চট্টগ্রামে নবজাতকের ঝুঁকি বাড়ছে মায়েদের অবহেলায়, উপজেলা ক্লিনিকের সেবা নিতে অনীহা

চট্টগ্রামে উপজেলা কমিউনিটি ক্লিনিক ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রসবোত্তর সেবা (পোস্টন্যাটাল কেয়ার-পিএনসি) নিতে উদাসীন প্রসূতি মায়েরা। প্রসব-পূর্ব সেবা (অ্যান্টেন্যাটাল কেয়ার-এএনসি) নিলেও বাচ্চা হওয়ার পর পরবর্তী সেবা নিতে যান না তারা। ফলে নানান স্বাস্থ্য জটিলতা দেখা দেয় মায়েদের।

ডাক্তাররা বলছেন, গর্ভকালীন সেবা না নিলে এবং বাড়িতে প্রসব করালে অনেক সময় পরে জটিলতা দেখা দিতে পারে। প্রসবের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পিএনসি নিলে মা ও শিশুর কোনো জটিলতা তৈরি হয়েছে কি-না, দ্রুত তা শনাক্ত করা যায়। এতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যায়। সন্তান জন্ম দেওয়ার পরের ২৪ ঘণ্টা মা ও নবজাতকের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে কমিউনিটি ক্লিনিকে গত ১৩ থেকে ১৮ এপ্রিল সাপ্তাহিক সেবাদান তথ্যচিত্রে দেখা গেছে, ১৫ উপজেলার মোট ২০০ ইউনিয়নের ৫৩৮টি ক্লিনিকে এনএনসি সেবা নেয় ৯৪৫ জন এবং পিএনসি নেয় ৪৫৭ জন।

চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের পাঁচদিনের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে এমন চিত্র।

তবে চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলার মধ্যে দুটিতে এই সেবার মান সন্তোষজনক হলেও একটিতে গত পাঁচদিনে কোনো রোগীই আসেননি।

মিরসরাই উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নের ৪২টি ক্লিনিকে এএনসি সেবাপ্রাপ্ত রোগীর সংখ্যা ৫৩ জন। আর পিএনসির রোগীর সংখ্যা ২২ জন।

সীতাকুণ্ডে ১০ ইউনিয়নের ২৩টি ক্লিনিকে এএনসি সেবা নেয় ৭৩ জন প্রসূতি, পিএনসি সেবা নেয় ৩১ জন।

সন্দ্বীপ ১৫ ইউনিয়নের ক্লিনিকে এএনসি রোগীর সংখ্যা ছিল ১০২ জন, পিএনসিতে ছিল ২৪ জন।

হাটহাজারীর ১৫ ইউনিয়নের ৩৫টি ক্লিনিকে এএনসি রোগীর সংখ্যা ছিল ৫৩ জন। পিএসসি রোগীর সংখ্যা ছিল ২২ জন।

ফটিকছড়ি উপজেলার ২০টি ইউনিয়নের ৫৫টি ক্লিনিকে এএনসি রোগী ছিল ৪৫ জন। পিএনসি সেবা নেয় ৪৪ জন।

রাউজান উপজেলায় ১৫ ইউনিয়নের ৪৪টি ক্লিনিকে এএনসি সেবাপ্রাপ্ত রোগীর সংখ্যা ৭২ জন, পিএনসি রোগী ছিল ২৪ জন।

রাঙ্গুনিয়ায় ১৫ ইউনিয়নের ৪৩টি ক্লিনিকে এএনসি সেবাপ্রাপ্ত রোগীর সংখ্যা ৪৭ জন। পিএনসি সেবা নেয় ৪৪ জন।

এদিকে বোয়ালখালীতে ১০ ইউনিয়নের ২৯টি ক্লিনিকে এএনসি ও পিএনসি সেবাগ্রহীতার সংখ্যা ছিল শূন্য।

কর্ণফুলীতে পাঁচ ইউনিয়নের ১২ ক্লিনিকে এএনসি সেবাপ্রাপ্ত রোগীর সংখ্যা ২৫ জন। পিএনসি রোগী ছিল ১০ জন।

আনোয়ারা উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের ৩০ ক্লিনিকে এএনসি সেবাপ্রাপ্ত রোগীর সংখ্যা ৪৭ জন। আর পিএনসি সেবাপ্রাপ্ত রোগীর সংখ্যা ১৮ জন।

বাঁশখালীতে ১৫ ইউনিয়নের ৪০টি ক্লিনিকে এএনসি সেবা নেয় ১৩৫ জন, আর পিএনসিতে ছিল ৮৩ জন।

পটিয়ায় ১৭ ইউনিয়নের ৪৯টি ক্লিনিকে এএনসি সেবাপ্রাপ্ত রোগীর সংখ্যা ৭৮ জন। পিএনসি সেবা নেন ৩৩ জন রোগী।

চন্দনাইশের ১০টি ইউনিয়নের ২৫টি ক্লিনিকে এএনসি সেবা নেয় ৭৫ জন এবং পিএনসি সেবা নেয় ২০ জন।

সাতকানিয়ায় ১৭ ইউনিয়নের ৪৩টি ক্লিনিকে এএনসি সেবাপ্রাপ্ত রোগীর সংখ্যা ৭১ জন। পিএনসি সেবা নেওয়া রোগী ছিল ৬২ জন।

লোহাগাড়ার ৯ ইউনিয়নের ২৯টি ক্লিনিকে এএনসি সেবা নেয় ৭২ জন এবং পিএনসি নেয় ২০ জন।

চট্টগ্রাম মেডিকেলের গাইনি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাহেনা আক্তার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘মা ও নবজাতক মৃত্যুর অধিকাংশই হয়ে থাকে সন্তান প্রসবের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে। ফলে প্রসবের সময় কোনো জটিলতা দেখা দিলে মা ও শিশু দু’জনের দ্রুত প্রসব-পরবর্তী সেবা (পিএনসি) নিশ্চিত করা জরুরি। পিএনসি পেলে মায়েরাও জানতে পারেন, কীভাবে নিজের ও নবজাতকের যত্ন নিতে হয়। তাই নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে প্রসবের প্রথম দু’দিনের মধ্যে পিএনসি নেওয়ার কথা বলা হয়।’

তিনি বলেন, ‘কিন্তু চট্টগ্রাম মেডিকেলের গাইনি ওয়ার্ডে প্রসব পরবর্তী জটিলতা নিয়ে যেসব রোগী ভর্তি হয় তারা এএনসি সেবা নেননি। আবার অনেকে এএনসি সেবা নিলেও ৪২ দিনের মধ্যে পিএনসি সেবা নেয়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রসূতিদের অন্তত চারটি পিএনসি নিতে বলা হয়। প্রথম ২৪ ঘণ্টায় একটি; দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনে একটি; চতুর্থ বা পঞ্চম বা ষষ্ঠ দিনে একটি এবং ৪২ দিনে একটি। পিএনসি খুব জরুরি হলেও চট্টগ্রামে এটি খুবই উপেক্ষিত।’

এদিকে প্রজনন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জটিলতার কারণে ফিস্টুলা, প্রল্যাপ্স, জরায়ুর মুখের ক্যান্সার, মিসক্যারেজ বা গর্ভপাত, ইকটোপিক প্রেগন্যান্সি, ফ্রাইব্রয়েড টিউমারসহ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিভাগ ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে প্রায় প্রতিদিনই অসংখ্য রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। এখানে শয্যা আছে ৬৪টি। কিন্তু প্রতিদিন ১২০ থেকে ১৩০ জন রোগী ভর্তি হন।

৩১ নম্বর ওয়ার্ডে ঘুরে দেখা গেছে, গত তিন মাসে যেসব অপারেশন হয়েছে, সেসব রোগীদের অনেকেই এখনও এই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আছেন।

এমনই এক রোগী চট্টগ্রামের আনোয়ারার রাবেয়া খাতুন। তিনি জানান, তিনি প্রল্যাপ্সেরই অপারেশন করিয়েছেন দু’বার। তারপরও সমস্যার সমাধান হয়নি।

গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. সাহানারা চৌধুরী বলেন, প্রসবের পর রক্তক্ষরণে মাতৃমৃত্যু বেশি হয়। তাই পিএনসির ওপর জোর দিতে হয়। হাসপাতালে প্রসব হলেও প্রথম পিএনসি পেলেও দ্বিতীয়বার আর ডাক্তারমুখি হন না প্রসূতিরা। হাসপাতাল কিংবা কমিউনিটি ক্লিনিকমুখি হন না। তারা ভাবেন, সমস্যা না হলে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার দরকার নেই। আর বাসায় প্রসব হলে বেশিরভাগ মা প্রসবোত্তর সেবা নিতে চান না। কিন্তু মা ও শিশুর সুরক্ষায় প্রসবের পরের জটিলতা প্রতিরোধে এই সেবা নেওয়া উচিত।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মো. ইলিয়াছ চৌধুরী পিএনসি সেবার প্রতি জোর দিয়ে বলেন, প্রসবের পর নিয়ম মেনে সেবা নিতে কমিউনিটি ক্লিনিক, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো থেকে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। হাসপাতাল ও কমিউনিটি ক্লিনিকে যারা প্রথম প্রসব-পূর্ব সেবা নিতে আসেন, তাদের প্রসব-পরবর্তী সেবার গুরুত্ব বুঝিয়ে সচেতন করা হলেও সেবার প্রতি আগ্রহী হন না প্রসূতি মায়েরা। কিন্তু পিএনসি সেবা নিতে এলে মায়ের সঙ্গে সন্তানেরও স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়ে যায়।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!