পুলিশের ‘মাসোহারা’ চট্টগ্রামে ফিটনেস ছাড়াই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে লক্কর-ঝক্কর সিটি বাস

অধিকাংশ ড্রাইভারের নেই লাইসেন্স

চট্টগ্রাম নগরীতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ফিটনেসবিহীন লক্কর-ঝক্কর সিটি বাস। বাসের অধিকাংশ চালকের নেই ড্রাইভিং লাইসেন্স। আবার অনেক বাসের স্টিয়ারিং থাকে কিশোর বয়সী ছেলেদের হাতে। সিইপিজেড ও কর্ণফুলী ইপিজেডের পোশাক কারখানার শ্রমিকদের আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে বাসগুলো। রাস্তায় পুলিশের হাত থেকে ‘বাঁচতে’ মাসিক চাঁদাও দেয় তারা। বাস থেকে চাঁদার টাকা তোলেন কথিত এক পরিবহন শ্রমিক নেতার লোকজন।

অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের ছত্রছায়ায় থেকেই এসব ফিটনেস-ডকুমেন্টসবিহীন গাড়ি রাস্তায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এর পুরস্কার হিসেবে ট্রাফিক পুলিশের শীর্ষকর্তাদের পকেটে চলে যায় মাসোহারার একটি অংশ।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীর অন্তত ২৫০টি ফিটনেসবিহীন সিটি বাস ‘রিজার্ভ’ ভাড়া আনা-নেওয়া করে। প্রতিদিন সিইপিজেড ও কর্ণফুলী ইপিজেডের পোশাক শ্রমিককে আনা-নেওয়ায় ব্যবহার হয় এসব বাস। মামলা ও হয়রানি থেকে বাঁচাতে বাসপ্রতি ৩০০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এসব টাকা তোলেন আব্দুল মালেক মানিক নামের এক ব্যক্তি। তিনি আবার কথিত পরিবহন শ্রমিক নেতা নুরুল ইসলাম বাহিনীর সদস্য। মূলত ট্রাফিক পুলিশ পরিদর্শকের (টিআই) লোক পরিচয় দিয়েই মাসোহারার টাকা তোলা হয় এসব বাস থেকে। টাকার ভাগ যায় ইপিজেড, পতেঙ্গা ও বিমানবন্দর টিআইয়ের পকেটে। পতেঙ্গা-কাঠগড় এলাকায় ট্রাফিকের ‘টেন্ডল’ হিসেবে পরিচিতি আছে মানিকের। টাকা না দিলে বাসচালকদের মারধরও করা হয়।

২০১৯ সালের ২৫ জুলাই পতেঙ্গা থানার কাঠগড় এলাকায় রাসেল হাওলাদার নামের এক বাসচালক থেকে চাঁদা না পেয়ে তাকে মারধর করেন মানিক ও তার দল। এ ঘটনায় পতেঙ্গা থানায় একটি চাঁদাবাজি মামলা করেন ভুক্তভোগী বাসচালক। বর্তমানে মামলাটি চট্টগ্রামের একটি আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

এছাড়া ২০২২ সালের ৩০ মার্চ চট্টগ্রাম ইপিজেড, বিমানবন্দর ও পতেঙ্গা কাঠগড় এলাকায় অবৈধ ও কাগজপত্রবিহীন গাড়ি চলাচল শ্রমিক নেতা নামধারী নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বরাবরে অভিযোগ দেয় চট্টগ্রাম বাস মিনিবাস ও হিউম্যান হলার চালক সহকারী শ্রমিক ইউনিয়ন।

অভিযোগে বলা হয়, শ্রমিক নেতা নামধারী নুরুল ইসলাম ও তার বাহিনীর চাঁদাবাজিতে পতেঙ্গা এলাকায় বৈধ গাড়ির মালিক ও শ্রমিকরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। সিইপিজেড থেকে পতেঙ্গা এলাকার চাঁদাবাজ নুরুল ইসলাম ও আবদুল মালেক মানিক কাঠগড় এলাকায় টিআইয়ের টেন্ডল হিসেবে পরিচয় দেন।

সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থানার সী-বিচ সংলগ্ন কামাল আতাতুর্ক সড়ক থেকে স্টিলমিলস পর্যন্ত সড়কের দু’পাশে এসব রিজার্ভ বাসগুলো অবৈধভাবে পার্কিং করেছে। অবৈধ গাড়ি পার্কিং করায় ছোট হয়ে গেছে সড়কের আকৃতি। এতে ওই এলাকায় নিত্যনৈমিত্তিক যানজটসহ বাড়ছে ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনা। এসব যান চলাচলে সড়কজুড়ে তৈরি হয়েছে বিশৃঙ্খলা।

এ সময় সিইপিজেড ও কর্ণফুলী ইপিজেডের শ্রমিক আনা-নেওয়াকারী দুই বাস চালকের সঙ্গে কথা হয়। জানতে চাইলে তারা বলেন, ‘রিজার্ভ বাস চালকের অধিকাংশের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। এসব গাড়ির কোনোটিরও ফিসনেস নেই। বেশিভাগ গাড়ি অনেক পুরোনো। প্রতিদিন রিজার্ভ বাস সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পোশাক শ্রমিকদের আনা-নেওয়ার ট্রিপ শেষ করার পর পার্কিং করে রাখে পতেঙ্গা সড়কের রাস্তায়। তাদের মাসিক চাঁদা দিলেই গাড়িগুলো ট্রাফিক পুলিশ মামলা দেয় না। টাকা তোলেন মানিক। তিনি ট্রাফিক পুলিশের লোক বলে সবার কাছে পরিচিত।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বাস মিনিবাস ও হিউম্যান হলার চালক সহকারী শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ ইউসুফ নবী সুমন বলেন, ‘চট্টগ্রাম পতেঙ্গা, ইপিজেডে কাগজপত্র ছাড়াই তিন টিআইয়ের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় চলে এসব রিজার্ভ বাস। ওই এলাকায় প্রায় ২৫০-৩০০টি রিজার্ভ বাস চলে। একটির কোনো কাগজপত্র ও ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই। প্রতিটি গাড়ি থেকে প্রতিমাসে মানিক ৩ হাজার টাকা করে তোলেন। ওই টাকার ভাগ যায় ইপিজেড, পতেঙ্গা ও বিমানবন্দরের কর্মরত টিআইয়ের পকেটে। কাঠগড় এলাকায় মানিক নিজেকে টিআইয়ের টেন্ডল হিসেবে পরিচয় দেন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আব্দুল মালেক মানিক বলেন, ‘আমি কোনো রিজার্ভ বাসের টাকা তুলছি না। আমি ট্রাফিকের কোনো টেন্ডলও পরিচয় দিই না, আমি শ্রমিক নেতা। যারা অভিযোগ দিয়েছেন, সেটি সম্পর্কে আমি কিছু জানি না।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক এয়ার মোহাম্মদ এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, লক্কর-ঝক্কর ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলতে পারবে না। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় পতেঙ্গা ও ইপিজেডের লোকাল ট্রাফিক ইন্সপেক্টররা দালালের মাধ্যমে টাকা নিয়ে গাড়িগুলো অবাধে চলাচলের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘সিএমপি পুলিশ কমিশনারের কাছে আবেদন, এসব গাড়ির কারণে রাস্তায় বিভিন্ন ধরনের এক্সিডেন্ট এবং প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। এব্যাপারে বিভিন্ন সংগঠন থেকে চিঠি দেওয়ার পরও কিভাবে গাড়িগুলো চলছে?’

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইপিজেডের টিআই মো. মাবিয়ান মিঞা বলেন, ‘এখানে (আমার এলাকায়) কোনো ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলে না। হাজারে হয়তো একটি চলতে পারে। আমরা নিয়মিত কাগজপত্রবিহীন গাড়ি দেখলে আটকসহ মামলা দিচ্ছি।’

অভিযোগ আছে মানিক নামের এক ব্যক্তি আপনার নাম ব্যবহার করে রিজার্ভ বাসগুলো থেকে টাকা উঠাচ্ছেন—এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি ওই নামে কাউকে চিনি না।’

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পতেঙ্গার টিআই মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি এই এলাকায়। প্রতিমাসে আমরা স্বাভাবিক নিয়মে কাগজপত্রবিহীন এসব বাসগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছি। মামলাও দিচ্ছি। এখানে আসার পর থেকে মানিক নামের এক ব্যক্তির কথাও শুনেছি। আমার নাম দিয়ে কেউ কোনো অপকর্ম করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

অভিযোগের বিষয়ে বিমানবন্দর এলাকায় দায়িত্বরত টিআই সাইদুর রহমান বলেন, ‘অভিযোগ মিথ্যা। আমাদের নাম দিয়ে কেউ অপকর্ম করলে সেটা তো আমরা জানি না। কাগজপত্রবিহীন গাড়ি দেখলে আটক ও মামলা করছি নিয়মিত। প্রতিদিন মামলা দেওয়া হচ্ছে। অভিযান পরিচালনা করছি নিয়মিত।’

এই বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর ট্রাফিক পুলিশ (প্রশাসন) পরিদর্শক আশিকুর রহমান বলেন, ‘ওই এলাকায় পোশাক শ্রমিক আনা-নেওয়ায় বাস চলাচল করছে, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু গাড়ির কাগজপত্র ছাড়া কোনো রাস্তায় চলতে পারে না।’

মানিক নামের ব্যক্তি টিআইয়ের ‘টেন্ডল’ পরিচয়ে টাকা তোলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। যদি এই ধরনের কিছু হয়ে থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!