টানা কয়েকদিনের ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারের শহর ও চকরিয়ার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লক্ষাধিক মানুষ। তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট, ফসলি জমি। ফলে কেউ ঘর থেকে বের হতে পারছেন না লোকজন। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ।
টানা বৃষ্টিতে সদরের পৌর শহর, ঝিলংজা, রামুর গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, মিঠাছড়ি, কাউয়ারখোপ, ফঁতেখারকুল, চাকমারকুলসহ বিভিন্ন এলাকার রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। এছাড়া কক্সবাজারের ৮ উপজেলার নিচু এলাকায় বৃষ্টির পানি ও পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। কিছু কিছু এলাকার মাছের ঘের পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ভয়াবহ বন্যার পানিতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন রামু উপজেলার মানুষ। টানা বৃষ্টিতে উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে প্রায় সবগুলোই প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, কাউয়ারখোপসহ চার-পাঁচটি ইউনিয়নের অবস্থা ভয়াবহ। এসব এলাকায় চার থেকে পাঁচ ফুট পানি উঠেছে। বাঁকখালী নদীর পানি বিপদসীমার দেড় মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, ভারি বর্ষণে বাঁকখালী নদী দিয়ে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ডুবে গেছে ফসলি জমি ও সড়ক। পানিতে তলিয়ে গেছে আউশ ধানের বিস্তীর্ণ বীজতলা। পানিবন্দি মানুষ গবাদি পশু আর আসবাপত্র নিয়ে বাঁধের উপর আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে ঝুপড়ি ঘর তুলে রাত যাপন করছেন তারা। এছাড়া পানি উঠে পড়ায় রামুর সাথে গর্জনিয়া-কচ্ছপিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি সড়ক দিয়ে যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। তলিয়ে গেছে অনেক ফসলি জমি।এই সব এলাকায় স্থানীয়দের অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে শহরে ও আশাপাশের উপজেলার আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় খাবার এবং পানীয় জলের অভাব দেখা দিয়েছে ওই এলাকায়। রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় নৌকা দিয়ে পারাপার হচ্ছে মানুষ। ফসলের ক্ষেত, গোলার ধান, মৎস্য খামার, পশু ও বসতবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে গবাদিপশুর।
লিংকরোড এলাকার দোকানি শাহী কামরান বলেন, টানা বৃষ্টিতে বেচাকেনা নেই। তারপরও দোকান খুলে বসে আছি।
সদর উপজেলার দরগাহ গ্রামের আমিন বলেন, মাছের ঘের পানিতে ঢুবে গেছে। সাথে ঘেরের বেড়িতে থাকা সবজি পানিতে তলিয়ে গেছে। রোদ উঠলে সবজি গাছ মরে যাবে বলে তিনি জানান।
ঝিলংজার ইউপি চেয়ারম্যান টিপু সুলতান বলেন, ইউনিয়নের কয়েকটি এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য উপজেলা প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকেও সহায়তা করা হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন এলাকার মাছের ঘেরও ভেসে গেছে। সবজি ক্ষেতও নষ্ট হয়ে গেছে বলে তিনি জানান।
রামু উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা প্রণয় চাকমা বলেন, বাঁকখালী নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে বেড়িবাঁধের উপর দিয়ে পানির স্রোতের রামুর বিভিন্ন রাস্তাঘাট বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। দুর্গতদের মাঝে এ পর্যন্ত শুকনা খাবার ও বিভিন্ন সহায়তা দেয়া হয়েছে। আরও সহায়তা দেয়ার প্রস্তুতি প্রশাসনের রয়েছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আশরাফুল আফসার জানিয়েছেন, টানা কয়েক দিনের বৃষ্টির ফলে কক্সবাজার শহরের নিম্নাঞ্চলসহ জেলার অনেক জায়গায় পানি জমে আছে।
তিনি জানান, ভারি বর্ষনের ফলে পাহাড় ধসের আশঙ্কা রয়েছে। জেলা প্রশাসন বিষয়টি মনিটর করছে। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সতর্ক করা হয়েছে। প্রয়োজনে তাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনা হবে।
এদিকে তিনদিনে টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি প্রবেশ করে চকরিয়ার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। মাতামুহুরী নদীতে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করায় বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এছাড়া পাহাড় ধসেরও সম্ভাবনা রয়েছে। ছড়াখাল ও নদী অত্যধিক ভরাট হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টি ও ঢলের পানি ভাটির দিকে নামতে পারছেনা। ফলে চকরিয়া পৌরসভাসহ উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের অন্তত ২০টি গ্রামে ভয়াবহ জলাবদ্ধতায় দেখা দিয়েছে। এতে পানিবন্দি রয়েছে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। পাশাপাশি ওইসব ইউনিয়নের গ্রামীন রাস্তাগুলো পানি নিচে তলিয়ে থাকায় যোগাযোগে বিপর্যয় নেমে এসেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টানা ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে চকরিয়া পৌরসভা, উপজেলার কাকারা, সুরাজপুর-মানিকপুর, বরইতলী, চিরিংগা, লক্ষ্যারচর, কৈয়ারবিল ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রামে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। ওই গ্রামগুলোর সড়কও পানির নিচে রয়েছে।
কাকারা, সুরাজপুর-মানিকপুর, বরইতলী, লক্ষ্যারচর, কৈয়ারবিল ইউপি চেয়ারম্যানরা জানান, তাদের ইউনিয়নগুলো মাতামুহুরী নদী সংলগ্ন হওয়ায় নদীতে পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে অধিকাংশ গ্রামে ঢলের পানি প্রবেশ করেছে। ফলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। রাস্তা-ঘাটসহ অধিকাংশ বসতঘরে পানি উঠেছে।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ শামসুল তাবরীজ বলেন, বৈরী আবহাওয়ার কারণে উপজেলার মাঝারি বৃষ্টিপাতে ফলে পাহাড়ি ঢলের পানিতে বন্যা ও নদী ভাঙ্গনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এছাড়া ভূমি ধসের আশঙ্কা রয়েছে। ইতোমধ্যে উপকুলের মৎস্য ঘেরের স্লুইস গেইটগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের সার্বক্ষণিক এলাকার খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থান করা লোকজনকে সমতলের নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসার জন্য নির্দেশনা দিয়েছি। বন্যার আশঙ্কা দেখা দিলে মানুষজনকে আশ্রয় কেন্দ্রে চলে যাওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
এসএ