পুলিশের গুলিতে সাবেক সেনা কর্মকর্তা নিহতের ঘটনায় তদন্ত কমিটিতে রদবদল
যশোরে গার্ড অফ অনারে দাফন হল লাশ
কক্সবাজারের টেকনাফে পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা নিহতের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটিতে রদবদল করা হয়েছে। নতুন কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে যুগ্মসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে মনোনীত করা হয়েছে। এর আগে আহ্বায়ক করা হয়েছিল কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে।
নতুন কমিটিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের একজন প্রতিনিধি সদস্য হিসেবে থাকবেন, যাকে মনোনীত করবেন ১০ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ও কক্সবাজারের এরিয়া কমান্ডার। অন্যদিকে পুলিশ বিভাগের পক্ষ থেকে এই কমিটিতে সদস্য হিসেবে থাকবেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ পুলিশ মহাপরিদর্শকের মনোনীত একজন প্রতিনিধি। এছাড়া কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহা. শাজাহান আলি এই তদন্ত কমিটিতে সদস্য হিসেবে থাকবেন, যাকে শুরুতে এই কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে রাখা হয়েছিল।
পুনর্গঠিত এই তদন্ত কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, তদন্ত কমিটি ঘটনার বিষয়ে সরেজমিনে তদন্ত করে ঘটনার কারণ ও উৎস অনুসন্ধান করবেন। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে মতামত দেবেন।
শুক্রবার (৩১ জুলাই) রাত সাড়ে ১০টার দিকে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়ায় মেরিন ড্রাইভ সড়কে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান। তিনি যশোরের ১৩ বীর হেমায়েত সড়কের সেনানিবাস এলাকার মৃত এরশাদ খানের ছেলে। ৩৬ বছর বয়সী রাশেদ খান স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন তার কর্মকালে। তার বাবা প্রয়াত এরশাদ খান ছিলেন অর্থমন্ত্রণালয়ের একজন সাবেক উপসচিব।
রোববার (২ আগস্ট) বিকালে যশোরে নিজ গ্রামে সাবেক সিনহা মো. রাশেদ খানের দাফন সম্পন্ন হয়। সেখানে সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাকে গার্ড অফ অনার প্রদান করেন। ময়নাতদন্ত শেষে শনিবার সন্ধ্যায় আত্মীয়স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল সাবেক ওই সেনা কর্মকর্তার লাশ।
পুলিশের চেনা গল্প
ওই ঘটনার পর পুলিশ দাবি করে, ওই সেনা কর্মকর্তা তার ব্যক্তিগত গাড়িতে করে অপর একজন সঙ্গীসহ টেকনাফ থেকে কক্সবাজার আসছিলেন। মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া চেকপোস্টে পুলিশ গাড়িটি থামিয়ে তল্লাশি করতে চাইলে সেনা কর্মকর্তা বাধা দেন। এই নিয়ে তর্ক-বিতর্কের একপর্যায়ে সেনা কর্মকর্তা তার কাছে থাকা ‘পিস্তল’ বের করলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে সেনা কর্মকর্তা রাশেদ ‘গুরুতর আহত’ হন।
আহত অবস্থায় তাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন। শনিবার (১ আগস্ট) সকালেই নিহতের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়।
কক্সবাজার পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেনও তখন দাবি করেছিলেন, সামলাপুরের লোকজন ওই গাড়ির আরোহীদের ‘ডাকাত সন্দেহ করে’ পুলিশকে খবর দেয়। এই সময়ে পুলিশ চেকপোস্টে গাড়িটি থামানোর চেষ্টা করে। কিন্তু গাড়ির আরোহী একজন তার পিস্তল বের করে পুলিশকে গুলি করার চেষ্টা করে। আত্মরক্ষার্থে পুলিশও গুলি চালায়। এতে ওই ব্যক্তি মারা যায়।
পুলিশ সুপার আরও জানান, এই ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। ২ জনকে আটক করা হয়েছে। পুলিশ পিস্তলটি জব্দ করেছে। এছাড়া গাড়িতে তল্লাশি করে ৫০টি ইয়াবা, কিছু গাজা এবং দুটি বিদেশি মদের বোতল উদ্ধার করা হয়েছে। নিহত মেজর (অব.) রাশেদ একটি তথ্য চিত্রধারণের কাজে এক নারী ও অপর ৩ জন পুরুষ সঙ্গীসহ গত এক মাস ধরে হিমছড়ির একটি রেস্টহাউজে অবস্থান করছিলেন।
সেনাসদরের বিজ্ঞপ্তি
এদিকে সেনাসদর এক বিজ্ঞপ্তিতে এ ঘটনাকে অত্যন্ত দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত জানিয়ে বলেছে, মেজর (অব.) সিনহা গাড়ি থামিয়ে তাদের পরিচয় দিলে প্রথমে তাদের যাওয়ার জন্য সংকেত দিলেও এসআই লিয়াকত তাদের পুনরায় থামায় এবং তাদের দিকে পিস্তল লক্ষ্য করে গাড়ি থেকে নামতে বলে। মেজর সিনহা হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নামার পরপরই এসআই লিয়াকত তাকে লক্ষ্য করে তিন রাউন্ড গুলি করে। জানা যায় যে, এসআই লিয়াকত কোনরূপ কথাবার্তা না বলেই গাড়ি থেকে নামার পরপরই মেজর সিনহাকে করে লক্ষ্য গুলি করে।
ঘটনার বিবরণী বিশ্লেষণ করে সেনাসদর বলেছে, প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী স্যুটিংয়ের জন্য মেজর (অব.) সিনহা সামরিক পোশাক পরিধান করেছেন, যা পরিধান করার আগে স্থানীয় সেনা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা উচিত ছিল।
একজন সামরিক পোশাকধারী কর্মকর্তা পরিচয় প্রদানের পরও কোনো জিজ্ঞাসাবাদ ব্যতিত এসআই লিয়াকত কর্তৃক গুলিবর্ষণ করার ঘটনাটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। একইসাথে একজন ব্যক্তি হাত তুলে গাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তাকে আটক না করে সরাসরি গুলি করা সম্পূর্ণ আইন বহির্ভূত। পুলিশ কর্তৃক এএসইউ-এর মাঠকর্মী পরিচয় জানার পরেও তার পরিচয় ও মোবাইল ছিনিয়ে নেয়াটা সমীচিন হয়নি।
সেনাসদর জানিয়েছে, সামরিক পোশাক পরিহিত থাকা অবস্থায় মেজরকে (অব.) গুলি করার পরই তার বিরুদ্ধে মাদক সংশ্লিষ্ট অভিযোগ উত্থাপনের ঘটনাটিকে অন্য খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা বলে অনুমেয়। ঘটনাটির যথাযথ তদন্তের প্রয়োজনে উভয় বাহিনীর কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি যৌথ তদন্ত দল গঠন করাসহ তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে দোষী ব্যক্তিদের যথাযথ আইনের আওতায় আনা যেতে পারে।
বাহারছড়া ফাঁড়ি ‘ক্লোজড’
কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কে পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর সিনহা মো. রাশেদ নিহত হওয়ার ঘটনায় বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলীসহ ২০ জনকে ক্লোজড করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলীই প্রথম গুলি করেন সাবেক ওই সেনা কর্মকর্তাকে। লিয়াকত আলী এর আগে সিএমপিতে কর্মরত ছিলেন। তার বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়ায়।
শনিবার (১ আগস্ট) রাতে ফাঁড়ির পুরো টিমকে কক্সবাজার জেলা পুলিশ লাইনে ক্লোজড করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বিপিএম (বার)।
রোববার (২ আগস্ট) বিকেলে পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়িতে পুরো নতুন টিম দেওয়া হয়েছে।
এদিকে এই ঘটনা সম্পর্কে অবহিত হতে কক্সবাজারে অবস্থান করছেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের এডিশনাল ডিআইজি (অপারেশন্স এন্ড ক্রাইম) জাকির হোসেন।
সিপি