কর্ণফুলী গ্যাসে হরিলুট— কর্তা হয়ে দিয়েছেন, ঠিকাদার সেজে নিয়েছেন

জনপ্রতিনিধিসহ কেজিডিসিএল কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

চট্টগ্রামে এবার কর্ণফুলী গ্যাসের (কেজিডিসিএল) ভবন নির্মাণে উঠেছে পুকুরচুরির অভিযোগ। এই নির্মাণকাজ ঘিরে প্রায় ১০ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেন ছাড়াও কাজ না করেই প্রায় ৬ লাখ টাকা মেরে দেওয়ার তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে চট্টগ্রামের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ ঘটনায় এক জনপ্রতিনিধি ও ঠিকাদার ছাড়াও কর্ণফুলী গ্যাসের সাবেক এক কর্মকর্তা ও তার স্ত্রী জড়িত— এমন দাবি করেছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি।

রোববার (১৩ ফেব্রুয়ারি) চারজনকে আসামি করে দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ ব্যাপারে একটি মামলাটি দায়ের করা হয়েছে।

মামলায় আসামি করা হয়েছে কর্ণফুলী গ্যাসের অবসরপ্রাপ্ত সাবেক উপ-মহাব্যবস্থাপক আনিছ উদ্দিন আহমেদ শামীম (৬১) ও তার স্ত্রী কামরুন নাহার পলিকে (৫০)। অন্য দুই আসামির একজন চট্টগ্রামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেটকো কন্সট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নেছার আহমদ (৫৮) এবং অপরজন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নুর সিন্ডিকেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও রাউজান উপজেলা পরিষদের ভাইস-চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ (৬২)।

তাদের বিরুদ্ধে মোট ৯ কোটি ৯৩ লাখ ১৬ হাজার ৮৭৭ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন এবং ভবনের কাজ না করে ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৫৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে দুদকের মামলায়।

দুদকের অনুসন্ধানে কর্ণফুলী গ্যাসের ভবন নির্মাণে পুকুরচুরির মূল অভিযোগ আনা হয়েছে কর্ণফুলী গ্যাসেরই অবসরে যাওয়া উপ-মহাব্যবস্থাপক আনিছ উদ্দিন আহমেদ শামীমের বিরুদ্ধে। সব কলকাঠি তার হাত দিয়েই নড়েছে।

তদন্তে দেখা গেছে, আনিছ উদ্দিন আহমেদ নিজে সরকারি কর্মকর্তা ও কার্যাদেশ দেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হয়েও নিজেই খুলেছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হয়ে তিনি টেন্ডার আহ্বান করেছেন, আবার ঠিকাদার সেজে সেই টেন্ডারে অংশও নিয়েছেন। অন্যদিকে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হয়ে একদিকে তিনি কাজের বিল অনুমোদন করেছেন, আবার কৌশলে ঠিকাদার সেজে সেই বিলের টাকা বিভিন্ন একাউন্টেও ঢুকিয়ে নিয়েছেন।

অনুসন্ধান চালিয়ে দুদক জেনেছে, ২০১১ সালে কর্ণফুলী গ্যাসের ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত থাকাকালে আনিছ উদ্দিন আহমেদ চট্টগ্রামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেটকো কন্সট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নেছার আহমদ ও তার স্ত্রী নুসরাত জাহান এবং নিজের স্ত্রী কামরুন নাহারকে নিয়ে ‘রক প্রপার্টিজ’ নামের একটি আবাসন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। সেই কোম্পানির চেয়ারম্যান বানানো হয় আনিছ আহমেদের স্ত্রী কামরুন নাহারকে। নেছার আহমদকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক করে আনিছ উদ্দিন নিজে নেন পরিচালকের দায়িত্ব।

একই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের সিডিএ এভিনিউতে ঢাকা ব্যাংকের শাখায় ‘রক প্রপার্টিজের’ একাউন্ট খোলা হয়। নেছার আহমদ, কামরুন নাহার অথবা আনিছ উদ্দিন আহমেদের যৌথ স্বাক্ষরে ওই একাউন্টে লেনদেন পরিচালনা হতে থাকে।

এর কয়েক মাস পর ২০১২ সালে কর্ণফুলী গ্যাসের একটি ১০ তলা ভবন তৈরির জন্য নুর সিন্ডিকেট নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। সেই কার্যাদেশ দেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন আনিছ উদ্দিন আহমেদ। এরপর নুর সিন্ডিকেট ভবনটি তৈরির জন্য আনিছ উদ্দিনের মালিকানাধীন ‘রক প্রপার্টিজের’ সঙ্গে ‘চুক্তি’ করে। কথিত সেই ‘চুক্তি’ অনুযায়ী নুর সিন্ডিকেটকে ভবন নির্মাণকাজের মোট বিলের ১ দশমিক ৫ শতাংশ কমিশন) বাবদ প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়।

কর্ণফুলী গ্যাসের ১০ তলা সেই ভবন নির্মাণ কাজের বিল প্রত্যয়ন ও অনুমোদনের দায়িত্বপ্রাপ্তও ছিলেন আনিছ উদ্দিন আহমেদ নিজেই। দেখা গেছে, কার্যাদেশ পাওয়া প্রতিষ্ঠান হিসেবে নুর সিন্ডিকেট ভবন নির্মাণ কাজের বিল তুলে নিজেদের কমিশন কেটে রেখে দেয় এবং কথিত ‘চুক্তি’ অনুসারে বাকি সব টাকা ‘রক প্রপার্টিজের’ ব্যাংক একাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। এমন পুকুরচুরির পর সেই একাউন্টে আরও সন্দেহজনক লেনদেনের প্রমাণ পেয়েছে দুদক।

দুদকের তদন্তে দেখা গেছে, কর্ণফুলী গ্যাসের ১০ তলা সেই ভবন তৈরিতেও চক্রটি নিয়েছে জালিয়াতির আশ্রয়। প্রাথমিক অনুসন্ধানেই দুদক সেই ভবনে ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৫৩ টাকার কাজ কম পেয়েছে। এই টাকা আনিছ উদ্দিনসহ অন্যরা মেরে দিয়েছেন বলে দুদক অভিযোগ তুলেছে মামলায়।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!