চট্টগ্রামে মেট্রোরেল নিয়ে কোরিয়ার নতুন প্রস্তাব, চীনও এগোচ্ছে সমানতালে

বঙ্গোপসাগরের বুকে ‘স্মার্ট সিটি’ গড়ে তোলার বিনিময়ে চট্টগ্রামে নিজেদের টাকায় মেট্রোরেল করে দেওয়ার চীনের প্রস্তাব নিয়ে যখন নাড়াচাড়া চলছে, তখন দক্ষিণ কোরিয়া সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে চট্টগ্রামে মেট্রোরেল নির্মাণে টাকা খাটানোর প্রস্তাব দিয়েছে। এজন্য দ্রুততম সময়ে সম্ভাব্যতা যাচাই শুরুর আগ্রহও দেখিয়েছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে মেট্রোরেল নির্মাণে ব্যয়ের পুরো অংকটাই বিনিয়োগ করতে চায় দক্ষিণ কোরিয়া।

বুধবার (২ মার্চ) দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে চতুর্থ বাংলাদেশ-কোরিয়া যৌথ পিপিপি প্লাটফর্ম সভায় চট্টগ্রামের মেট্রোরেলে বিনিয়োগের এই প্রস্তাব নতুন করে দেওয়া হল। ওই সভায় বাংলাদেশের পিপিপি কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সচিব সুলতানা আফরোজের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধি দল অংশ নেয়। সেই সভায় ভার্চুয়ালি অংশ নেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস। দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের পক্ষে ওই সভায় নেতৃত্ব দেন ভূমি, অবকাঠামো ও পরিবহন মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার সিওন অন উন।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগ্রহে চট্টগ্রামে মেট্রোরেল স্থাপনের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলের তৎপরতায় বিষয়টি পায় গতিও।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের দেওয়া তথ্য অনুসারে, চট্টগ্রামে মেট্রোরেল নির্মাণের সমীক্ষা সম্পন্ন করতে লাগবে ১৮ মাস সময়। আর সমীক্ষাতেই শুধু খরচ হবে ৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫১ কোটি টাকা অনুদান হিসেবে দিতে চায় দক্ষিণ কোরিয়া। বাকি ২৬ কোটি টাকা দেবে সরকার।

চট্টগ্রামে মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য আড়াই বছর আগে একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রাক যোগ্যতা সমীক্ষা করা হয়েছিল। ওই সময় চট্টগ্রামে মেট্রোরেলের তিনটি রুট (এমআরটি লাইন) করার কথা বলা হয়— যার মোট দৈর্ঘ্য সাড়ে ৫৪ কিলোমিটার। এই তিনটি রুট হল— কালুরঘাট থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত এমআরটি লাইন-১ (দৈর্ঘ্য সাড়ে ২৬ কিলোমিটার, স্টেশন ২০টি), সিটি গেট থেকে নিমতলা হয়ে শাহ আমানত সেতুর গোল চত্বর পর্যন্ত লাইন-২ (দৈর্ঘ্য সাড়ে ১৩ কিলোমিটার, স্টেশন ১২টি) এবং অক্সিজেন থেকে ফিরিঙ্গিবাজার ও পাঁচলাইশ থেকে এ কে খান পর্যন্ত লাইন-৩ (দৈর্ঘ্য সাড়ে ১৪ কিলোমিটার, স্টেশন ১৫টি)। প্রতি কিলোমিটার মেট্রোরেল লাইন স্থাপনে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা।

প্রাক যোগ্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুসারে, চট্টগ্রামে মেট্রোরেলের সর্বোচ্চ গতিবেগ হবে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার এবং গড় গতিবেগ ঘণ্টায় ৪৫ কিলোমিটার। একটি ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এমআরটির মাধ্যমে ঘণ্টায় দুই প্রান্তের প্রায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে।

কালুরঘাট থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত এমআরটি লাইন-১

দৈর্ঘ্য সাড়ে ২৬ কিলোমিটার, স্টেশনের সংখ্যা ২০টি
প্রাক যোগ্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদনে এমআরটি লাইন-১-এ ২০টি স্টেশনের প্রস্তাব করা হয়। এগুলো হলো— কালুরঘাট, কাপ্তাই রাস্তার মাথা, চান্দগাঁও সিএনবি বাস স্টপ, হাজেরা-তজু ডিগ্রি কলেজ, বহদ্দারহাট, কাপাসগোলা, চকবাজার, জহুর আহমেদ চৌধুরী রোড, লালখানবাজার, দেওয়ানহাট, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড, বারিক বিল্ডিং, নিমতলী, সল্টগোলা ক্রসিং, সিইপিজেড, সিমেন্ট ক্রসিং, স্টিল মিল বাস-স্টপ, পতেঙ্গা, পতেঙ্গা বিচ এবং এয়ারপোর্ট।

সিটি গেট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত এমআরটি লাইন-২

দৈর্ঘ্য সাড়ে ১৩ কিলোমিটার, স্টেশনের সংখ্যা ১২টি
প্রাক যোগ্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদনে এমআরটি লাইন-২-এ ১২টি স্টেশনের প্রস্তাব করা হয়। এগুলো হলো— সিটি গেট, কর্নেল হাট গেট, একে খান বাস স্টপ, সরাইপাড়া, নয়াবাজার, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড, পোর্ট নিউ মার্কেট, নিমতলী, বারিক বিল্ডিং, সদরঘাট, ফিরিঙ্গিবাজার এবং শহীদ বশিরউজ্জামান স্কয়ার।

অক্সিজেন থেকে ফিরিঙ্গিবাজার ও পাঁচলাইশ থেকে এ কে খান পর্যন্ত এমআরটি লাইন-৩

দৈর্ঘ্য সাড়ে ১৪ কিলোমিটার, স্টেশনের সংখ্যা ১৫টি
প্রাক যোগ্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদনে এমআরটি লাইন-৩-এ ১৫টি স্টেশনের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো— অক্সিজেন, হাশেম বাজার রোড, মুরাদপুর, চকবাজার, চন্দনপুরা, আন্দরকিল্লা, কোতোয়ালী, ফিরিঙ্গিবাজার এবং পাঁচলাইশ-একে খান বাস স্টপ লিঙ্কে পাঁচলাইশ, মেডিকেল, জিইসি স্কয়ার, বিজিএমইএ ইনস্টিটিউট, ফয়’স লেক, পাহাড়তলী লিঙ্ক রোড এবং একে খান স্টপ।

এদিকে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে মিরসরাই পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরের বুকে ৬০ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে ‘স্মার্ট সিটি’ গড়ে তোলার বিনিময়ে নিজেদের খরচে চট্টগ্রামে মেট্রোরেল করে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে চীন। চীনের চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এই ‘স্মার্ট সিটি’র বিস্তারিত রূপরেখা জমা দেওয়ার পাশাপাশি মেট্রোরেল নিয়ে তাদের প্রস্তাবের বিস্তারিত প্রস্তাবও জমা দিয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে। এখন এই প্রস্তাব নিয়ে ভাবছে সরকারও। গণপূর্ত মন্ত্রণালয় প্রস্তাবটিকে ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছে আগেই। মঙ্গলবার (২২ ফেব্রুয়ারি) সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও মিলেছে সবুজ সংকেত। সেই বৈঠকে চট্টগ্রামে চীনা ‘স্মার্ট সিটি’ গড়ে তোলা ও মেট্রোরেল তৈরির প্রস্তাবটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানোর সুপারিশ করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এই প্রকল্পের নাম দিয়েছে ‘সি-সাইড বে ভিউ স্মার্ট সিটি’ (পতেঙ্গা থেকে মিরসরাই)। এই ‘স্মার্ট সিটি’ গড়ে তোলার বিনিময়ে চীনের চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের একটি জোট চট্টগ্রামে মেট্রোরেল করে দেবে নিজেদের খরচেই। মেট্রোরেলের টাকা তারা প্রস্তাবিত ‘স্মার্ট সিটি’ থেকে পুষিয়ে নেবে। চীনের কোন্ চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান মেট্রোরেল গড়ে দেওয়ার বিনিময়ে চট্টগ্রামে উপশহর গড়তে চায়, তাদের নাম এখন পর্যন্ত স্পষ্ট করেনি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। তবে গত ১৩ জানুয়ারি ঢাকায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে এক বৈঠকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে চায়না রেলওয়ে কন্সট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিআরসিসিএল) নামের প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামে মেট্রোরেল নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের আগ্রহের কথা জানায়। এই প্রতিষ্ঠানটি রাষ্ট্রায়ত্ত ওই চার প্রতিষ্ঠানের কনসোর্টিয়ামে আছে বলে সিডিএ সূত্র জানিয়েছে।

এরই মধ্যে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে চট্টগ্রামে মেট্রোরেল নির্মাণে ব্যয়ের পুরো অংকটাই বিনিয়োগের নতুন প্রস্তাব দিল দক্ষিণ কোরিয়া।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!