৪৯ বছরে এমন দৃশ্য দেখেনি চট্টগ্রাম, যা ঘটেছিল নয় মাসজুড়ে

চট্টগ্রামের লোক সবশেষ এমন দৃশ্য দেখেছিল ৪৯ বছর আগে, ১৯৭১ সালে।

রোগীকে রাস্তায় ফেলে রাখছে, হাসপাতাল ফিরিয়ে দিচ্ছে, রক্তের সম্পর্কের দায় নিচ্ছে না মানুষ— এমন দৃশ্য আগে কখনও দেখেছে কি চট্টগ্রাম? লাশ দাফনে বাধা দিচ্ছে মানুষ, করোনার ভয়ে মাকে ফেলে চলে গেল সন্তান, অন্তিম শয্যায়ও আপনজনরা পাশে নেই, জানাজায় নেই প্রিয়জনদের ঢল— এমন মর্মন্তুদ দৃশ্য কি আগে দেখেছে চট্টগ্রাম? এমন নিরানন্দ ঈদ কিংবা দুর্গাপূজাও কি এসেছিল কখনও? যেখানে কোনো যুদ্ধ নেই, দুর্ভিক্ষও নেই তারপরও মানুষের মুখে হাসি নেই, আনন্দ নেই। অচেনা এক শত্রুর ভয়ে তটস্থ সবাই— আগে কে দেখেছে এমন দৃশ্য?

নিশ্চিত করেই বলা যায়, পুরো বছর ধরে এমন অভূতপূর্ব দৃশ্য এমন অচেনা ছবি কখনও দেখেনি কেউ। আর তাই অন্য সব কিছুকে ছাপিয়ে বিদায়ী ২০২০ কেবলই করোনা মহামারীর বছর। বিদায়ী ২০২০ কেবলই করোনার বিষে ভরা।

চট্টগ্রামে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৩ এপ্রিল। ২৬ মার্চ চট্টগ্রামে করোনার নমুনা পরীক্ষা শুরু হওয়ার মাত্র নয় দিন পর প্রথম করোনা রোগী হিসেবে শনাক্ত হন দামপাড়ার ৬৭ বছর বয়সী ওই বৃদ্ধ।

শুরুর এক মাস একাই করোনার টেস্টের ধকল একাই সামাল দিচ্ছিল চট্টগ্রামে ফৌজদারহাটের বিশেষায়িত হাসপাতাল ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসে (বিআইটিআইডি)। টেস্ট করার সক্ষমতার তুলনায় অতিরিক্ত নমুনার চাপ, কিট সংকট, পরিবহন সংকট নিয়ে ওই সময়ে বরাবরই আলোচনায় ছিল প্রতিষ্ঠানটি। তবে এক্ষেত্রে সে সময়ে দারুণ ভূমিকা রেখে পরিস্থিতি বেশ ভালভাবেই সামাল দিয়েছিলেন বিআইটিআইডির ল্যাব প্রধান ডা. শাকিল আহমেদ। কিট সংকট মোকাবেলায় জরুরিভিত্তিতে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়ার সরাসরি ভূমিকাও নজর কেড়েছে বেশ।

২৫ এপ্রিল দ্বিতীয় ল্যাব হিসেবে করোনার নমুনা পরীক্ষা আরম্ভ করে চট্টগ্রামের ভেটেরিনারি এন্ড অ্যানিম্যাল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিভাসু) ল্যাবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ইম্পেরিয়াল, শেভরন, চবি,মা ও শিশু হাসপাতাল কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ মোট আটটি ল্যাবে প্রতিদিন হচ্ছে হাজারের ওপর নমুনা পরীক্ষা।

শুরুর দিকে করোনার নমুনা পরীক্ষা ছাড়াও চট্টগ্রামে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেয় হঠাৎ কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষদের বাঁচিয়ে রাখা। এক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগে ব্যাপক ত্রাণ দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে ব্যাপক ত্রাণ বিতরণ করা হয়। এই সময়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) নানান উদ্যোগও বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। পাশাপাশি ত্রাণ বিতরণে সক্রিয়ভাবে মাঠে নামে সেনাবাহিনী

শুরুর দিকে আইসিইউ সেবাকেই করোনার সর্বোচ্চ চিকিৎসা ধরা হচ্ছিল। সে সময়ে ২৫ মার্চ অনুষ্ঠিত করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ ও মোকাবেলায় সশস্ত্র বাহিনী, প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের যৌথ সমন্বয়ে বিভাগীয় কমিটির সভার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় করোনার চিকিৎসায় ১২টি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ সিট ব্যবহারের। তবে বেসরকারি হাসপাতালগুলো স্বাস্থ্য বিভাগের কথায় সায় দিলেও পরে এই অবস্থান থেকে সরে আসে তারা। ১৩ এপ্রিল চিকিৎসা না পেয়ে মারা যান সরাইপাড়ার এক নারী। শ্বাসকষ্ট নিয়ে আইসিইউর খোঁজে ১১ ঘন্টা ধরে চট্টগ্রামের তিন হাসপাতালে ঘুরেও চিকিৎসা পাননি তিনি। চট্টগ্রামে তিনিই চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাওয়া প্রথম রোগী। ১১ নম্বর সরাইপাড়ার তৎকালীন কাউন্সিলর মোর্শেদ আক্তার চৌধুরী নিজে গাড়ি চালিয়ে ওই মহিলাকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর বেসরকারি হাসপাতালের কথা না রাখা ও সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা না থাকা নিয়ে চট্টগ্রামে শুরু হয় তুমুল সমালোচনা। সমালোচনার মুখে এর আগে তিন মাস সময় পেয়েও আইসিইউ ওয়ার্ড চালু করতে না পারা জেনারেল হাসপাতাল মাত্র ৫ দিনের মাথায় ১৮ এপ্রিল আইসিইউ ওয়ার্ডের কাজ শেষ করে। এর তিন দিন পর ২১ এপ্রিল থেকে রোগী নিতে শুরু করে হাসপাতালটি।

পরিস্থিতি মোকাবেলায় ২২ এপ্রিল চট্টগ্রামে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রশাসনের দায়িত্বশীলদের সাথে মতবিনিময় করেন চট্টগ্রামের মন্ত্রী, সাংসদ ও আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। তবে করোনা মোকাবেলায় প্রথমবারের মত চট্টগ্রামে শীর্ষস্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা এক টেবিলে বসলেও এতে ছিলেন না চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন।

করোনাকালের শুরুর দিকে ত্রাণ বিতরণ, সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণসহ অনেকটা একলা মাঠ দাপিয়ে বেড়ানো নাছির এরপর থেকেই হঠাৎ খেই হারান। করোনার কঠিন সময়ে তার দারুণ ভূমিকা অনেকটাই ম্লান হয়ে যায় বেসরকারি হাসপাতালের তৈরি করা চিকিৎসা সংকটে কোনো ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়ে। বিশেষ করে এই সময়ে বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর পক্ষ থেকে হলিক্রিসেন্ট হাসপাতালকে করোনার জন্য প্রস্তুত করার ঘোষণা দেওয়া হলেও অনেক টাকা খরচ করে করা সেই হাসপাতাল করোনা চিকিৎসায় সামান্যতম ভূমিকাও রাখতে পারেনি। বরং সংকট ও জটিলতা তৈরিতে বারবার ব্যবহার করা হয়েছে এই উদ্যোগটিকে। এই বিষয়ে চট্টগ্রাম প্রতিদিনে সে সময়ে করা একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, করোনাকালে চট্টগ্রামে সবচেয়ে বড় প্রতারণার নাম হলো হলিক্রিসেন্ট। যদিও পরিস্থিতি সামাল দিতে মেয়র নাছিরের উদ্যোগে চসিকের পক্ষ থেকে বড়পোলে গড়ে তোলা হয় ১০০ শয্যার আইসোলেশন সেন্টার।

এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু করে মে মাসে করোনার সবচেয়ে কঠিন সময়টা পার করে চট্টগ্রাম। করোনাকালেই শুধু নয়, এর আগে কখনোই এমন দুঃসময় দেখেনি চট্টগ্রাম। করোনা রোগিদের আইসিউ সেবা দেওয়ার কথা বলে না দেয়ার পাশাপাশি হঠাৎ বিভিন্ন অজুহাতে অন্য রোগীদের সেবা দেয়াও বন্ধ করে দেয় বেসরকারি হাসপাতালগুলো। করোনার উপসর্গ থাকার অজুহাতে হৃদরোগ-প্রসূতিসহ অন্যান্য রোগীদের ভর্তি নেওয়া বন্ধ করে দেয় বেসরকারি হাসপাতালগুলো।

এর মধ্যে পেটে ১০ মাসের অনাগত শিশু নিয়ে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা চেষ্টা করেও চট্টগ্রামের কোনো হাসপাতালে একটি আইসিইউ শয্যা বা ন্যূনতম সেবা না পেয়ে মারা যান মুক্তা নামে এক নারী। একইভাবে বুকে ব্যথা নিয়ে কয়েকটি হাসপাতালে গিয়েও চিকিৎসা না পেয়ে মারা যান বায়েজিদ আওয়ামী লীগ নেতা শফিউল আলম ছগীর (৫৭)। অক্সিজেনের অভাবে ধুঁকতে ধুঁকতে মৃত্যু ঘটে করোনায় আক্রান্ত ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ শাহ আলমের (৪৮)। এমন প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামবাসী কভিড ও নন-কভিড রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হাইকোর্টে রিট করেন দুই সিনিয়র আইনজীবী। রাস্তায় নামে নগর ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের দেখাদেখি মুক্তিযোদ্ধা ও পেশাজীবীরা মুখ খুলতে শুরু করে বেসরকারি হাসপাতাল মালিকদের জোটের বিরুদ্ধে।

ওই সময় অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত না হলেও বন্দরনগরী চট্টগ্রামে চিকিৎসার অভাবে অনেকেরই মৃত্যু ঘটছিল বিনা চিকিৎসায়। কত মানুষ এর শিকার হয়েছেন যদিও এর কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো দপ্তরে। তবে একের পর এক কঠোর নির্দেশনার পরও বশ মানছিল না চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতালগুলো। প্রতিদিন চিকিৎসার জন্য এসব হাসপাতালে গিয়ে কাকুতিমিনতি করেও চিকিৎসাসেবা পাচ্ছিলেন না রোগীরা। ভর্তি হওয়া যাচ্ছিল না হাসপাতালে। পাওয়া যাচ্ছিল না আইসিইউ কিংবা অক্সিজেন সাপোর্ট। নানা অজুহাত দেখিয়ে কভিড ও নন-কভিড সব রোগীকেই চিকিৎসা না দিয়েই ফিরিয়ে দিচ্ছিল হাসপাতালগুলো।

এমন অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর অবস্থানের পক্ষে অবস্থান নিয়ে ব্যাপক সমালোচিত হন চিকিৎসক নেতা ফয়সাল ইকবাল ও ম্যাক্স হাসপাতালের এমডি লিয়াকত আলী খান। একপর্যায়ে আন্দোলনে নামেন নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি। বেসরকারি হাসপাতাল ও চট্টগ্রামের চিকিৎসা সংকট ইস্যুতে অনেকটা মুখোমুখি অবস্থানও নেন ফয়সাল ইকবাল ও রনি। এর মধ্যে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মিজানুর রহমান খানের নেতৃত্বে সার্ভিল্যান্স টিম করে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ নেয় সরকার। এ সময় সরকারদলীয় আরেকজন চিকিৎসক নেতা ডা আ ম ম মিনহাজুর রহমানও বেশ সক্রিয় ভূমিকা রাখেন সংকট নিরসনে।

তবে হাসপাতাল মালিকদের এই হঠকারী অবস্থানের মধ্যেই ব্যক্তিগত ও বেসরকারি উদ্যোগে আইসোলেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন অনেকে। চসিকের পক্ষ থেকেই একটি আইসোলেশন সেন্টার খোলা হয়। এর মধ্যে সাজ্জাত হোসেন, জিনাত সোহানা চৌধুরী, নুরুল আজিম রনিসহ মূলত তরুণদের উদ্যোগে পরিচালিত হালিশহরের করোনা আইসোলেশন সেন্টার বেশ নজর কেড়েছিল। এছাড়া ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়ার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম করোনা ফিল্ড হাসপাতাল নামে অপর একটি আইসোলেশন সেন্টার করোনাকালে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। এর বাইরে করোনাকালে যখন করোনা আক্রান্তদের লাশ দাফন নিয়ে স্ংকট দেখা দেয়, তখন করোনায় মৃতদের লাশ দাফনের উদ্যোগ নিয়ে উদাহরণ তৈরি করে আল মানাহিল নামে একটি সংগঠন। পরে একই কাজে নামে গাউসিয়া কমিটিও। আল মানাহিলের উদ্যোগে হালিশহরের বি ব্লকে প্রতিষ্ঠা করা হয় একটি হাসপাতালও।

সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আগস্টে মোটামুটি এই অস্থিরতার অবসান হয়। এই মুহূর্তে চট্টগ্রামে করোনা পরিস্থিতি অনেকটাই স্থিতিশীল। বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা সেখ ফজলে রাব্বী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘যেখানে শুরুতে ৯ দিনে মাত্র ৫৫টি নমুনা আমরা পরীক্ষা করতাম সেখানে এখন দৈনিক ১৫ শত থেকে ১৮ শত নমুনা পরীক্ষা করা যাচ্ছে। এর মধ্যে শনাক্তের হারও ওঠানামা করছে। আগে যেখানে নিয়মিত ২০ শতাংশ পজিটিভ শনাক্ত হতো, এখন সেখানে ৬ থেকে ১১ শতাংশ শনাক্ত উঠানামা করছে।’

চিকিৎসা সক্ষমতা সম্পর্কে জেলা সিভিল সার্জন ফজলে রাব্বি বলেন, মোট ৮০টি আইসিইউ আছে চট্টগ্রামের করোনা রোগীদের জন্য। এর মধ্যে ৩০টি সরকারি। পাশাপাশি সরকারি বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে হাই ফ্লো ন্যাজোল ক্যানোলা আছে প্রায় ৩০০টি। আর করোনা রোগীদের জন্য সরকারি শয্যা আছে ৭০০টি এবং বেসরকারি শয্যার সংখ্যা ৬৫০টি।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!