জঙ্গি আস্তানায় ২০ ঘণ্টার শ্বাসরূদ্ধকর অভিযান : পাঁচ মরদেহ উদ্ধার

জঙ্গি আস্তানায় ২০ ঘণ্টার শ্বাসরূদ্ধকর অভিযান : পাঁচ মরদেহ উদ্ধার 1প্রতিদিন রিপোর্ট : জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাবার পর বুধবার বিকেল তিনটায় সীতাকুণ্ডের কলেজ রোডের চৌধুরীপাড়ার প্রেমতলা এলাকার ছায়ানীড় ভবনে অভিযান শুরু করে পুলিশ। এরপর চলে জঙ্গিদের গ্রেনেড বিস্ফোরণ, উভয় পক্ষে গুলি বিনিময়। একসময় পরাস্ত হয় জঙ্গিরা, কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়, কেউ আত্মঘাতী হয়ে জীবন দেয়। এতে সর্বশেষ পাঁচজনের মরদেহ পেয়েছে পুলিশ। শেষে পাওয়া মরদেহটি একটি শিশুর । ধারণা করা হচ্ছে সেটি নিহত নারী জঙ্গির সন্তান।

অভিযান চলাকালে ছায়ানীড় ভবনে আটকে পড়ে ৮টি পরিবারের সদস্য। তাদের নিরাপদে রেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য এই অভিযান চালানো ছিল দুঃসাহসিক কাজ। কিন্তু জঙ্গি আস্তানা থেকে এসব জিম্মিদের উদ্ধারে সক্ষম হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শুধু তাই নয়, বৃহস্পতিবার (১৬ মার্চ) সকাল সাড়ে ১০টায় ২০ ঘণ্টাব্যাপী চলা এই শ্বাসরূদ্ধকর অভিযান সফলভাবে সমাপ্ত করা হয়।

চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা সাংবাদিকদের বলেন, বুধবার (১৫মার্চ) দুপুরে সীতাকুণ্ড পৌরসভার লামারবাজার আমিরাবাদের সাধন কুটির থেকে জঙ্গি দম্পতিকে তাদের এক শিশুসন্তান সহ আটক করা হয়। সাধন কুটিরের মালিকই মূলত তাদের ধরে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেন। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রেমতলার ছায়ানীড় ভবন ঘিরে রাখে পুলিশ।

এরপর বুধবার দুপুর তিনটা থেকে অপারেশন শুরু করে। পুলিশ ছায়ানীড় ভবনের নিচতলার এই আস্তানায় অভিযান চালাতে গেলে ভেতর থেকে তিনটি হাতবোমা ছোঁড়ে জঙ্গিরা। এতে সীতাকুন্ড থানার ওসি (তদন্ত) মোজাম্মেলসহ দুই পুলিশ সদস্য আহত হন। এরপর পুলিশ পিছু হটে পুরো আস্তানা ঘিরে রাখে।

ততক্ষনে ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছে সিএমপির সোয়াত টিম। রাত ৮টার দিকে সিএমপির সোয়াত এবং জেলা পুলিশের সমন্বয়ে গঠিত টিম গুলি ছুড়তে ছুড়তে সড়ক থেকে আস্তানায় প্রবেশের চেষ্টা করে। এসময় হ্যান্ডমাইকে জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের আহ্বানও জানায় পুলিশ। কিন্তু জঙ্গিরা ভেতর থেকে গ্রেনেড ছুড়ে প্রতিরোধ করতে থাকে। এই অবস্থায় ঢাকা থেকে পুলিশের বিশেষ টিমকে ঘটনাস্থলে আসার জন্য বলা হয়।

পরে বৃহস্পতিবার (১৬ মার্চ) ভোর ৫টায় ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায় ঢাকার সোয়াত টিম। ডিএমপির সোয়াত টিমের নেতৃত্বে সকাল ৬টা ২০ মিনিটে গুলি ছুড়তে ছুড়তে ‘অপারেশন অ্যাসল্ট-১৬’ অভিযান শুরু করে সিএমপি সোয়াত, জেলা পুলিশ, সিএমপির বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিট, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, র‌্যাব ও পুলিশের সম্বন্বয়ে গঠিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

এসময় ভবনের ভেতর থেকে বিকট শব্দ শোনা যায়। অভিযানে ভবনের ভেতরে আটকে পড়া ২০ জনকে উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এছাড়া নারী-শিশুসহ পাঁচ জঙ্গির মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

নুরে আলম মিনা বলেন, নিজেদের নিরাপদে রেখে ও জিম্মিদের নিরাপত্তা বজায় রেখে অভিযান চালানো ছিল একটা চ্যালেঞ্জিং কাজ। ভবনের ভেতরে নারী, শিশু, বৃদ্ধ ছিল, রোগাক্রান্ত মানুষ ছিল। জিম্মিদের যেন কোনো ক্ষতি না হয় সেটাই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য। সবদিক ঠিক রেখে সফলভাবে আমরা অভিযান সম্পন্ন করেছি।

চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, জঙ্গীদের লক্ষ্য ছিল বিদেশিদের ওপর হামলা করে মিরসরাই-সীতাকুণ্ড অঞ্চলে বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করা। আমরা নিশ্চিত এরা নিষিদ্ধ ঘোষিত উগ্র সংগঠন ‘নব্য জেএমবি’। তারা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বড় ধরনের নাশকতার লক্ষ্যে প্রচুর গ্রেনেড ও বিস্ফোরক মজুদ করেছিল আস্তানায়।

তিনি অভিযান সম্পর্কে বলেন, ১৫ মার্চ রাত থেকে ছায়ানীড় ভবনে বার বার অভিযান চালানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ভেতর থেকে জঙ্গিদের প্রতিরোধের কারণে তা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে সোয়াতের একটি টিম পাশের আরেকটি ভবনের ছাদে উঠে ছায়ানীড় ভবনের দিকে আগানোর চেষ্টা করে। তা দেখতে পেয়ে দুই জঙ্গি ছায়ানীড়ের ছাদের ওপর উঠে সোয়াত টিমকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছোড়ার চেষ্টা করে। এসময় সোয়াত সদস্যরা এক জঙ্গিকে গুলি করে মেরে ফেলে। অপর জঙ্গি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মহত্যা করে।

এরপর সোয়াত টিম নিচে নেমে ছায়ানীড় ভবনের দিকে আগানোর চেষ্টা করে। এসময় জঙ্গিরা ভবনের ভেতর থেকে সোয়াত টিমকে লক্ষ্য করে ফাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। এসময় দুপক্ষে গুলি বিনিময় হয়। গুলিতে এক জঙ্গি নিহত হয় ও অপর জঙ্গি আত্মঘাতী হয়ে জীবন দেয়। আত্মঘাতী দুই জঙ্গির দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে ৫০০ থেকে ৭০০ ফুট দূরে ছিটকে পড়ে।

তিনি বলেন, অভিযান শেষ হওয়ার পর এ পর্যন্ত ৫টি গ্রেনেড বিস্ফোরণ করা হয়েছে। ভবনের ছাদে একটি অবিস্ফোরিত শক্তিশালী গ্রেনেড রয়েছে। এটি বিস্ফোরণ করতে গেলে পুরো ভবন ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সিএমপির বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিট কাজ করে।

এদিকে দুপুর একটার দিকে মামলার আলামত সংগ্রহের জন্য ঘটনাস্থলে গেছে সিআইডির ফরেনসিক টিম।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দোতলা ভবনটিকে প্রতি ফ্লোরে চারটি করে মোট আটটি ও পাশের একটিসহ মোট ৯টি পরিবার বাস করত। এর মধ্যে একটি ফ্ল্যাট জঙ্গিরা ভাড়া নিয়েছিল। বাকি ৮টি পরিবার জঙ্গি আস্তানায় অভিযান শুরুর পর ভবনে আটকা পড়ে। তাদের উদ্ধারে ফায়ার সার্ভিসের একটি দল কাজ করেছে। জিম্মিদশা থেকে উদ্ধার হওয়া সবাইকে পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!