চট্টগ্রামের ৭ জায়গায় মেয়েদের মধুচক্রের আড়ালে ভয়ানক ফাঁদ, বিত্তবানরাই মূল টার্গেট

নিরিবিলি ফ্ল্যাট ভাড়া করে চলে ভয়ংকর সব প্রতারণা

চট্টগ্রাম নগরীতে বেড়েছে নারী প্রতারকচক্রের দৌরাত্ম্য। সুন্দরী তরুণী দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে কৌশলে ফাঁদে ফেলে মোটা অংকের টাকা থেকে মূল্যবান জিনিস হাতিয়ে নেয় এই চক্র। বিশেষ করে নগরীর সাত এলাকায় এই চক্রের দাপট বেশি। থানা পুলিশ ও প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে তারা এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে নিশ্চিন্তে। মাঝেমধ্যে অভিযানে কয়েকজনকে ধরা হলেও দু’দিন পর জামিনে বেরিয়ে আবারও একই কাজে জড়িয়ে পড়ে তারা।

এসব কাজে নারীদের সঙ্গে অপরাধের নেপথ্যে নিয়ন্ত্রণে থাকে পুরুষও। টাকা দিলেও মান-সম্মানের ভয়ে ভুক্তভোগীরা থানায় অভিযোগ করার সাহস পান না। গত এক বছর ধরে এভাবে ৭-৮টি নারী প্রতারকচক্র দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নগরী। সম্প্রতি জামিনে বেরুনো এমন এক চক্রের সদস্যের কাছ থেকে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

জানা গেছে, পাঁচলাইশ থানার সুগন্ধা আবাসিক ও মোহাম্মদপুরে শাহবাজ, দুলাল; আকবরশাহ থানার বিশ্বকলোনিতে জাহিদ; হালিশহর থানার চুনা ফ্যাক্টরি এলাকায় আরমান ও হোসনা; বায়েজিদ এলাকায় মহিউদ্দিন; ইপিজেড এলাকায় রিয়াদ, ঝন্টু, বৃষ্টি, মালা ও আঁখি এবং ডবলমুরিংয়ের আগ্রাবাদ এলাকায় সুমন, রেশমা, তানিয়ার নেতৃত্বে চলে প্রতারণা।

এছাড়া নগরী অভিজাত এলাকা খুলশী ও ফয়’স লেক এলাকার কিছু বিলাসবহুল ফ্ল্যাটেও এসব অনৈতিক কাজ হয় বলে জানা গেছে।

গত ৩১ ডিসেম্বর পাঁচলাইশের মুরাদপুরে কথা হয় জামিন পাওয়া চক্রের এক ২২ বছর বয়সী তরুণীর সঙ্গে। তার কাছ থেকেই জানা গেছে এসব তথ্য।

ওই তরুণী আরও জানায়, বিভিন্ন এলাকায় নিরিবিলি পরিবেশে ফ্ল্যাট ভাড়া করে চলে এসব অপরাধ। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে একসঙ্গে দুটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া হয়। এরপর এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যক্তিদের টার্গেট করা হয়। এরপর কৌশলে তৈরি করা হয় সুসম্পর্ক। তারপর সময় বুঝে তাদের নিয়ে আসা হয় মধুচক্রের। সেখানে এসে টার্গেট করা ব্যক্তিদের আটকে রেখে আপত্তিকর ছবি তোলা হয়। সেসব ছবির পরিবর্তে বিকাশ বা নগদের মাধ্যমে নেওয়া হয় মোটা অংকের মুক্তিপণ। এভাবে প্রতিমাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতারকচক্র।

টাকা নেওয়ার কাজ শেষ হলে এক ফ্ল্যাট থেকে অপকর্ম করে চলে যায় আরেক ফ্ল্যাটে। পরে পুলিশে গেলেও সঠিক পরিচয় না থাকায় ধরা যায় না অপরাধীদের।

গত ৪ জানুয়ারি নগরীর পাঁচলাইশ থেকে প্রতারকচক্রের তিন সদস্য—সজীব (২২), সাকিব (২১) ও সুমনকে (২০) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা এভাবে এক ব্যক্তিকে নারীর ফাঁদে ফেলে আদায় করে নেয় এক লাখ টাকা।

২০২২ সালের ৬ ডিসেম্বর এক ভুক্তভোগীর তথ্যের ভিত্তিতে হালিশহরের চুনা ফ্যাক্টরি এলাকার একটি ভবনে প্রতারকচক্রের পরিচয়ের সত্যতা জানতেন যান এক গণমাধ্যমকর্মী। সেখানে ওই প্রতারকচক্রের সদস্যকে ফোন দেন। এরপর ওই ব্যক্তি কোমরে ওয়াকিটকি নিয়ে নারীসহ নিচে নেমে নিজেকে হালিশহর থানার এসআই আরমান নামে পরিচয় দেন। পরে ওই গণমাধ্যমকর্মীকে লাঞ্ছিত করেন।

ওই গণমাধ্যমকর্মী থানায় ফোন দিয়ে জানতে পারেন, ওই লোক ভুয়া পুলিশ। এরপর থানায় গিয়ে লিখিত অভিযোগ দেন তিনি। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে হালিশহর ‘এল’ ব্লক থেকে আরমান হোসেনকে (২৭) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার তথ্যমতে, নারী চক্রের সদস্য হোসনা বেগম (৩৫) ও জেসমিন আক্তার নুসরাতকে (২৩) গ্রেপ্তার করা হয়। এই চক্রের আশ্রয়দাতা হালিশহরের ডিগল নামের এক নগর যুবলীগ সদস্য বলে জানায় তারা।

এর আগে ২০২২ সালের ২৮ অক্টোবর পাহাড়তলীর অলঙ্কার শপিংয়ের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীর নগ্ন ছবি তুলে দেড় লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় নারী প্রতারকচক্র। পরে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ফিরোজা (৩৫), মীম (২২), সেলিম (৩৭), আমিনুল (৩৩), নুরুল ইসলামকে (৩৭) গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

ইমোতে টোপ ফেলে আপত্তিকর ভিডিও

চট্টগ্রাম-ঢাকায় সংঘবদ্ধ একটি চক্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইমো ও মেসেঞ্জার ব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এই প্রতারকচক্রে মেয়েরাও সক্রিয়। প্রতারকদের এই চক্রটি শুরুতে বন্ধুত্বের টোপ ফেলে ইমোতে যোগাযোগ করে ঘনিষ্ঠ হয়। সম্পর্কের একপর্যায়ে তাদের একান্ত সময়ের ভিডিও আর আপত্তিকর ছবি ধারণ করে রাখে বিশেষ কৌশলে। এরপর অনলাইনে সেসব ফাঁস করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইলিং করে টাকা হাতিয়ে নেয়। চক্রটি এজন্য ইমো-ফেসবুক-মেসেঞ্জারে অনেকগুলো আইডি ব্যবহার করে। টার্গেট করা ব্যক্তি থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর তারা ওই আইডিগুলো পুরোপুরি নষ্ট করে দেয়। সম্প্রতি এ ধরনের একাধিক ঘটনা সম্পর্কে অভিযোগ পেয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির সাইবার টিম অনুসন্ধানে নামে।

রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন চিকিৎসক সাইবার পুলিশ সেন্টারের ফেসবুক পেজে অভিযোগ করেন, অজ্ঞাতনামা এক লোক তার এবং তার প্রাক্তন স্ত্রী মারিয়া ইসলাম নিকিতার একান্ত মূহূর্তের ভিডিও তার টেলিগ্রাম এবং তার বর্তমান স্ত্রীর ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে পাঠিয়ে জানায়, তাদের দাবি করা টাকা না দিলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওই ভিডিওগুলো ভাইরাল করে দেওয়া হবে। সাইবার পুলিশ সেন্টার (সিপিসি) এই অভিযোগ পেয়ে অনুসন্ধানে নামে। অভিযোগের সত্যতা পেয়ে গত ৫ ডিসেম্বর ঢাকার কাফরুল থেকে তমালিকা আক্তার (২৪) নামে এক তরুণী এবং সিআইডি চট্টগ্রামের একটি টিমের সহায়তায় খুলশী থানা এলাকা থেকে আবু সাঈদ রনি (২৮) নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করে।

পরে প্রতারকচক্রের এই সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেছে, তারা বিভিন্ন ব্যক্তিকে টাকার বিনিময়ে ইমো ও ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে ভিডিও কলে আসতে প্রলুব্ধ করে। এ সময় তারা বিশেষ মূহূর্তগুলো গোপনে ধারণ করে রাখে।

চট্টগ্রামের রনি ও ঢাকার তমালিকা দুজনেই সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তারা দীর্ঘদিন ধরেই ঢাকা ও চট্টগ্রামে অবস্থান করে আরও অনেকের সঙ্গে এভাবে ইমো ও ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে ভিডিওকলে আপত্তিকর মুহূর্ত রেকর্ড করে রেখে তাদের ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

তবে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের (সিএমপি) দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘চট্টগ্রামে এমন কয়েকটি চক্র আছে। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ না করায় পার পেয়ে যায় এসব অপরাধীরা। এছাড়া এসব চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে হয়রানির মিথ্যা অভিযোগ এসে ওসি ক্লোজড হওয়ার মতো ঘটনাও দেখেছি।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!