেডিওগ্রাফিসহ নানা মেশিন। ফলে হচ্ছে না রক্ত, প্রস্রাব, ডায়াবেটিকসসহ বিভিন্ন ধরনের রুটিন পরীক্ষা।

বুধবার (২০ ডিসেম্বর) সিভিল সার্জন ডা. মো. ইলিয়াছ চৌধুরী সরেজমিন পরিদর্শনে গেলে এসব অনিয়মের চিত্র ধরা পড়ে।

সিভিল সার্জন ডা. মো. ইলিয়াছ চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ হাসপাতালে টেকনিক্যাল সাপোর্ট নেই বললেই চলে। আমি ফ্রিজিংয়ের সমস্যা দেখেছি। এ বিষয়টি আমাকে রীতিমত অবাক করেছে। আমি সমস্যাগুলোর সমাধানের বিষয়ে একটা নীতিমালা তৈরি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। কারা অধিদপ্তরকেও পাঠাব।’

সিভিল সার্জন আরও বলেন, ‘এ হাসপাতালে কমপক্ষে ১০ জন চিকিৎসক, পাঁচজন নার্স ও দু’জন ল্যাব টেকনিশিয়ান প্রয়োজন। এছাড়া ফিজিওথেরাপি মেশিন ও ফিজিওথেরাপিস্ট কোনোটাই নেই। স্ট্রোকজনিত রোগে পক্ষাঘাতগ্রস্ত বন্দি রোগীও আছে, সেসব রোগীকে থেরাপি দেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। কারণ এসব রোগীর পক্ষে আদালতে গিয়ে মামলার হাজিরা দেওয়া সম্ভব হয় না।’

জানা গেছে, কারা হাসপাতালে চারজন অনুমোদিত চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে আছেন একজন। তাকেই প্রতিদিন হাসপাতালের বহির্বিভাগে অন্তত ২০০ থেকে ২৫০ জন আসামিকে সেবা দিতে হয়। রুটিন চেকআপের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও সেখানে নেই।

বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বলছেন, ওষুধ একটি সংবেদনশীল পণ্য। তাপমাত্রার কিছুটা হেরফের হলেই কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। দেশের বাজারে প্রচলিত ওষুধের প্রায় ৯০ শতাংশই ১৫ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। এসব ওষুধ ঠাণ্ডা ও শুকনা স্থানে এবং আলো থেকে দূরে রাখতে হয়। গরমের সময় দেশের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ২৮ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকলেও মাঝেমধ্যে তা ৪০ ডিগ্রিও অতিক্রম করে। এর প্রভাব সরাসরি পড়েছে ওষুধের ওপর। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই ওষুধের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

চট্টগ্রাম জেলার সাবেক ড্রাগ সুপার কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘হিট সেনসিটিভ প্রোডাক্টের মোড়কের গায়ে কত ডিগ্রি তাপমাত্রায় ওষুধ সংরক্ষণ করতে হবে, তা উল্লেখ থাকে। ওষুধ সেই তাপমাত্রাই রাখতে হবে। ডিসপেনসারি ওষুধের ক্ষেত্রে যে মাত্রায় রাখার কথা, তারচেয়ে বেশি তাপমাত্রায় রাখলে গুণগত মান কমে যাবে। এসব ওষুধ ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেনসিটিভের মধ্যে রাখতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘কিছু অতিসংবেদনশীল ওষুধ রয়েছে, যেগুলো তাপমাত্রা বাড়লেই নষ্ট হয়ে যায়। এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের হরমোন, অ্যান্টিবায়োটিক, ব্লাড প্রোডাক্ট আছে। এগুলো বায়োসিমিউলেশন প্রডাক্ট অর্থাৎ বায়োমলিকুলার ওষুধগুলো উচ্চ তাপমাত্রায় নষ্ট হয়ে যায়। বেশিরভাগ ওষুধই কেমিক্যাল প্রোডাক্ট।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী, ফার্মেসি, ওষুধ কারখানাসহ প্রতিটি স্তরে একইভাবে ওষুধ সংরক্ষণ করতে হবে। সেই হিসেবে সাধারণ স্টোরেজ বা সংরক্ষণের তাপমাত্রার পরিসীমা ১৫ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মোটা ওষুধভেদে সংরক্ষণযোগ্য তাপমাত্রার ধরনগুলো হলো ঘরের তাপমাত্রা (রুম টেম্পারেচার), শীতল (কুল স্টোরেজ), অতি শীতল (কোল্ড স্টোরেজ) ও হিমাঙ্কের নিচে (ফ্রিজ)। রুম তাপমাত্রা ওষুধের জন্য সাধারণ অবস্থা। বেশিরভাগ ওষুধ এ তাপমাত্রায় রাখা যায়। এ তাপমাত্রা জীবাণুর বৃদ্ধি ও রাসায়নিক বিক্রিয়াকে বাধা দেওয়ার জন্য আদর্শ। কিছু ওষুধ সংরক্ষণের জন্য হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রার প্রয়োজন পড়ে। এসব ওষুধ সংরক্ষণ করা হয় ২৫-৩৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা মাইনাস ৪ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।

চট্টগ্রাম কারা হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. সারোয়ার রেজা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ফ্রিজিংয়ের সমস্যা অনেক আগে থেকেই। আমি বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে অবগত করেছি। আজ (বুধবার) সিভিল সার্জন স্যারও বিষয়টি এসে দেখে গেছেন।’

এদিকে কারা হাসপাতালের ল্যাবে এক যুগ ধরে পড়ে আছে রোগীদের ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার বিভিন্ন মেশিন। রোগীদের সেবা দিতে এসব মেশিন প্রায় ১৯ কোটি টাকা খরচায় কেনা হলেও তা চালানোর মতো দক্ষ জনবল নেই হাসপাতালে। ফলে দীর্ঘদিন পড়ে থাকা মেশিনগুলো ধুলোর চাদরে ঢাকা পড়ে অকেজো হয়ে গেছে। এছাড়া হাসপাতালে রেডিওগ্রাফার নেই, কিন্তু এক্স-রে মেশিন কেনা হয়েছে। সনোলজিস্ট নেই, কিন্তু আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন কেনা হয়েছে। এখানে পড়ে আছে অ্যানালাইজার মেশিন, অটোক্লেভ মেশিন আরও অনেক কিছু।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!