মৃত্যুর পরও চট্টগ্রামের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ম্যাক্সনের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, কবর হয়েছে কলকাতায়

চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী নূর নবী ম্যাক্সনের অর্ধগলিত লাশ দাফন করা হয়েছে কলকাতায়। তবে আদালত ও পুলিশের তথ্য অনুযায়ী তিনি পলাতক আসামি। এর মধ্যে ডাকাতি মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন চট্টগ্রামের একটি আদালত।

সূত্র জানায়, গত সোমবার (৯ জানুয়ারি) নূরনবী ম্যাক্সনের স্ত্রী ফারজানার উপস্থিতিতে শরিয়াহ মোতাবেক তার দাফন কার্য সম্পন্ন হয়েছে কলকাতায়। বাংলাদেশ হাই কমিশন বরাবর লাশ দেশে আনার চেষ্টা করলে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তার পরিবারের। এছাড়া গণমাধ্যমে এই শীর্ষ সন্ত্রাসীর মৃত্যুর সংবাদের কারণে হাসপাতাল থেকে লাশ পেতেও বেশ বেগ পেতে হয়েছে তাদের। ব্যাপক সমস্যার কারণে তার অর্ধগলিত লাশ সেখানেই দাফন করা হয়।

নূর নবী ম্যাক্সনের লাশ দেশে আনা হয়নি বলে নিশ্চিত করেছেন তার স্ত্রী ফারজানা। তিনি বলেন, ‘ম্যাক্সনের বিষয়ে আমরা আর কোনো কথা বলতে চাইছি না। আমাদের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আর টানাটানি করবেন না। গণমাধ্যমের কারণে আমরা দুঃখে পড়েছি। পরিবারের পক্ষ থেকে যা ব্যবস্থা গ্রহণ করার, তা আমরা করেছি। তবে এই বিষয়ে গণমাধ্যমকে কিছু জানাতে আমরা আগ্রহী না।’

ম্যাক্সনের লাশ দেশে আনা হবে কি-না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা পরিবার থেকে লাশ আনতে চাইছি না। আমরা বিষয়টি সে দেশেই সমাধান করে ফেলবো বা করে ফেলেছি।’

ফারজানা বলেন, ‘ম্যাক্সনকে চট্টগ্রামের ত্রাস বানিয়েছে প্রথম আলোর এক সাংবাদিক। সে কোথাও খুন করেনি, চাঁদাবাজি করেনি। ম্যাক্সনের জীবন শেষে করেছে মিডিয়া এবং পত্রিকা। এছাড়া যে মারা গেছে তাকে নিয়ে আপনারা আর লেখালিখি করবেন না। আমার সন্তানদের দিকে তাকিয়ে আপনারা বিষয়টি আর ঘোলা করবেন না। কারণ ম্যাক্সনের জীবন শেষ করেছে পত্রিকা। তাকে ওয়ান্টেড বা মোস্ট ওয়ান্টেড করেছে এসব পত্রিকা। আমার সন্তানদের নিয়ে বাঁচতে হবে।’

নগরীর বায়েজিদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফেরদৌস জাহানের কাছে ম্যাক্সনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অফিসিয়ালি আমাদের হিসেবে ম্যাক্সন পলাতক আসামি। তার মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমের কারণে জেনেছি।’

এদিকে গত মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) বিসিক শিল্প এলাকার এক গার্মেন্টের কাপড় ডাকাতির মামলায় চট্টগ্রাম দ্বিতীয় যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মুহাম্মদ ছালামত উল্লাহ নূরনবী ম্যাক্সনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। একই মামলায় সরোয়ার হোসেনকে জামিন দেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন আদালতের বেঞ্চ সহকারী ফারুক।

এর আগে গত বছরের ২৯ নভেম্বর কলকাতা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার হরিদেবপুর থানার কালিগঞ্জে একটি আবাসিক ভবন থেকে তমাল চৌধুরী নামে এক ব্যক্তির ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর এমআর বাঙ্গুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

ওই সময় পরিবারের পক্ষ থেকে জানায়, অনামিকার সহযোগিতায় তমাল চৌধুরী নামে ভারতে জাতীয় পরিচয়পত্রের আবেদন করেন ম্যাক্সন। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কালিগঞ্জে কখনও রঙমিস্ত্রি, কখনও মাছ ব্যবসায়ী হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ভারতে পরিচয়পত্র বানাতে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেন স্ত্রী পরিচয়ে থাকা ওই নারী। তার দাবি অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে আমরা চার লাখ টাকা পাঠাই। বাকি এক লাখ টাকা দিতে না পারায় ভারতে ম্যাক্সনের সঙ্গে থাকা সেই নারীই ম্যাক্সনকে খুন করেছেন। মদের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাইয়ে অচেতনের পর, বালিশচাপায় খুন করে লাশ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেয় ওই নারী।

অন্য একটি সূত্র জানায়, ম্যাক্সন ভারতে থাকাকালীন তার বাংলাদেশি স্ত্রী ফারজানার বেশ যাতায়াত ছিল সেখানে।

তার মৃত্যুর সংবাদের পর পুলিশ সূত্র জানায়, ভারতে অনুপ্রবেশ, বেআইনিভাবে বসবাস এবং জালিয়াতির মাধ্যমে কাগজপত্র তৈরির অভিযোগে ব্যারাকপুর থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে সেই দেশের পুলিশ। এর আগে গত বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর চব্বিশ পরগনার বারানগর থানার ডানলপ এলাকা থেকে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন ম্যাক্সন। এরপর থেকে ছড়িয়ে পড়ে ম্যাক্সনের ভারতে অবস্থান খবর।

ম্যাক্সন নগরীর বায়েজিদ থানার জাহানপুর এলাকার আলতাফ মিয়া বাড়ির আবদুল লতিফের ছেলে। তার বিরুদ্ধে নগরের বিভিন্ন থানায় ৭টি অস্ত্র মামলা, ১৫টি চাঁদাবাজিসহ ২২টি মামলা রয়েছে। এছাড়া অস্ত্র মামলায় ২১ বছরের সাজাও হয় তার।

২০১১ সালে একটি ডাকাতির মামলায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ম্যাক্সনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে মানিকজোড় খ্যাত ম্যাক্সনের সহচর সারোয়ারকেও গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে একে-৪৭ রাইফেলসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধারের পর আলোচনায় আসেন তারা। সেই মামলায় ২০১৭ সালে কারগার থেকে জামিনে বেরিয়ে কাতারে পালিয়ে যান দুজন।

২০১৯ সালে অক্সিজেন নয়াহাট এলাকার একজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চাঁদা দাবি ও হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগে ম্যাক্সনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এরপর ২০২০ সালে চাঁদার টাকার ভাগাভাগি নিয়ে কাতারে সরোয়ারের সঙ্গে ম্যাক্সনের মারামারির ঘটনায় সেই দেশের পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে দেশে পাঠিয়ে দেন। একই বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সারোয়ারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তবে ওই সময় ম্যাক্সনকে পাওয়া যায়নি।

আরও জানা গেছে, বাংলাদেশে পাঠানোর সময় কাতার এয়ারপোর্ট থেকে কৌশলে ভারতে পালিয়ে যান ম্যাক্সন। সেখানে এক পরিচিতের মাধ্যমে তমাল চৌধুরী নামে মাছের ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করছিলেন চট্টগ্রামের এক সময়ের দুর্ধর্ষ এই সন্ত্রাসী।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!