সরকারি অফিসে স্বপ্নের টোপ, নিখুঁত ছকে অবিশ্বাস্য প্রতারণা চট্টগ্রামে

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে বিভিন্ন পদে নিয়োগের নাম দিয়ে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে সংঘবদ্ধ একটি প্রতারকচক্র। সরকারি নিয়োগ বিধিমালার কোন কিছুতেই খুঁত রাখে না এই চক্রটি। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, নিয়োগ পরীক্ষা, পরীক্ষার ফল প্রকাশ, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রদান, পুলিশ ভেরিফিকেশন, স্বাস্থ্য পরীক্ষা—সবকিছুই হয় নিয়মমাফিক। সাদা চোখে বোঝার উপায়ই থাকে না যে পুরো প্রক্রিয়াটিই ভুয়া!

এমন একটি প্রতারণার ফাঁদ পেতে এই প্রতারকচক্র লাখ লাখ হাতিয়ে নিয়েছে চাকরিপ্রত্যাশী তরুণদের কাছ থেকে। রোববার (৮ সেপ্টেম্বর) লালমনিরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার তিন তরুণ চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে কথিত চাকরিতে যোগ দিতে এলে অভিনব এই প্রতারণার ঘটনা ধরা পড়ে। প্রতারক চক্রটি চাকরি দেওয়ার লোভ দেখিয়ে কেবল ওই তিন তরুণের কাছ থেকেই হাতিয়ে নিয়েছে ৩১ লাখ টাকা।

রোববার (৮ সেপ্টেম্বর) দুপুর থেকেই চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের অভ্যন্তরে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল কাস্টম কমিশনারের স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার খবর। প্রতারণার শিকার তরুণদের একনজর দেখার জন্য সবাই ভিড় করছেন কাস্টম কমিশনারের ব্যক্তিগত কর্মকর্তার কক্ষে। অনেকেই এ সময় তাদের সমবেদনা জানান।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে চাকরি করার আশা নিয়ে লালমনিরহাট ও সাতক্ষীরা জেলা থেকে সুদূর চট্টগ্রামে এসেছিলেন এই তিন তরুণ।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে চাকরি করার আশা নিয়ে লালমনিরহাট ও সাতক্ষীরা জেলা থেকে সুদূর চট্টগ্রামে এসেছিলেন এই তিন তরুণ।

জানা যায়, ওইদিন দুপুর ১২টার দিকে অতিরিক্ত কমিশনার- ১ আকবর হোসেনের দপ্তরের সামনে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছিলেন মিলন চক্রবর্তী নামের এক যুবক। ৮ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে ‘নিয়োগ’ দেওয়া হয় তাকে। রোববার চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে যোগদান করতে এসে জানতে পারে নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়াটিই ভুয়া। প্রতারকচক্রের খপ্পরে পড়ে জমিবিক্রি ও ধারদেনা করে দেওয়া ৮ লাখ টাকার পুরোটাই গেছে খোয়া। ঘটনার এখানেই শেষ নয়।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে এই ঘটনার পর প্রতারিত মিলন চক্রবর্তীর কাগজপত্রগুলো যখন কাস্টমস কর্মকর্তারা খুঁটিয়ে দেখছিলেন, তখন ওই পদে ‘যোগদান’ করতে আসেন আরও দুই তরুণ। তাদের একজন সাইফুল ইসলাম। সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া থানার কেয়ালিয়া গ্রামের আরিজুল ইসলামের ছেলে তিনি। কাস্টমসের চাকরির আশায় দেড় বিঘা জমি বিক্রি ও ঋণের ১২ লাখ টাকা তুলে দিয়েছিলেন প্রতারক আনোয়ারুল ইসলামের হাতে। এলাকায় একটি ফার্মেসিতে কাজ করতেন সাইফুল। প্রতারকচক্রের দেওয়া ‘নিয়োগপত্র’ নিয়ে রোববার চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে এসে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন সাইফুল। এভাবে প্রতারণার শিকার হবেন ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেননি তিনি।

প্রতারক আনোয়ারুল ইসলামের আরেক শিকার আবদুল গফুর। সাতক্ষীরা জেলার কলরোয়া থানার কমলখালী এলাকার ওফাপুর গ্রামের আকিমুদ্দিনের ছেলে গফুরও রোববার চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে এসেছিলেন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে যোগদানের জন্য। জমি বন্ধক এবং ধার দেনা করে তিনি মোট ১১ লাখ টাকা তুলে দিয়েছিলেন প্রতারক আনোয়ারুল ইসলামের হাতে।

কাস্টম হাউজের তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনারের স্বাক্ষর ও সিল দিয়ে তৈরি করা হয় প্রবেশপত্র। সব 'প্রক্রিয়া' শেষে কাস্টম হাউজের ডাক গ্রহণ ও প্রেরণ শাখা থেকে পাঠানো হয় নিয়োগপত্রগুলো।
কাস্টম হাউজের তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনারের স্বাক্ষর ও সিল দিয়ে তৈরি করা হয় প্রবেশপত্র। সব ‘প্রক্রিয়া’ শেষে কাস্টম হাউজের ডাক গ্রহণ ও প্রেরণ শাখা থেকে পাঠানো হয় নিয়োগপত্রগুলো।

ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি
সরকারি চাকরিতে নিয়োগের নামে চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য পুরো প্রক্রিয়ায় অভিনব ও অবিশ্বাস্য প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া হয়। প্রতারিত তিন তরুণের কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সাদা কাগজে প্রিন্ট করা হয়েছে ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটি। ২০১৭ সালের ২১ ডিসেম্বর ‘প্রকাশিত’ ওই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে মোট ছয়টি পদের উল্লেখ করা হয়। পদগুলো হচ্ছে উচ্চমান সহকারী, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক, সিপাই, অফিস সহায়ক, কুক এবং মালী। উচ্চমান সহকারী পদে ৩৬, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে ৪১, সিপাই পদে ৯৮, অফিস সহায়ক পদে ১৬, কুক পদে ২ এবং মালী পদে ২টি পদের উল্লেখ করা হয় ‘নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি’তে।

নিয়োগ পরীক্ষায় যাতে চট্টগ্রাম বিভাগের প্রার্থীরা অংশ না নেয় সেজন্য উচ্চমান সহকারী, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক, সিপাই পদে প্রার্থীদের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, ব্রাহ্মনবাড়িয়া, লক্ষীপুর, বাগেরহাট, নড়াইল, বরিশাল ও বরগুনা জেলার প্রার্থীরা আবেদন করতে পারবে না বলে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া অফিস সহায়ক, কুক এবং মালী পদে মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, নেত্রকোনা, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, খাড়গাছড়ি, বান্দরবান, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষীপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বাগেরহাট, যশোর, মেহেরপুর, নড়াইল, বরিশাল, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী ও ভোলার প্রার্থীরা আবেদন করতে পারবে না বলে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়। ভুয়া ওই বিজ্ঞপ্তিতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার ড. নাহিদা ফরিদীর নাম উল্লেখ করা হয়।

আগ্রাবাদের স্কুলে নিয়োগ পরীক্ষা
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ভুয়া হলেও প্রতারণার জালে আটকাপড়া তরুণদের মনে বিশ্বাসযোগ্যতা আনার জন্য প্রতারকচক্রটি আয়োজন করে সত্যিকারের নিয়োগ পরীক্ষার। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার ড. নাহিদা ফরিদীর স্বাক্ষর ও সিল দিয়ে তৈরি করা হয় প্রবেশপত্র। চলতি বছরের ১০ মে স্বাক্ষরিত প্রবেশপত্রে ড. নাহিদী ফরিদীকে বিভাগীয় নির্বাচন কমিটির সদস্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রবেশপত্রের উপরিভাগে সরকারি লোগোসহ চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের নাম এবং আবেদনকারীর ছবিতে কাস্টম হাউজের সিল সংযুক্ত করা হয়।

প্রতারিত তরুণদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ সরকারি কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়ে নেওয়া হয় ভুয়া নিয়োগ পরীক্ষাটি। চলতি বছরের ২২ জুন শুক্রবার সকাল দশটায় অনুষ্ঠিত নিয়োগ পরীক্ষায় চার শতাধিক পরীক্ষার্থী অংশ নেয় বলে জানিয়েছেন প্রতারণার শিকার সাইফুল ইসলাম।

সত্যিকারের পুলিশ ভেরিফিকেশন
তথাকথিত লিখিত পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হন, তাদের নিয়ে প্রতারকচক্র শুরু করে আরেক কার্যক্রম। সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় যেসব বিধিবিধান মেনে চলা হয়, প্রতারণার শিকার তরুণদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রতারিত মিলন চক্রবর্তী জানান, নিয়োগ পরীক্ষার পর লালমনিরহাট পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে তার পুলিশ ভেরিফিকেশন। সেখান থেকে আবদুল মালেক নামে এক উপ-পরিদর্শক মিলনের বাড়ি গিয়ে তার তথ্যাবলীও যাচাই করে আসেন।

বাদ পড়েনি স্বাস্থ্য পরীক্ষাও
পুলিশ ভেরিফিকেশনের ভুয়া নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নেওয়া হয় স্বাস্থ্য পরীক্ষাও। মিলন চক্রবর্তীর কাছ থেকে পাওয়া তার স্বাস্থ্য পরীক্ষার সনদে দেখা যায় লালমনিরহাট জেলার সিভিল সার্জন ডা. মো. কাশেম আলী স্বাক্ষরিত বাংলাদেশ ফরম নম্বর ৭৯০-এর আলোকে একটি স্বাস্থ্য সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে তাকে। ২ সেপ্টেম্বর স্বাক্ষরিত ওই সনদে মিলন চক্রবর্তীকে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে নিয়োগের জন্য অযোগ্য বলে মনে করেন না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া ডোপ (মাদক) টেস্ট প্রতিবেদনও প্রদান করেছেন লালমনিরহাট জেলার সিভিল সার্জন ডা. মো. কাশেম আলী।

নিয়োগপত্র গেল কাস্টম হাউজ থেকে
পুলিশ ভেরিফিকেশন ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর নিয়োগপত্র পাঠানোর ক্ষেত্রেও চতুরতার আশ্রয় নেয় প্রতারকচক্রটি। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের ডাক গ্রহণ ও প্রেরণ শাখা থেকে গত ১ সেপ্টেম্বর ডাকযোগে স্ব-স্ব ঠিকানায় পাঠানো হয় নিয়োগপত্রগুলো।

চেক ও এসএ পরিবহনে চলে লেনদেন
প্রতারণার শিকার তিন যুবক জানান, যার মাধ্যমে চাকরিতে ঘুষের টাকা দরকষাকষি হয় তার নাম আনোয়ারুল ইসলাম। তাদের কাছে আনোয়ারুল ইসলাম চট্টগ্রাম বন্দরের তিন নম্বর গেটে চাকরি করেন বলে জানান।

ঘুষের টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন দলিলপত্র করা হয়েছে কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতারণার শিকার মিলন চক্রবর্তী বলেন, ‘টাকা চেকের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়েছে। সেই ডকুমেন্ট বাড়িতে রেখে এসেছি।’

অন্যদিকে প্রতারণার শিকার অপর দুই যুবক সাইফুল এবং আবদুল গফুর জানান, তারা এসএ পরিবহনের মাধ্যমে কয়েকটি কিস্তিতে আনোয়ারুল ইসলামের কাছে টাকা পরিশোধ করেছেন।

স্বপ্নভঙ্গের অশ্রুভেজা বিদায়
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে চাকরি করার আশা নিয়ে লালমনিরহাট ও সাতক্ষীরা জেলা থেকে সুদূর চট্টগ্রামে এসেছিলেন তিন তরুণ। পরিবারের সহায় সম্বল বিক্রি করে একটি চাকরির আশা ছিল তাদের। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে প্রবেশ করেই তাদের সেই আশা পরিণত হয় নিরাশায়। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে লিখিত অভিযোগ দিয়ে তারা যখন নিজ নিজ গন্তব্যে যাত্রা শুরু করছিল অশ্রুসিক্ত ছিল সবার চোখ। স্বপ্নভঙ্গের এমন বাস্তব চিত্র দেখে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কর্মকর্তাদের অনেকেই আবেগতাড়িত হন।

প্রতারকচক্রের হোতা আনোয়ার
নিয়োগ দেওয়ার নাম করে ৩ তরুণের কাছ থেকে ৩১ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া সেই প্রতারক আনোয়ারুল ইসলামের সঙ্গে মোবাইল ফোনে রোববার (৮ সেপ্টেম্বর) দুপুরে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে মোবাইলের সংযোগ কেটে দেন। এরপর একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোনের সংযোগ কেটে দেন।

রাত সাড়ে ৯টায় আনোয়ারুলের মোবাইল নম্বরে পুনরায় যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, টাকা লেনদেন যদি করে থাকি তাহলে তাদের ডকুমেন্ট দেখাতে বলেন। এরপর এই প্রতিবেদকের প্রতি অশালীন শব্দ প্রয়োগ করতে থাকেন।

প্রতারণার শিকার তিন যুবক মিলন চক্রবর্তী, আবদুল গফুর এবং সাইফুল ইসলাম চাকরির আশায় যথাক্রমে ৮ লাখ, ১১ লাখ এবং ১২ লাখ মিলিয়ে মোট ৩১ লাখ টাকা দেন প্রতারক আনোয়ারুলকে।

এদিকে প্রতারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রতারণার শিকার তিন তরুণ চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কমিশনার ফখরুল আলমের কাছে আলাদাভাবে লিখিত আবেদন করেছেন। কাস্টম কমিশনার দাপ্তরিক কাজে ঢাকায় অবস্থান করায় তাদের আবেদনের পরবর্তী করণীয় সোমবার ঠিক করা হবে বলে জানা গেছে।

এসএস/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!