বিজ্ঞপ্তি-নিয়োগপত্র সবই অবিকল, প্রতারণার নিখুঁত জাল চট্টগ্রামে

৫ বছরে সর্বস্বান্ত ৫৫ জন

‘তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে চট্টগ্রাম প্রতিদিন’

তাদের সব কিছুই ভুয়া। তবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব কাজই হয় আসলের মতো অবিকল! সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি থেকে শুরু করে নিয়োগপত্র দেওয়া পর্যন্ত সবই হয় আসলের মতো। তবে বিপত্তি ঘটে যখন সত্যি সত্যিই সেই নিয়োগপত্র নিয়ে চাকরিতে যোগ দিতে যান নিয়োগপ্রত্যাশীরা। তখনই তারা বুঝতে পারেন এতোদিন যা ছিল তা ভুয়া। শিকার হয়েছেন প্রতারণার। প্রতারকচক্রের জালে পড়ে হারিয়েছেন সর্বস্ব। এমন করে ওই প্রতারকচক্র একে একে চট্টগ্রাম বন্দর, কাস্টমস, এনবিআর ও সেনাবাহিনীতে চাকরি দেওয়ার নাম করে গত ৫ বছরে মোট ৫৫ জনের সঙ্গেই প্রতারণা করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

গত সেপ্টেম্বরে এমনই এক প্রতারকচক্রের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খোয়ানো তিন ব্যক্তি সাইফুল, গফুর ও মিলনের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) চট্টগ্রাম মেট্রো। গত ১২ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে একজনকে এবং ১৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের পাঠানটুলী এলাকার একটি হোটেল থেকে এই চক্রের অপর ২ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতার প্রতারকরা হলেন ঝালকাঠির বড় কৈবর্ত্যখালী এলাকার মো. রিপন সিকদার (৩০), ফেনীর দক্ষিণ গুখুমা এলাকার আনোয়ারুল হোসেন প্রকাশ আতিক (৪৫) ও নারায়ণগঞ্জের চর তালিমাবাদ দক্ষিণ পাড়ার মো. তোফাজ্জল হোসেন (৫৪)। তাদের প্রত্যেককে আদালতের মাধ্যমে দুই দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি পেয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা।

লালমনিরহাটের মিলন চক্রবর্তী চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে যোগদান করতে এসে দেখেন নিয়োগপত্রের পুরোটাই ভুয়া।
লালমনিরহাটের মিলন চক্রবর্তী চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে যোগদান করতে এসে দেখেন নিয়োগপত্রের পুরোটাই ভুয়া।

এদিকে নগরীর খুলশীস্থ পিবিআই কার্যালয়ে বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) দুপুরে পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মঈন উদ্দিন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘গত ৮ সেপ্টেম্বর প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে টাকার বিনিময়ে নিয়োগপত্র নিয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে গিয়েছিলেন সাইফুল ইসলাম, আব্দুল গফুর ও মিলন চক্রবর্তী। প্রতারণার বিষয়টি জানতে পেরে তারা প্রতারক আনোয়ারুল হোসেনের নামে অভিযোগ করেন। এ সময় তারা দাবি করেছিলেন, ৮-১২ লাখ টাকার বিনিময়ে তাদেরকে ভুয়া নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছিল। বিষয়টি ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল চট্টগ্রাম প্রতিদিনসহ আরও দুটি পত্রিকায়। এরপরই উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বিষয়টি তদন্তে নামে পিবিআই। তদন্তে তথ্যের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে চট্টগ্রাম প্রতিদিনের সংবাদটি।’

তিনি আরও জানান, গত ১২ ডিসেম্বর প্রতারক চক্রের সদস্য রিপন সিকদারকে ঢাকায় আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে অপর দুই প্রতারকের নাম জানা যায়। এরপর টানা অনুসন্ধান চালিয়ে ১৭ ডিসেম্বর বিকাল ৪টায় পাঠানটুলির হোটেল পূরবী থেকে আনোয়ারুল ও তোফাজ্জলকে গ্রেফতার করা হয়। এসময় তাদের কাছে ভুয়া নিয়োগপত্র, প্রবেশপত্র, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র, পেনড্রাইভসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম পাওয়া যায়।

পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পুলিশ কর্মকর্তা সন্তোষ কুমার চাকমা জানান, জিজ্ঞাসাবাদ এবং পেনড্রাইভে থাকা তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে- ২০১৫ সাল থেকে সংঘবদ্ধ চক্রটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে টাকার বিনিময়ে নিয়োগের কথা বলে দেশের বিভিন্ন স্থান
থেকে লোক সংগ্রহ করে তাদের টাকা হাতিয়ে নেয়। এই কাজে তারা নিজেরাই বিভিন্ন পদের জন্য ভুয়া প্রবেশপত্র, প্রশ্নপত্র, উত্তরপত্র, পুলিশ ভেরিফিকেশন, নিয়োগপত্র বানিয়ে হোটেলে এনে নিয়োগপ্রার্থীর পরীক্ষা নেয়। সম্পূর্ণ টাকা পাওয়ার পর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় কথিত নিয়োগপত্র।

এ পর্যন্ত তারা ২৩ জনকে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের নিয়োগপত্র, ২০ জনকে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স পত্র, ২১ জনকে নিয়োগপত্র, চট্টগ্রাম বন্দরে ১ জনের নামে নিয়োগপত্র ও পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ৪ জনের নামে নিয়োগপত্র ও এনবিআরে ২৭ জনের নামে নিয়োগপত্র দিয়েছে বলেও জানান তিনি।

প্রতারণার ধাপ সম্পর্কে বলতে গিয়ে সন্তোষ চাকমা জানান, প্রতারকচক্রের মূল হোতা আতিকুর রহমান চৌধুরী নিজের নাম পাল্টে আনোয়ারুল হোসেনের নামে জাতীয় পরিচয়পত্র বানিয়ে এই নিয়োগ বাণিজ্যের নামে প্রতারণা করছিলেন। তারা ভুয়া নিয়োগপত্র থেকে শুরু করে ইন্টারভিউ গ্রহণ, স্বাস্থ্য পরীক্ষা গ্রহণ, এমনকি পুলিশি ভেরিফিকেশনও করান সত্যি সত্যি। আবার নিয়োগপত্রও দেওয়া হয়। সেই নিয়োগপত্র নিয়ে যখনই যোগ দিতে যান তখনই নিয়োগ প্রত্যাশীরা বুঝতে পারেন তারা এতো প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এখন পর্যন্ত সরকারের কোনও সংস্থার লোকজন জড়িত থাকার সম্পৃক্ততা পাওয়া না গেলেও এনবিআর তাদের তদন্তে এ কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে গত বছর ডিএস মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীকে ওএসডি করেছিল। এরপরও তদন্তে যেই সংস্থারই যে কর্মকর্তা-কর্মচারীরই নাম আসবে তাকে গ্রেফতার করা হবে বলে জানিয়েছেন পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পুলিশ কর্মকর্তা সন্তোষ কুমার চাকমা।

এডি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!