চট্টগ্রামের নবাব ৬১৯ কোটি টাকা মেরে দিয়েছেন সার ‘হাওয়া’ করে, প্রক্সিতে ফাঁসালেন ভাগ্নেকেও

চট্টগ্রামের আনোয়ারায় চায়ের দোকান দিয়ে কর্মজীবন শুরু করা সেই নবাব খান কয়েক দশকে কোনো এক জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় হয়ে ওঠেন হাজার কোটি টাকার মালিক। চট্টগ্রামে আছে বড় বড় প্রতিষ্ঠান, বাড়ি-ফ্ল্যাটের পাশাপাশি আছে বিঘায় বিঘায় জমিজমা। স্ত্রী-সন্তানরা থাকেন লন্ডনে। সেই নবাব খান অভিনব কৌশলে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) সার এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার নাম করে মাঝপথে করে দিচ্ছিলেন হাওয়া। আর শুধু এ থেকেই মেরে দিয়েছেন ৬১৯ কোটি টাকা। এ নিয়ে মামলা হওয়ার পর এবার জন্ম দিয়েছেন আরেক কাণ্ডের।

এলাকায় তার প্রতিবেশীদের কেউ কেউ বলছেন, স্কুলের দরজায় যাওয়ারই সুযোগ মেলেনি নবাব খানের। যদিও সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানাচ্ছেন, নবাব খান চিটাগাং ক্লাবের সদস্য। এই ক্লাবের সদস্য হতে গেলে কমপক্ষে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

সার কেলেঙ্কারি মামলার প্রধান আসামি নবাব খান তার হয়ে ঢাকার আদালতে প্রক্সি হাজিরা দিতে পাঠিয়েছিলেন চট্টগ্রামেরই এক যুবককে। রাজধানীর মতিঝিল থানায় দায়ের করা সেই মামলায় মঙ্গলবার (২২ ফেব্রুয়ারি) ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চান চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এলাকার উত্তর বন্দরের বাসিন্দা ফাহিম আহমেদ (২৫)। শুনানি শেষে আবেদন নাকচ করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন মহানগর হাকিম। সে অনুযায়ী ফাহিমকে আদালতের হাজতে নেওয়ার পথে হঠাৎ তিনি চিৎকার শুরু করেন। তিনি বলতে থাকেন, ‘আমাকে বলা হয়েছে জামিন হয়ে যাবে। এখন জামিন হলো না। আমি প্রকৃত আসামি নই। নবাব খানের হয়ে আদালতে হাজিরা দিতে এসেছিলাম।’

এরপরই বিষয়টি নিয়ে চাঞ্চল্য তৈরি হয়। এ ঘটনায় মঙ্গলবার (২২ ফেব্রুয়ারি) ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের নাজির রেজোয়ান খন্দকার বাদী হয়ে কোতোয়ালী থানায় মামলা করেছেন। পুলিশ বলছে, অর্থ বা বড় কোনো স্বার্থের বিনিময়ে হয়তো নবাব খান সেজে হাজিরা দিতে এসেছিলেন ফাহিম। তবে জানা গেছে, নবাব খান সেজে আদালতে আত্মসমর্পণ করা ফাহিম আহমেদ নবাব খানের ছোট বোনের ছেলে এবং নবাবের প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেন।

কে এই নবাব খান?

নবাব খানের বাড়ি চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নের উত্তর বন্দর গ্রামে। বাবা তরমিয়ত খানের চায়ের দোকানে কাজ করেই তার কর্মজীবন শুরু। পরে তিনি আনোয়ারার সমুদ্রপথে সিগারেট চোরাচালানের কাজ শুরু করেন। এই কাজে জড়িয়ে ১৯৮২ সালে খাতুনগঞ্জের অবাঙালি ব্যবসায়ী সুশীল রাজগরিয়ার সঙ্গে তিনিও গ্রেপ্তার হয়ে ছয় মাস জেলে ছিলেন।

১৯৮৪ সালে চিটাগাং ইউরিয়া সার কারখানায় (সিইউএফএল) নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে নিয়োগ পান নবাব খান। ১৯৯১ সালে বিএনপির সাংসদ সরওয়ার জামাল নিজামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্র ধরে সিইউএফএল ও কাফকোতে সার পরিবহন ছাড়াও টেন্ডারবাজি শুরু করেন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বছরখানেক জেলে থাকতে হয় নবাব খানকে।

একসময় অভাবের তাড়নায় যে প্রথম স্ত্রী তার জেঠাতো বোন রায়না বেগম নবাব খানকে তালাক দিয়ে চলে যান, কোনো এক জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় সেই নবাব খান গড়তে থাকেন একটির পর একটি প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ বাদামতলীতে প্রতিষ্ঠা করেন স্টিভিডোর প্রতিষ্ঠান নবাব এন্ড কোম্পানি, নবাব সিকিউরিটি কোম্পানি, ইত্যাদি শপিং কমপ্লেক্স। কিনে নেন লাইটারেজ জাহাজ এনসি ১ ও এনসি ২সহ বেশ কয়েকটি সমুদ্রগামী জাহাজ। আগ্রাবাদের সিডিএ আবাসিক এলাকায় তার রয়েছে ৭ তলা বাড়ি, নাসিরাবাদ ও ঢাকায় আছে ফ্ল্যাট। আনোয়ারা, কর্ণফুলী ও সীতাকুণ্ডে আছে অন্তত ৮০ বিঘা জমি।

নবাব খান পরে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখায় কর্মরত এক মহিলাকে বিয়ে করেন। সেই স্ত্রী এখন লন্ডনে থাকেন। নবাব খান দম্পতির তিন সন্তানও সেখানেই লেখাপড়া করে।

পথেই হাওয়া ৬১৯ কোটি টাকার সার

জানা গেছে, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) ইউরিয়া সার উৎপাদনের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করে থাকে। সরকারি এসব সার সমুদ্রবন্দর থেকে পরিবহন করে বিভিন্ন জেলার বাফার গুদামে পৌঁছে দেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু কয়েক বছর ধরে আমদানির সার বন্দর থেকে নিলেও গুদামে সেগুলো পৌঁছায়নি চট্টগ্রামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নবাব অ্যান্ড কোম্পানি। মাঝপথেই বিস্ময়করভাবে সেগুলো ‘হাওয়া’ হয়ে গেছে। এভাবে ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৬ হাজার ৮৭৪ টন সার ‘হাওয়া’ হয়ে যায় পুরোপুরি। এই সারের দাম প্রায় ৬১৯ কোটি টাকা।

বিসিআইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এসব সার কার্যাদেশ পাওয়ার ৫০ দিনের মধ্যে পৌঁছানোর কথা ছিল। বিসিআইসি থেকে কয়েক দফা তাগিদপত্র দেওয়া হলেও কাজ হয়নি। সর্বশেষ ১৯ ডিসেম্বর সার সরবরাহ করে চুক্তি নিষ্পত্তির নির্দেশ দেয় বিসিআইসি। অন্যথায় দেওয়ানি ও ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়। এরপরও বিসিআইসির গুদামে সার পৌঁছায়নি চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠান নবাব অ্যান্ড কোম্পানি। এরপর ২৩ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানটির মালিক নবাব খানের বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় মামলা করে বিসিআইসি।

ঢাকার মতিঝিল থানায় দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়, এমভি জিন্দা নামের একটি জাহাজ কাতার থেকে ইউরিয়া সার নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। ওই সার খালাস হয় ২০২০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। অপর দিকে এমভি সি বেনিভোলেন্স জাহাজে করে সৌদি আরব থেকে কেনা সার খালাস হয় ওই বছরের ১১ নভেম্বর। এরপর ওই একই বছরের ২৪ ডিসেম্বর এমভি গোল্ডেন লিফ-২ নামের একটি জাহাজ সৌদি আরব থেকে সার নিয়ে আসার পর সেটিও খালাস করা হয়। সর্বশেষ গত বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি এমভি ইলমা নামের জাহাজে সৌদি আরব থেকে আনা সার চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে খালাস করা হয়েছে।

মামলার বাদী ও বিসিআইসির ডিজিএম সাইফুল আলম বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠান কাতার ও সৌদি আরব থেকে ১ লাখ ৮৩ হাজার ১৫৬ মেট্রিক টন সার কেনে। মেসার্স নবাব অ্যান্ড কোম্পানি এই সার বুঝে নেয়। এর মধ্যে ৬৬ হাজার ৮৭৪ মেট্রিক টন সার বুঝিয়ে দিচ্ছেন না। গত আগস্ট থেকে গত ৩ নভেম্বর পর্যন্ত দফায় দফায় চিঠি দিয়ে সার বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য নবাব অ্যান্ড কোম্পানিকে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি টালবাহানা করে যাচ্ছে।’

প্রভাবশালী চক্রের প্রশ্রয় পেয়েছেন নবাব

বিসিআইসির কর্মকর্তারা বলছেন, বিভিন্ন সময়ে বিসিআইসির শত শত কোটি টাকার সার অবৈধভাবে বিক্রি করে দিলেও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ সুযোগে চট্টগ্রামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নবাব অ্যান্ড কোম্পানি দীর্ঘদিন ধরে সরকারের সার পাচার করছে। বিসিআইসির একটি প্রভাবশালী চক্রের যোগসাজশে প্রতিবছর সার গুদামে পৌঁছে দেওয়ার নামে কোটি কোটি টাকার সার বাইরে বিক্রি করে দেয়। গত দুই বছরে যেসব সার আমদানি করা হয়েছে, তার বেশিরভাগই তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন। নবাব বিরুদ্ধে কেবল সার পাচার নয়, সার পরিবহনের নামে অতিরিক্ত টাকার বিল তুলে নেওয়ার অভিযোগও আছে।
সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!