চট্টগ্রামে ওয়াসার হেলাফেলায় ৪ কোটি টাকা পানিতে, ১৮০ ফায়ার হাইড্রেন্ট অকেজো প্রায়

চিঠি চালাচালিই সার, কাজে লাগছে না ফায়ার সার্ভিসেরই

দুই বছরেও চালু হয়নি চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন স্থানে বসানো ১৮০ ফায়ার হাইড্রেন্ট। ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম ওয়াসার বসানো এসব ফায়ার হাইড্রেন্ট পরিত্যক্ত হতে চলেছে। ফায়ার হাইড্রেন্টের থ্রেড সিস্টেম লক খোলার চাবিও এখনও ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেয়নি ওয়াসা। তাই আগুন লাগলেও তা নির্বাপণে কোনো কাজে আসবে না ফায়ার হাইড্রেন্ট। এখনও পর্যন্ত ১০ বারেরও বেশি চিঠি চালাচালি করেছে দুই সংস্থা, কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়নি।

ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের দাবি, এসব ফায়ার হাইড্রেন্টে অনেক ত্রুটি আছে। এছাড়া ওয়াসা যে লাইন থেকে এগুলোতে সংযোগ দিয়েছে তাতে পানির গতি কম। আগুন নেভাতে পাহাড়ি ঝর্নার মত স্পিড থাকতে হবে ফায়ার হাইড্রেন্টে।

তবে ওয়াসার দাবি, ফায়ার সার্ভিসের সাথে আলোচনা করেই এসব ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করা হয়েছে। তারা একেক সময় একক রকম কথা বলে। সাধারণত যে কোনো পানি সরবরাহ নেটওয়ার্কে ১ থেকে ১.৫ বার (২২.৫ পিএসআই) হয়। এর চাইতে বেশি প্রেসার থাকতে গেলে বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত লাইনের ফিটিংস ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জলাধার, বাসা-বাড়ির ট্যাংক থেকে পানি নিয়ে যে আগুন নেভানো হয়, সেখানে পানির প্রেসার কত থাকে?

এদিকে ফায়ার হাইড্রেন্টের কার্যকারিতা যাচাই ও ক্রুটি নিরসনে ২০২৩ সালের ২৯ নভেম্বর চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ পরিচালকের দপ্তর থেকে সুপারিশ পাঠানো হয়। চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্ণফুলী ওয়াটার সাপ্লাই প্রজেক্ট (ফেজ-২) প্রকল্প পরিচালকের কাছে পাঠানো সেই চিঠিতে বলা হয়, ওই বছরের ২০ সেপ্টেম্বর এবং ৫ অক্টোবর হাইড্রেন্টগুলোর কার্যকারিতা যাচাইকালে ত্রুটি পাওয়া গেছে। যা নিরসন করা আবশ্যক।

ত্রুটিগুলো হলো—পিলার হাইড্রেন্টের বিদ্যমান থ্রেড টাইপ কাপলিংগুলো ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কাপলিংয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও ব্যবহার অনুপযোগী, এসব হাইড্রেন্টের কাপলিংয়ে হোজ পাইপ সংযুক্ত করে পানিবাহী গাড়িতে পানি রিফিল করা যাবে না বা অগ্নিকাণ্ডস্থলে ডেলিভারি হোজ দ্বারা দূরবর্তী স্থানে পানি পৌঁছানো সম্ভব হবে না, পিলার হাইড্রেন্টের আন্ডারগ্রাউন্ডের মেইন পাইপ লাইনে পানির ওয়ার্কিং প্রেসার ১৫০ পিএসআই (১০ বার) এবং পিলার হাইড্রেন্টের ডিসচার্জ কাপলিংয়ে ৫০ থেকে ৬০ পিএসআই (৩.৫ বা ৪.০ বার) পানির প্রেসার থাকা দরকার, যা কার্যকারিতা যাচাইকালে পাওয়া যায়নি।

ত্রুটিসমূহ নিরসনে সুপারিশও করা হয় সেই চিঠিতে। সুপারিশগুলো হলো—পিলার হাইড্রেন্টের বিদ্যমান কাপলিং পরিবর্তন করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ব্যবহার উপযোগী ২.৫ ইঞ্চি ডায়া কুইক রিলিজ লক টাইপ ফিমেইল কাপলিং অথবা এ্যাডাপ্টর সংযুক্ত করে ব্যবহার উপযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে, বিদ্যমান হাইড্রেন্টে পানি প্রবাহের প্রেসার ন্যূনতম ৫০ থেকে ৬০ পিএসআই (৩.৫ বা ৪.০ বার) থাকা নিশ্চিত করতে হবে, অগ্নিনির্বাপণের সময় হাইড্রেন্টে প্রয়োজনীয় পানির প্রেসার নিশ্চিতের জন্য অগ্নি কবলিত এলাকায় পানির প্রবাহ সচল রেখে অন্যান্য সরবরাহ লাইন সাময়িক বন্ধ রাখার কারিগরি ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

এছাড়া অগ্নিকাণ্ডস্থলে পানি সরবরাহ পাওয়ার লক্ষ্যে চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃপক্ষের ১ জন প্রধান ও ১ জন বিকল্প দায়িত্বশীল কর্মকর্তার নাম, পদবি এবং মোবাইল নম্বরসহ মনোনয়ন প্রদান করে ২৪ ঘণ্টা অপারেশনালকালীন তার উপস্থিতি ও সাড়াপ্রদান সংযোগ নিশ্চিত করতে হবে।

চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কার্যালয়ের উপ পরিচালক দিনমনি শর্মা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তক স্থাপিত ফায়ার হাইড্রেন্টে পানি প্রবাহের প্রেসার ন্যূনতম ৫০ থেকে ৬০ পিএসআই (৩.৫ বা ৪.০ বার) থাকা নিশ্চিত করতে হয়। কিন্তু এসব পানির লাইন বাসাবাড়ির লাইনের সঙ্গে সংযুক্ত থাকায় সেখানে পানির চাপ ১ থেকে ১.৫ পর্যন্ত ওঠানামা করে। পানির প্রেসার না থাকায় এসব ফায়ার হাইড্রেন্টকে কাজে লাগাতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। এছাড়া এসব ফায়ার হাইড্রেন্টের লক খোলার চাবি চট্টগ্রাম ওয়াসার কাছে থাকায় অগ্নিকাণ্ডের সময় লক খুলতে খুলতেই আগুন নিভে যাবে।

তিনি বলেন, ‘ফায়ার হাইড্রেন্ট চালু করতে চট্টগ্রাম ওয়াসা ও ফায়ার সার্ভিস এ পর্যন্ত ১০ বারেরও বেশি চিঠি চালাচালি করেছে। কিন্তু দু’পক্ষের সমন্বয়হীনতায় ফায়ার হাইড্রেন্ট চালু না হওয়ায় ৪ কোটি ১০ লাখ টাকা জলে গেছে বলেই মনে হচ্ছে।’

চট্টগ্রাম ওয়াসা চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি আরেক চিঠিতে চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বরাবরে ফায়ার হাইড্রেন্টের কার্যিকারিতা যাচাই ও ক্রুটি নিরসনের বিষয়ে মন্তব্য জানায়।

ওই চিঠিতে ফায়ার সার্ভিসের উপ পরিচালককে চট্টগ্রাম ওয়াসা জানায়, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সঙ্গে আলোচনা করে (above ground pillar type) ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে পিলার হাইড্রেন্টে বিদ্যমান কাপলিংয়ের সঙ্গে উপযোগী কুইক রিলিজ ফিমেইল টাইপ কাপলিং ফায়ার সারভিসকে কেনার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।

সেই চিঠিতে ওয়াসা আরও জানায়, সাধারণত যে কোনো পানি সরবরাহ নেটওয়ার্কে ১ থেকে ১.৫ বার হয়। এর চাইতে বেশি প্রেসার থাকতে গেলে বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত লাইনের ফিটিংস ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই ১০ বার প্রেসার কোনোভাবেই ডিস্ট্রিবিউশন লাইনে রাখা সম্ভব নয়।

এই যুক্তির বিপরীতে ফায়ার সার্ভিস জানায়, ওয়াসার পানির প্রেসার ১ থেকে ১.৫। এই লো প্রেসার দ্বারা একটি ডেলিভারি হোজের মাধ্যমে পানিবাহী গাড়িতে পানি রিফিল করা ও একই প্রেসারে হাইড্রেন্ট থেকে ডেলিভারি হোজের মাধ্যমে অগ্নিকাণ্ডস্থলে পানি নিয়ে যাওয়া ও সজোরে আগুনে পানি নিক্ষেপ করা মোটেই সম্ভব নয়। এছাড়া বসানো পিলার হাইড্রেন্টে ফায়ার সার্ভিসের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বাড়ানোর যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা মোটেই বাস্তব সম্মত নয়।

চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক দিনমনি শর্মা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানোর জন্য আমাদের স্থান নির্বাচন করতে বলেছিল চট্টগ্রাম ওয়াসা। আমরা স্থান নির্বাচন করে দিয়েছি। কিন্তু তারা টেকনিক্যাল কোনো বিষয় নিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলেনি। টেকনিক্যাল সাপোর্ট চায়নি। তবে এটি কাজে লাগলে চট্টগ্রাম ওয়াসা একটা বড় উদাহরণ হতে পারত। কিন্তু এসব ফায়ার হাইড্রেন্ট এখন আমাদের কোনো কাজে লাগছে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘ফায়ার হাইড্রেন্টের থ্রেড সিস্টেম লক। লক খুলে দেওয়ার জন্য চাবি ফায়ার সার্ভিসকে দেওয়া হয়নি। আর এটা ফায়ার সার্ভিসের লোকজন খুলতেও পারবে না। কারণ ফায়ার সার্ভিসের পানিবাহী গাড়ির হুজ পাইপ। ফায়ার হাইড্রেন্টের থ্রেড সিস্টেমের লক এটার সঙ্গে সামঞ্জস্য নয়। লক খোলার জন্য ওয়াসাকে অবহিত করতে হবে, তারপর তারা এসে লক খুললে পানি ব্যবহার করা যাবে।

দিনমনি শর্মা বলেন, ‘আমাদের ফায়ার হাইড্রেন্টগুলো বুঝে নেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম ওয়াসা চাপ প্রয়োগ করছে। কিন্তু আমরা বুঝে নিতে রাজি হইনি। যে জিনিস ফায়ার সার্ভিসের কাজেই লাগেনি, তা বুঝে নিতে যাব কেন? আমরা জানিয়েছি, ওয়াসা মেইনটেইন্যান্স করবে, আমরা ব্যবহার করব। এসব ফায়ার হাইড্রেন্ট মেশিন ব্যবহার না করায় পরিত্যক্ত হতে চলেছে।’

তিনি বলেন, ‘ওয়াসার ১ থেকে ১.৫ বার পানির প্রেসারে তো ফায়ার সার্ভিসের পানিবাহী গাড়িতেই সরবরাহ করা যাবে না। আর বহুতল ভবনে কিভাবে করবে? আগুন নেভাতে খাগড়াছড়ির পাহাড়ি পানির ঝর্নার মত স্পিড থাকতে হবে।’

তবে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন চট্টগ্রাম ওয়াসার বিরাট কৃতিত্ব, দাবি করে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম ফজলুল্লাহ বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নমুনা নিয়ে এসব ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করা হয়েছে। দেশের আর কোনো শহরে এ ফায়ার হাইড্রেন্ট নেই। আমরা এটি স্থাপনের আগে অসংখ্যবার ফায়ার সার্ভিসের মতামত নিয়েছি। এখন এসে পানির প্রেসারের কথা বলে ফায়ার হাইড্রেন্টগুলো অকেজো রাখার তো কোনো মানে হয় না। ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক বলছেন, ওয়াসার লাইনে পানির প্রেসার কম। কিন্তু জলাধার, বাসা-বাড়ির ট্যাংক থেকে পানি নিয়ে যে আগুন নেভানো হয়, সেখানে পানির প্রেসার কত থাকে?’

তিনি আরও বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিস উপ-পরিচালক একেক সময় একেক সমস্যার কথা বলেন। আমি খুব শীঘ্রই এ বিষয়টি নিয়ে আবারো বসব, ফায়ার সার্ভিসকেও ডাকব। সেখানেই কথা হবে।’

ফায়ার সার্ভিসের হিসাব মতে, চট্টগ্রামে ২০২৩ সালে ১ হাজার ৪২৭টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। যেখানে ক্ষতি হয়েছে ২০ কোটি ১৮ লাখ ১০ হাজার ৯৫৫ টাকা। নিহত হয়েছেন ৩ জন, আহত হয়েছেন ৪১ জন।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!