চট্টগ্রামে পণ্য খালাসে লাইটার জাহাজে নৈরাজ্য, খালাস বন্ধে দিনে ২৪ লাখ টাকা গচ্চা ব্যবসায়ীদের

চট্টগ্রাম বন্দরের আওতাধীন বহির্নোঙরে আমদানি করা পণ্য খালাসে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে ব্যবসায়ী ও লাইটার জাহাজ মালিকদের। আমদানি পণ্যের খালাস ঠিক সময়ে করতে না পারায় প্রতিদিন বড় অঙ্কের টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। একদিন পণ্য খালাস বন্ধ থাকলে বাড়তি ভাড়া হিসেবে আমদানিকারক ব্যবসায়ীকে গুনতে হচ্ছে ২০ হাজার মার্কিন ডলার, বাংলাদেশের টাকায় যা প্রায় ২৪ লাখ টাকা। ফলে বেড়ে যায় আমদানি করা পণ্যের দাম, আর বাড়তি দামের বোঝা এসে পড়ে ভোক্তার ঘাড়ে।

একইসঙ্গে পণ্য খালাসের কাজ না পেয়ে লাইটার জাহাজ মালিকদের শ্রমিকের মজুরি ও জাহাজের দৈনন্দিন ব্যয় চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এসবের জন্য লাইটার জাহাজ মালিকরা দুষছেন বাংলাদেশ শিপ হ্যান্ডলিং ও বার্থ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যানকে। তার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ চট্টগ্রাম বন্দরসহ বিভিন্ন দপ্তরে জমা দেন জাহাজ মালিকরা।

জানা গেছে, আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা কোনো পণ্য আনলে তা বর্হিনোঙর থেকে খালাস করতে হয়। এজন্য ব্যবসায়ীরা লাইটার জাহাজ মালিকদের মাধ্যমে এ কার্যক্রম সম্পন্ন করেন। আর লাইটার জাহাজ মালিকরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পণ্য খালাসের কাজ পেলে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি) থেকে অনুমতির আবেদন করেন। কিন্তু একসঙ্গে চার-পাঁচটি মাদার ভেসেলের পণ্য খালাসের আবেদন করলে অনুমতি মেলে একটি বা দুটির। ফলে ক্ষতির সম্মুখীন হন ব্যবসায়ী ও জাহাজ মালিকরা।

আরও জানা গেছে, লাইটার জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের (ডব্লিউটিসি) আওতায় রয়েছে অন্তত ১২০০ জাহাজ। ডব্লিউটিসি নামে এই সংগঠনের কনভেনার নুরুল হক হলেও সেখানে একটি সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি আমদানিকারক ও জাহাজ মালিকরা। ওই সিন্ডিকেটের মূল ভূমিকায় রয়েছেন বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিভিওএ) নির্বাহী সদস্য এবং বাংলাদেশ শিপ হ্যান্ডলিং ও বার্থ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান এ কে এম সামছুজ্জামান রাসেল। তার ইশারায় চলছে ডব্লিউটিসি থেকে পণ্য খালাসের সিরিয়াল বা ভাড়ার অনুমতি।

এছাড়া কোনো জাহাজ মালিক ডব্লিউটিসির অনুমতি ছাড়া সিরিয়ালের বাইরে গিয়ে পণ্য খালাসের চুক্তিবদ্ধ হলে সেখানে বাধাগ্রস্ত করে ওই সিন্ডিকেট। আমাদানিপণ্য খালাস কার্যক্রম একচ্ছত্রভাবে নিয়ন্ত্রণের ভূমিকায় ওই সিন্ডিকেট। এতে বেকায়দায় লাইটার জাহাজ মালিকরা। ডব্লিউটিসির কোনো নেতা বা জাহাজ মালিকরা ওই নেতার (রাসেলের) কথায় দ্বিমত পোষণ করলে তাদের হয়রানিসহ বন্ধ করে দেওয়া হয় পণ্য খালাসের কার্যক্রম।

গত বৃহস্পতিবার (২১ ডিসেম্বর) এভাবেই কুতুবদিয়ায় বহির্নোঙরে অবস্থানরত একটি কয়লার জাহাজের পণ্য খালাস বন্ধ করে দেন বাংলাদেশ শিপ হ্যান্ডলিং ও বার্থ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান এ কে এম সামছুজ্জামান রাসেল। ওইদিন অন্যান্য সব মাদার ভেসেলের পণ্য খালাসও কাজ বন্ধ ছিল। ফলে বাড়তি ভাড়া গুনতে হয় ব্যবসায়ীদের। এরপর পরই বিকালে চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান বরাবরে অভিযোগ দেওয়া হয় লাইটার মালিকদের পক্ষ থেকে। অভিযোগের অনুলিপি দেওয়া হয় ডিজিএফআই ও এনএসআইসহ চট্টগ্রাম বন্দরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং নিরাপত্তা পরিচালক বরাবরে।

পরে শুক্রবার থেকে জাহাজ মালিকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি মাদার ভেসেল থেকে পণ্য খালাসের অনুমতি দেওয়া হয়।

অভিযোগ দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন ইনল্যান্ড ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব চিটাগাংয়ের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান।

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, এসব লাইটার জাহাজ বন্দরের বহির্নোঙরে এবং কুতুবদিয়ায় অবস্থানরত মাদার ভেসেলগুলোতে পণ্য খালাসে গেলে এ কে এম সামছুজ্জামান রাসেল খালাস বন্ধ ও হয়রানি করেন। ফলে পণ্য খালাস বন্ধ রয়েছে। শিপ হ্যান্ডলিং ও বার্থ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের বেআইনি এবং অযৌক্তিক কার্যকলাপের কারণে দেশের ‘অর্থনৈতিক প্রাণ’ খ্যাত চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষতা এবং পণ্য খালাসের গতি হ্রাস পাওয়ার পাশপাশি মাদার ভেসেলগুলোর ডেমারেজ প্রদানে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার বিপুল পরিমাণ ক্ষতির আশঙ্কা করছি।

অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, এছাড়া বিভিন্ন আমদানিকারকের কাঁচামাল সময়মত খালাস করা না গেলে ও খালাসে বিলম্বের কারণে দেশের সামগ্রিক সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থা থুবড়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে প্রভাব পড়বে পণ্যে। যা সকল ভোক্তা তথা আপামর জনগণের জন্য ক্ষতিকর। এসব অলস পড়ে জাহাজের শ্রমিকের বেতন ও মজুরি, দৈনন্দিন জাহাজের ব্যয়, ব্যবসার ক্ষতিগ্রস্ত ও ব্যাংক ঋণের চাপে পড়ে অনেক জাহাজ মালিক ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে স্ক্র্যাপ করে জাহাজ বিক্রি করার একাধিক নজির রয়েছে।

চলতি বছরের ১৯ ডিসেম্বর ইনল্যান্ড ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব চিটাগাং (আইভোয়াক) উদ্বোধন করেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। গত ২০ ডিসেম্বর আইভোয়াক কার্যালয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের উপস্থিতিতে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থানরত বিভিন্ন মাদার ভেসেলের পণ্যের এজেন্টের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে লাইটার জাহাজ বরাদ্দ দেওয়া হয়। আইভোয়াকের প্রায় ৬০ জন সদস্য রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় অভিযোগে।

বৃহস্পতিবার (২১ ডিসেম্বর) একাধিক লাইটার জাহাজ মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত সময় মতো প্রতিদিন বহির্নোঙরে থাকা একটি মাদার ভেসেল পণ্য খালাস করতে না পারলে বাড়তি ভাড়া হিসেবে গুনতে হবে ২০ হাজার মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি টাকায় বর্তমানে প্রায় ২৪ লাখ টাকা)। সেই হিসেবে প্রতিদিন ৫৫টি মাদার ভেসেল পণ্য খালাস করতে না পারলে অতিরিক্ত ব্যয় গুনতে হবে ১৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পণ্য খালাসের অপেক্ষায় কুতুবদিয়ার চ্যানেলে অন্তত ৫৫টি মাদার ভেসেল ছিল।

তারা আরও জানান, মাদার ভেসেলের এসব অতিরিক্ত ব্যয় ব্যবসায়ীদের ঘাড়ে এসে পড়ে। ব্যবসায়ীর এসব অর্থের প্রভাব ফেলে প্রতিটি পণ্যের ওপরে। এতে বেড়ে যায় পণ্যের মূল্য।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শিপ হ্যান্ডেলিং অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান এ কে এম শামসুজ্জামানের রাসেল প্রথমে পণ্য খালাস বন্ধ করার বিষয়টি অস্বীকার করেন। পরে তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘একটি কয়লার জাহাজের ডকুমেন্টসের সমস্যা থাকায় কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। ডকুমেন্টস ঠিক করতে পারলে ওই জাহাজে গাং পাঠানো হবে।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!