সাড়ে ৬ হাজার বছর পর এলো ধূমকেতু নিওওয়াইজ, দেখা যাবে বাংলাদেশ থেকেও

৬ হাজার ৮০০ বছর আগে শেষবার পৃথিবীকে দেখে গিয়েছিল সে। এরপর আবার এলো। মানবজাতি সৃষ্টির পর এই সে পৃথিবীকে দেখছে। সৌরমণ্ডলের একেবারে শেষ প্রান্ত থেকে দৌড়তে দৌড়তে সে আবার এসে পড়েছে পৃথিবীর কাছাকাছি। সাড়ে ৬ হাজার বছরেরও বেশি সময় পর! এতটাই কাছাকাছি যে, তাকে এবার খালি চোখেও দেখা যাবে— এমনকি বাংলাদেশ থেকেও। মঙ্গলবার (১৪ জুলাই) থেকে টানা ১৮ দিন তো বটেই। আকাশের উত্তর-পশ্চিম দিকে তাকে দেখা যাবে প্রতিদিন অন্তত ঘণ্টাখানেক ধরে— সূর্যাস্তের পরপরই। এমন ঘটনা পৃথিবী আবার দেখতে পাবে সাড়ে ৬ হাজার বছর পর।

এই বিরল মহাজাগতিক আগন্তুক আসলে একটি ধূমকেতু। যার বৈজ্ঞানিক নাম ‘সি/২০২০-এফ-৩’। তবে ‘নিওওয়াইজ’ নামেই তার পরিচিতি বেশি। মাত্র সাড়ে তিন মাস আগে, গত ২৭ মার্চ এই আগন্তুকটি প্রথম নজরে পড়ে নাসার উপগ্রহ ‘নিওওয়াইজ’-এর। তাই আবিষ্কারের পর উপগ্রহটির নামেই সে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, বিরল এই ধূমকেতুটি সবচেয়ে উজ্জ্বলভাবে দেখা যাবে ১৪ জুলাই থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত। সূর্যাস্তের ঠিক পরের এক ঘণ্টা ধরে। উত্তর-পশ্চিম আকাশে, দিকচক্রবালের কাছে। আবিষ্কারের পর থেকে এত দিন নিওওয়াইজ-কে মোটামুটি উজ্জ্বলভাবে উত্তর-পূর্বের আকাশে দেখা যাচ্ছিল সূর্যোদয়ের ঘণ্টাখানেক আগে। এই শতাব্দীতে আর কোনও ধূমকেতুকে এর আগে এত উজ্জ্বলভাবে দেখার সুযোগ মেলেনি।


ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন থেকে ধূমকেতু নিওওয়াইজকে যেভাবে দেখা গেল

সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতেই সাড়ে ৬ হাজার বছর পর নিওওয়াইজ এসেছিল সৌরমণ্ডলের শেষ প্রান্তে থাকা ফুটবলের মতো বরফের পুরু আস্তরণ ‘উর্ট ক্লাউড’ থেকে। সূর্যের কাছাকাছি এলে ধূমকেতুদের নিউক্লিয়াস থেকে ধুলোবালি জমা পুরু বরফ গলতে শুরু করে সূর্যের তাপে। তখন সেই বরফকণা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে থাকে মহাকাশে। তার ফলেই পুচ্ছ বা লেজ (‘কামেট্‌স টেল’) তৈরি হয় ধূমকেতুর। এই লেজই সবার নজর কাড়ে।

ধূমকেতুটির ইতিমধ্যেই সূর্যকে প্রদক্ষিণ করা হয়ে গিয়েছে। এবার সে ফিরে যাচ্ছে তার নিজের জায়গা— সৌরমণ্ডলের শেষ প্রান্তে থাকা উর্ট ক্লাউডে। নিজের মুলুকে ফেরার সেই পথেই আগামী ২২ জুলাই নিওওয়াইজ সবচেয়ে কাছে আসবে পৃথিবীর। সে দিন পৃথিবী থেকে নিওওয়াইজের দূরত্ব হবে মাত্র ১০ কোটি ৩০ লক্ষ কিলোমিটার।

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, ধূমকেতুটিকে সবচেয়ে বেশিক্ষণ ঘণ্টাখানেকেরও বেশি সময় ধরে দেখা যাবে আগামী ৩০ জুলাই— সপ্তর্ষি মণ্ডলের নিচে। তবে জুলাই শেষ হয়ে গেলে আর এই ধূমকেতুটিকে খালি চোখে দেখা যাবে না। তখন বাইনোকুলার দিয়ে দেখতে হবে তাকে। সূর্যাস্তের পর মোটামুটিভাবে উত্তর-পশ্চিম আকাশে ধূমকেতুটিকে টেলিস্কোপ বা বাইনোকুলার দিয়ে দেখা যাবে আগস্ট পর্যন্ত।

এর আগেও এমন আগন্তুকরা এসেছে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে। তাদের কেউ আমাদের নজরে পড়েছে, কেউ পড়েনি। কাউকে দেখা গিয়েছে শুধু টেলিস্কোপেই। আর কেউবা দৃশ্যমান হয়েছে খালি চোখেও। ১৯৬৫ সালে টেলিস্কোপে দেখা গিয়েছিল ‘ইকেয়া সাকি’ ধূমকেতুটিকে। তারপর ১৯৮৬ সালে খালি চোখে দেখা গিয়েছিল ‘হ্যালির ধূমকেতু’কে। ১০ বছর পর ১৯৯৬-তে টেলিস্কোপের নজরে ধরা দিয়েছিল ‘হায়াকাতুকে’। তার ১১ বছর পর ১৯৯৭ সালে খালি চোখে দেখা গিয়েছিল ‘হেল বপ’ ধূমকেতু। আর সাত বছর আগে টেলিস্কোপে ধরা দিয়েছিল ধূমকেতু ‘প্যান স্টার’।

সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে ধূমকেতুগুলি আসে সাধারণত সৌরমণ্ডলের দু’টি এলাকা থেকে। একটি- ‘কুইপার বেল্ট’। ইউরেনাস, নেপটুন, প্লুটোর পর বরফের সাম্রাজ্য। সেখান থেকে যে ধূমকেতুগুলি আসে সেগুলি ‘অল্প পাল্লা বা শর্ট রেঞ্জের। এর মানে, সেগুলো ২০০ বছরের মধ্যে আবার ফিরে আসে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে। আর ২০০ বছরেরও বেশি পরে যেগুলো ফিরে আসে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে, সেগুলো আসে সৌরমণ্ডলের একেবারে শেষ প্রান্তে থাকা সেই বরফের মহাসাম্রাজ্য উর্ট ক্লাউড থেকে। এগুলো দূরপাল্লা বা লং রেঞ্জের। এগুলো আবার দুই ধরনের হয়ে থাকে। কোনো কোনোটি সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে আসে সূর্যের কাছেই বিলীন হয়ে যায়। কোনোটি আবার সূর্যের কাছে এসে সৌরতাপে হারায় তার বরফের মাথা। আবার কেউ ফিরে যায় তার নিজের আবাস উর্ট ক্লাউডেই।

এসব দিক থেকে নিওওয়াইজের ভাগ্য কিছুটা ভালই বলতে হবে। হয়তো তার বরফের মাথাটাও অনেক বেশ শক্তপোক্ত। তাই এ বার প্রদক্ষিণ করতে এসে ধূমকেতুটি সূর্যের সাড়ে ৪ কোটি কিলোমিটারের মধ্যে চলে এলেও তাকে সূর্যের কাছে ঝাঁপ মারতে হয়নি। সূর্য খণ্ডবিখণ্ড করে দিতে পারেনি তার বরফের মাথা। কিছু ক্ষতি তো অবশ্য হয়েছেই, না হলে কোটি কোটি কিলোমিটার লম্বা তার বরফের লেজটা তৈরিই হত না যে! তবে ভাগ্য ভাল নিওওয়াইজের, সূর্যের এতটা কাছে এসেও নিজের আবাসে ফেরার পথ ধরতে পেরেছে সে।

ঘরে ফেরার পথে কি সভ্যতাকে শেষবারের মতো দেখা দিয়ে যাচ্ছে নিওওয়াইজ? আবার যে সে ফিরে আসবে সাড়ে ৬ হাজার বছর পর! তখন কি আর এই পৃথিবী থাকবে?

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!