ফেসবুক দেখে ঘরে চিকিৎসা নিচ্ছে চট্টগ্রামের আড়াই হাজার করোনা রোগী

ডাক্তার-স্বাস্থ্য বিভাগ ফোনই ধরে না

চট্টগ্রামে ৬ মে পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত তিন হাজার ৮০৯ রোগী শনাক্ত হলেও বিভিন্ন হাসপাতালে ওই দিন পর্যন্ত চিকিৎসা নিচ্ছিলেন মাত্র ৩৩২ জন। বাকিরা সবাই নিজের বাসাতেই আইসোলেশনে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। হোম আইসোলেশনে থাকা করোনা রোগীদের সংখ্যা হাসপাতালে থাকা রোগীদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি শুধু মহানগর এলাকাতেই। সিভিল সার্জনের দেওয়া তথ্য মতেই বাসায় থেকে করোনার চিকিৎসা নিচ্ছে এমন রোগীর সংখ্যা গত শুক্রবার (৫ জুন) পর্যন্ত ২ হাজার ৩৫৯ জন।

হাসপাতালে চিকিৎসা নিশ্চিত করা তো বটেই, হোম আইসোলেশনে থাকা এই রোগীদের চিকিৎসা তত্ত্বাবধানেও হিমশিম খেতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। ফলে নানামুখী ভোগান্তিতে পড়ছে রোগীরাও। একদিকে করোনা পজিটিভ হওয়ার মানসিক ও সামাজিক চাপ, অন্যদিকে চিকিৎসা বিষয়ে এই রোগীরা পাচ্ছে না সুনির্দিষ্ট কোনো গাইডলাইন। ফলে হোম আইসোলেশনে থাকা এসব রোগীকে যেতে হচ্ছে চরম ভোগান্তির মধ্য দিয়ে। উপায়হীন বেশিরভাগ রোগীই এখন চিকিৎসা ও অন্যান্য পরামর্শের জন্য ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে ধরনা দিচ্ছেন প্রতিদিনই।

৫ মে পর্যন্ত চট্টগ্রামে করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হওয়া ৩ হাজার ৮০৬ জনের মধ্যে শনিবার (৬ জুন) পর্যন্ত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন ৩৩২ জন। অন্যদিকে সিভিল সার্জনের দেওয়া হিসেব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৯৩ জন। হাসপাতালগুলো থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ২৬৭ জন। করোনায় আক্রান্ত বাকি ৩ হাজার ১১৪ জন রোগী হোম আইসোলেশনে থেকেই চিকিৎসা নিয়েছেন। সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এর মধ্যে ৭৫৫ জন সুস্থও হয়েছেন। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম জেলায় বাসায় থেকে চিকিৎসা নেওয়া করোনা রোগীর সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ২ হাজার ৩৫৯ জন। যার বেশিরভাগই মহানগর এলাকার।

হোম আইসোলেশনে থেকে চিকিৎসা নেওয়া এই বিশাল অংশের রোগীদের চিকিৎসা কিভাবে নিশ্চিত করছে স্বাস্থ্য বিভাগ? এই বিষয়ে জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মোস্তফা খালেদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘নগরের রোগীদের ক্ষেত্রে জেনারেল হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে হাসপাতাল থেকে কল করে রোগীদের আইসোলেশনে থাকতে বলা হয়। উপজেলাগুলোতেও আলাদাভাবে এই কাজটি করার লোক আছে। যারা ফোন দিচ্ছেন, আইসোলেশনের সময়ে চিকিৎসার তদারকিও করছেন তারাই।’

কিন্তু বাস্তব চিত্র খানিকটা ভিন্ন। চট্টগ্রামে করোনাভাইরাস শনাক্তের শুরুর দিকে হাসপাতালে সিট ভর্তি হয়ে গেলে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে রোগীদের কাছে ফোন করে আইসোলেটেড থাকার পরামর্শ দেওয়া হতো। পরবর্তীতে নিয়মিত ফোনে চিকিৎসা গাইডলাইনও দেওয়া হতো। কিন্তু যখনই চট্টগ্রামে করোনা রোগী বাড়তে শুরু করে, তখন একইসঙ্গে এই চিত্রও বদলে যায়। এখন শুধুমাত্র ফোন করে আইসোলেশনে থাকার পরামর্শ দিয়েই দায় সারছে স্বাস্থ্য বিভাগ। আইসোলেশনে থাকা অবস্থায় কোন চিকিৎসা গাইডলাইনের দরকার হলে কোথায় ফোন করতে হবে তা জানেন না রোগীরা। যে নম্বর থেকে কল করে আইসোলেশনে থাকতে বলা হয়, প্রয়োজনে সেসব নম্বরে কল করেও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না বলে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানিয়েছেন অন্তত ৬ জন করোনা রোগী। যাদের সকলেই এই মুহূর্তে বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন।

নগরীর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী সাদিয়া (ছদ্মনাম) চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি ও আমার মা ২৭ মে করোনা পজিটিভ শনাক্ত হই। আমার বাবা ২৩ তারিখ শ্বাসকষ্টে মারা যান। কিন্তু আমাদের দুএকটি সিম্পটমস (উপসর্গ) ছাড়া তেমন কোনো সিম্পটমস ছিল না। যেহেতু আব্বু শ্বাসকষ্টে মারা গেছেন, তাই আমরা করোনা টেস্ট করি। করোনা পজিটিভ হওয়ার খবর পুলিশের পক্ষ থেকে আমাদের জানানো হয়। বলা হয় আমরা যাতে হোম আইসোলেশনে থাকি। এর মধ্যে আমার জ্বর হয়। কিন্তু এরপর কী করতে হবে এই বিষয়ে কোনো ধারণা ছিল না আমাদের। এই বিষয়টা সবচেয়ে মানসিক চাপের ছিল। পরে বেশ কয়েকবার ৩৩৩ নম্বরে কল করে সেখানে উপসর্গ বললে উনারা কিছু ওষুধের নাম দেন।’

জাহেদুল নামে অপর এক করোনা রোগী জানান, ‘করোনা পজিটিভ হওয়ার পর আমাকে একটা নম্বর থেকে কল করে শুধু বলা হয়েছিল— ‘আপনি পজিটিভ হয়েছেন, হোম আইসোলেশনে থাকেন।’ পরে আর ওই নম্বরে কল করলেও কেউ রিসিভ করেনি। শেষে করোনা আপডেট চিটাগং গ্রুপের এডমিনের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জেনারেল হাসপাতালের একজন ডাক্তারের নম্বর দেন। ওই ডাক্তার ফোনে আমাকে কিছু ওষুধ আর পরামর্শ দেন। পরে আর উনিও কল ধরেননি। এখন চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারতেছি না। পরীক্ষা করাবো কিনা বা অন্য কী করবো— সে বিষয়ে কোন দিকনির্দেশনা পাচ্ছি না।’

শুধু জাহেদুলই নয়, হোম আইসোলেশনে কিভাবে কী করবেন সে বিষয়ে কোন দিক থেকে কোন উপায় না পেয়ে অনেক রোগীই প্রতিদিন যোগাযোগ করছেন ‘করোনা আপডেট চিটাগং’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপের সঙ্গে। এ বিষয়ে কথা হয় গ্রুপটির অ্যাডমিন তানভীর রনির সঙ্গে। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘প্রথম দিকে রোগী যখন এক হাজারের ভেতর ছিল কিন্তু হাসপাতালে সিট ছিল না— তখন ডাক্তাররা ফোন করে দিকনির্দেশনা দিয়ে দিতেন। পরে যখন সংখ্যাটা বাড়লো তখন ডাক্তারদের দিক থেকে টোটালি ফোন করা হচ্ছে না। শুধু প্রথমে একটা ফোন করে বলে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের কাছে প্রায় সময় পজিটিভ রোগীরা গ্রুপের পেইজে যোগাযোগ করে। তারা বলে যে এটলিস্ট আমাদের একটু কানেক্ট করে দেন— কী খাব কী করবো। আমরা শুরু থেকে এটা করছিলাম। প্রথম দিকে ডাক্তাররা খুব রেসপন্স করতো। কিন্তু এখন যে পরিমাণে ফোন যাচ্ছে, উনারাও সাড়া দিতে পারছেন না। প্রতিদিন অন্তত ৩০-৪০ জন এই বিষয়ে সাহায্য চান।’

ওই গ্রুপের আরেক অ্যাডমিন আর্শিয়া ইসলাম বলেন, ‘যেহেতু এখন হাসপাতালে সিট নেই এবং রোগীদের বাসায় আইসোলেশনে থাকতে হচ্ছে। সেজন্য ৫ থেকে ৭ জন ডাক্তারের একটা টেলিমেডিসিন টিম গঠন করে তারা যদি প্রতিদিন পজিটিভ হওয়া রোগীদের সেবা, পরামর্শ ও একটি গাইডলাইন দিতেন, তাহলে রোগীরা অন্তত স্বস্তি পেত এবং পরামর্শের জন্য হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটতো না।’

এই বিষয়ে জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. জামাল মোস্তফা বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে আমি সহ তিনজনের দায়িত্বে একটা হটলাইন সেবা চালু করা হয়েছে। এর মধ্যে অসীম কুমার নাথ স্যার নিজেই স্ট্রোক করে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আমরা দুজন এটা চালিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে অনেক। আমরা হাসপাতালের রোগীদেরও সেবা দিতে হচ্ছে। ফলে অনেককেই রেসপন্স করতে পারি না। এখন অনেককে আমরা ৩৩৩ জরুরি সেবা ও ১৬২৬৩ নম্বরে কল করে পরামর্শ নিতে বলছি।’

চট্টগ্রাম জেলার সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বী বলেন, ‘যে নম্বর থেকে রোগীকে আমরা কল করবো ওই ডাক্তারের সাথে রোগী যোগাযোগ রাখবেন। এটা হলো আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে বাত্যয় ঘটছে। দেখা যায় অনেকের নাম্বারে পাওয়া যায় না।’

হোম আইসোলেশনে থাকা রোগীদের সেকেন্ড টেস্ট কিভাবে করানো হচ্ছে— এই বিষয়ে জানতে চাইলে সিভিল সার্জন বলেন, ‘এই ব্যাপারে সরকারের গাইডলাইন হচ্ছে পরপর তিন দিন যদি সিম্পটম (উপসর্গ) না থাকে তাহলে সে সুস্থ। কিন্তু ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে হোম আইসোলেশনে থাকাদের সেকেন্ড টেস্ট জরুরি না। শুধুমাত্র হাসপাতালে যারা আছেন তাদের ছাড়ার আগে আরেকটা স্যাম্পল আমরা টেস্ট করাচ্ছি।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!