বান্দরবান এখন ‘বড় ফ্যাক্টর’ রহিমা নিখোঁজের রহস্যে

খুলনার আলোচিত রহিমা বেগম নিখোঁজের ঘটনায় বান্দরবানই এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে। হঠাৎ ‘নিখোঁজ’ হওয়ার পর কয়েক জায়গা ঘুরে রহিমা চলে গিয়েছিলেন বান্দরবান সদরের ইসলামপুরে। পিবিআইয়ের কাছে রহিমা বেগম জানিয়েছিলেন, ২৭ আগস্ট রাতে অপহরণ হওয়ার পর হুঁশ ফিরে সাইনবোর্ড পড়ে দেখেন তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে রয়েছেন। কিভাবে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন, কে তাকে নিয়ে গিয়েছিল বা আদৌ গিয়েছিলেন কিনা— পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তারা এখন সেসব তথ্য যাচাই করে দেখবেন। এরপরই ‘নিখোঁজ’ রহস্যের কিনারা মিলবে বলে আশা করছে সংস্থাটির কর্মকর্তারা।

তবে এখন পর্যন্ত পাওয়া তদন্তে পিবিআই রহিমা বেগমের স্বামী বেল্লাল ঘটক ওরফে বেলাল হাওলাদারকেই সন্দেহ করছে। এ পর্যন্ত পিবিআইয়ের কাছে এবং আদালতে রহিমা বেগম যেসব তথ্য দিয়েছেন তা ‘সঠিক নয়’ বলে মন্তব্য করেছে পিবিআই। তদন্ত কর্মকর্তা ফরিদপুর ঘুরে এখন বান্দরবান যাবেন তথ্য উদঘাটনে।

বুধবার (২৮ সেপ্টেম্বর) খুলনা পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘রহিমা বেগম জানিয়েছিলেন, ২৭ আগস্ট রাতে অপহরণ হওয়ার পর হুঁশ ফিরে সাইনবোর্ড পড়ে দেখেন তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে রয়েছেন। সেখান থেকে তিনি বান্দরবান এলাকার মণি বেগমের ভাতের হোটেলে চাকরি করেছেন। হোটেল মালিক তাকে স্থানীয় একটি ক্যাম্পে চাকরি দেওয়ার কথা বলেন। চাকরির জন্য তার জন্মনিবন্ধন ও এনআইডি কার্ডের প্রয়োজন। জন্মনিবন্ধন ও এনআইডি কার্ডের জন্য তিনি সরাসরি চলে আসেন ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামে তার পূর্ব পরিচিত কুদ্দুস মোল্লার বাড়িতে। সেখানে অবস্থান করে ১৬ সেপ্টেম্বর যান সৈয়দপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল হকের কাছে। সেখানে গিয়ে তিনি বলেন, “আমার জন্ম হয়েছে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামে। কর্মের তাগিদে বাগেরহাটে থাকি। সেখানে গৃহপরিচারিকার কাজ করি।” এতে সন্দেহ হওয়ায় তাকে জন্মনিবন্ধন ও এনআইডি দেওয়া হয়নি।’

মা রহিমা বেগমের ‘নিখোঁজ’ হওয়া নিয়ে তার মেয়ে মরিয়ম আক্তার ওরফে মরিয়ম মান্নান বলেন, ‘দেখুন আমার মা হারিয়েছে, আমরা খুঁজেছি তাকে। খুঁজতে হবে তাকে। আমার মনে হচ্ছে, মা অপহরণ হননি। তবে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে এমন কাজ— এটা ভাবা ভুল। আমার মা নিজের জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ। তিনি আমাদের ওপর রাগ করে গিয়েছেন। অভিযোগ আমাদের ওপর। আর একটা কথা, মা ভাবেননি আমরা মামলা করবো। মামলায় সরাসরি কারও নাম আমরা দিইনি। পুলিশ যখন বলেছে, আমরা কাদের সন্দেহ করি, তখন যাদের সঙ্গে বিরোধ ছিল তাদের নাম সন্দেহ তালিকায় আনা হইছে। এখন মা আমাকেও সন্দেহ করছেন। আমার মায়ের যত্ন নেওয়া এখন সব থেকে জরুরি। মায়ের পাশে থাকার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই নেই। আসলে আমি মায়ের পাশে থাকতে চাই।’

তিনি বলেন, ‘মায়ের নিখোঁজের বিষয়ে আমার এবং আমার পরিবারের কোনও সম্পর্ক নেই। তারপরও প্রশাসনকে বলবো তদন্ত করতে। আমি এবং আমরা যদি জড়িত থাকি, আমাদের বিচারের আওতায় আনা হোক। মাকে খোঁজা কোনও অন্যায় না। আপনার মা হারালে আপনিও খুঁজতেন।’

মরিয়ম বলেন, ‘কীভাবে বুঝবো মা একা একা চলে গেছেন, আমাদের ছেড়ে, আর ফিরবেন না! জানলে কোনোদিন জিডি মামলায় যেতাম না। ডাক্তার দেখাতে গিয়ে আমার প্রথম মনে হয়েছে মা অপহরণ হননি। কারণ যখন ডাক্তার জিজ্ঞেস করছিলেন কী হয়েছে, তিনি বলেছেন তাকে মেরেছে। এক বছর আগে তাকে যারা যেভাবে মেরেছিল সেই ব্যাখ্যা করছেন মা। মাকে দেখে ভয় পাচ্ছি। মা আমাকে অবিশ্বাস করছেন। এখন মিডিয়া বা কারও সামনে আসতে চান না। মায়ের যত্ন নেওয়াটা জরুরি।’

এর আগে রহিমা বেগমের পরিবার দাবি করে, ২৭ আগস্ট রাত সাড়ে ১০টার দিকে পানি আনতে বাড়ি থেকে নিচে নামেন রহিমা বেগম (৫২)। একঘণ্টা পার হলেও তিনি বাসায় ফিরে আসেননি। পরে মায়ের খোঁজে সন্তানরা সেখানে গিয়ে তার ব্যবহৃত স্যান্ডেল, ওড়না ও কলস রাস্তার ওপর পড়ে থাকতে দেখেন। রাতে সম্ভাব্য সব স্থানে সন্ধান নেওয়ার পর সন্তানরা মাকে পাননি। এরপর সাধারণ ডায়েরি ও পরে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে দৌলতপুর থানায় মামলা দায়ের করে পরিবার। এ মামলার তদন্তকালে পুলিশ ও র‌্যাব ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬ জনকে গ্রেফতার করে। তারা হলেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) প্রধান প্রকৌশল কার্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী মো. গোলাম কিবরিয়া, রহিমার দ্বিতীয় স্বামী বেল্লাল ঘটক ওরফে বেলাল হাওলাদার, দৌলতপুর মহেশ্বরপাশা বণিকপাড়া এলাকার মহিউদ্দিন, পলাশ, জুয়েল ও হেলাল শরীফ।

২২ সেপ্টেম্বর রহিমার মেয়ে মরিয়ম আক্তার ওরফে মরিয়ম মান্নান দাবি করেন, তার মায়ের লাশ তিনি পেয়েছেন। তিনি ২৩ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহের ফুলপুরে দিনভর অবস্থান নেন এবং ব্যস্ততম সময় অতিবাহিত করেন। একই সঙ্গে সেখানে ১০ সেপ্টেম্বর উদ্ধার হওয়া অজ্ঞাত এক নারীর লাশকে নিজের মা বলে শনাক্ত করেন এবং ডিএনএ প্রোফাইল করার জন্য সম্মত হন। আদালত ২৫ সেপ্টেম্বর শুনানি শেষে ডিএনএ প্রোফাইল করার অনুমতি দেন।

এর মধ্যেই ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে ফরিদপুরের বোয়ালমারি উপজেলার সৈয়দপুর থেকে রহিমা বেগমকে জীবিত উদ্ধার করে পুলিশ। ২৫ সেপ্টেম্বর বিকালে আদালতে সোপর্দ করা হলে রহিমা ২২ ধারার জবানবন্দিতে তিনি অপহরণ হয়েছিলেন বলে দাবি করেন। এরপর সন্ধ্যায় আদালত বাদী আদুরীর জিম্মায় তাকে মুক্তি দেন। এরপর ওই রাতেই মেয়ে মরিয়ম ও আদুরী তাদের মাকে নিয়ে ঢাকায় চলে যান। ঢাকায় রহিমা বেগমের চিকিৎসা চলছে।

এদিকে রহিমা বেগমের স্বামী বেলাল হাওলাদারকে জিজ্ঞাসাবাদের পর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে আশা প্রকাশ করে খুলনা পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা এই মামলায় একমাত্র রহিমার দ্বিতীয় স্বামী বেলাল হাওলাদারকেই সন্দেহ করছি। এরপর এই মামলা বা ভিকটিম রহিমা, মেয়ে মরিয়ম ও বাদী আদুরীসহ অন্যদের ব্যাপারে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে আদালতই নির্দেশ দেবেন।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!