করোনার বছরে যক্ষ্মা চিকিৎসা সেবায় চরম সংকট, শনাক্ত সংখ্যাও কমেছে

৮০টির বেশি দেশে যক্ষ্মা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে ডব্লিউএইচও বলছে, আগের বছরের চেয়ে ২০২০ সালে বিশ্বজুড়ে প্রায় ১৪ লাখ যক্ষ্মা রোগী চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিলেন। এর মধ্য দিয়ে ২০১৯ সালের তুলনায় গত বছর বিশ্বজুড়ে যক্ষ্মার চিকিৎসা নেওয়া রোগী কমেছে ২১ শতাংশ। গত ২৪ মার্চ ইউএন নিউজে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওই তথ্য তুলে ধরা হয়। চট্টগ্রামেও ঘটেছে এমনটাই। করোনার কারণে উপেক্ষিত হয়েছে যক্ষা রোগীর চিকিৎসা। ২০১৯ সালের চেয়ে ২০২০ সালে চট্টগ্রামে যক্ষা সংক্রমণ ও শনাক্তের হার কমেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালের গোড়ার দিকে চীনের উহান থেকে বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। এরপর দ্রুতই রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে দেশে দেশে। ফলে চাপ বেড়ে যায় চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর। এ পরিস্থিতিতে অন্যান্য রোগের চিকিৎসা বাধাগ্রস্ত হতে থাকে।

সংস্থাটির বরাতে ইউএন নিউজে আরো বলেছে, কম রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন মানে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে, বিষয়টা এমন নয়। বরং করোনাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে যক্ষ্মার চিকিৎসা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এটা যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে আগের অর্জনগুলো ম্লান করে দিতে পারে।

চট্টগ্রাম জেলায় ২০২০ সালে সর্বমোট যক্ষা রোগী শনাক্ত হয় ১৪ হাজার ১১৬ জন। ২০১৯ সালে শনাক্ত হয়েছিল ১৯ হাজার ৮৮১ জন। এর মধ্যে ফুসফুস আক্রান্ত যক্ষা রোগীর সংখ্যা ২০২০ সালে ছিল ১০ হাজার ৭১ জন। ২০১৯ সালে ছিল ১১ হাজার ২৯৫ জন। ফুসফুস বহির্ভুত যক্ষা রোগীর সংখ্যা ২০২০ সালে ৪ হাজার ৪৫ জন। ২০১৯ সালে ছিল ৫ হাজার ৯৭১ জন।

ফুসফুস আক্রান্ত জীবানুযুক্ত নতুন যক্ষা রোগী শনাক্তকরণের হার ২০২০ সালে ছিল ৬৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ (প্রতি ১ লাখ জনসংখ্যায় প্রতিবছর)। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ছিল ৯৬ শতাংশ। সার্বিক যক্ষা রোগ শনাক্তকরণের হার ২০২০ সালে ১২০(প্রতি ১ লাখ জনসংখ্যায় প্রতি বছর), ২০১৯ সালে সেটি ছিল ১৬৯। চিকিৎসা প্রাপ্ত রোগীর মধ্যে সাফল্যের হার ৯৬ শতাংশ। ২০১৯ সালে সেটি ছিল ৯৭ শতাংশ।

শনাক্তকৃত রোগীর মধ্য শিশু যক্ষা রোগীর সংখ্যা ছিল ৬৫৬ জন। ২০১৯ সালে ছিল ১১৪১ জন। চিকিৎসাধীন রোগীর মধ্যে ২০২০ সালে যক্ষা ও অনান্য কারণে মৃত্যু হয়েছে ৩১৪ জনের। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৪৬ জন। সন্দেহজনক রোগীর (যাদের দুই সপ্তাহের বেশি কাশি আছে) কফ পরীক্ষা করা হয় ২০২০ সালে ৮৬ হাজার ২৮৫ জন। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২৭ হাজার ৫১৬ জন। ২০২০ সালে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষা রোগীর সংখ্যা ৯২ জন। ২০১৯ সালে এটি ছিল ১৪০ জন। ২০১১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষা রোগী শনাক্ত হয় ৮৭০ জন। ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষা চিকিৎসায় সাফল্যের হার ৬৯ শতাংশ। বর্তমানে চিকিৎসাধীন ডিআর টিবি (ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স বা ওষুধ প্রতিরোধী) রোগীর সংখ্যা্ ১৭২ জন। ডিআর টিবি শনাক্তকরণের পরীক্ষাগার চট্টগ্রামে মোট ৭টি।

২০১৯ সালের চেয়ে ২০২০ সালে যক্ষা সনাক্তকরণের হার কম ও যক্ষা রোগীর সংখ্যা কম হওয়ার কারণ হিসেবে চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন অফিস বলছে, করোনার কারণে যক্ষা রোগীরা ডটস সেন্টারে গিয়ে চিকিৎসা সেবা নিতে পারেননি। অনেকে করোনা ভীতিতেও যক্ষা রোগকে করোনাকালে গোপন করছেন। এভাবেই যক্ষা রোগে চট্টগ্রামে সুরক্ষা তেমন মিলছে না। এছাড়া সুচিকিৎসায় রয়েছে নানা সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা।

নগরীর জেনারেল হাসপাতাল প্রাঙ্গণে অবস্থিত বক্ষব্যাধি ক্লিনিকে লোকবল স্বল্পতা, এক্সরে মেশিন নষ্ট, ওষুধ স্বল্পতা, চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস প্রীতি বিভিন্ন কারণে এ ক্লিনিকে এসে রোগীর সুচিকিৎসা কম মিলছে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে প্রচারণার অভাবে ফৌজদারহাট বক্ষব্যাধি হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা বাড়লেও রোগীবান্ধব হয়নি। এদিকে মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট (এমডিআর) বা ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষা রোগী সন্দেহের তালিকায় বেশি থাকলেও মেশিনের কার্যকারিতারর অভাবে এ টিবি শনাক্ত হচ্ছে কম। আবার যাদের এমডিআর টিবি শনাক্ত হচ্ছে তারা অনিয়মিত ওষুধ সেবন বা পূর্ণ চিকিৎসা শেষ করছেন না। এসব তথ্য মিলেছে সিভিল সার্জন অফিস থেকে প্রাপ্ত চট্টগ্রাম জেলার যক্ষা বিষয়ক প্রতিবেদন থেকে।

জানা গেছে, যক্ষ্মা রোগের চারটি স্তর রয়েছ। এর মধ্যে রয়েছে প্রাথমিক যক্ষ্মা রোগ, দ্বিতীয় স্তর হলো এমডিআর, তৃতীয়টি হলো এক্সডিআর এবং চতুর্থটি হলো টোটাল ড্রাগ রেজিসটেন্ট (টিডিআর)। এর মধ্যে প্রাথমিক যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের বক্ষব্যাধি ক্লিনিকে দেয়া হয়। দ্বিতীয় স্তরের রোগীর জন্য আধুনিক ও অত্যধুনিক চিকিৎসা উপকরণ সমৃদ্ধ ল্যাবরেটরিতে শনাক্ত করা হয় এমডিআর। এমডিআর যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর তাদেরকে ফৌজদার হাট বক্ষব্যাধি হাসপাতালে সরকারিভাবে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়ার জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়।

এমডিআর ল্যাব সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের বহির্বিভাগের চতুর্থ তলায় ২০১০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠা করা হয় আঞ্চলিক যক্ষা পরীক্ষাগার (আরটিআর) এ ল্যাবটি। আধুনিক চিকিৎসা উপকরণ সমৃদ্ধ এধরনের ল্যাব দেশে আছে তিনটি- ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে। কিন্তু এমডিআর যক্ষ্মা শনাক্তের হার বাড়ানোর জন্য জেনারেল হাসপাতালের জিন এক্সপার্ট যন্ত্রের (এই যন্ত্রে দুই ঘণ্টার মধ্যে এমডিআর যক্ষ্মা জীবাণু শনাক্ত করা যায়) ১৬টি অংশের ২টি অংশ নষ্ট রয়েছে। যার ফলে ১৬টি টেস্ট যেখানে হওয়ার কথা সেখানে তা হচ্ছে না।

জানা যায়, প্রাথমিকভাবে যক্ষা নিরুপণের জন্য জেনারেল হাসপাতাল প্রাঙ্গণে বক্ষব্যাধি ক্লিনিকে লোকবল সংকটসহ নানান সমস্যা বিরাজ করছে। মাত্র একজন কনসালট্যান্ট আর ১ জন মেডিকেল অফিসারকে দিয়ে চলছে চিকিৎসা। দীর্ঘদিন এক্সরে মেশিন নষ্ট। নেই রেডিওলজিস্ট ও রেডিওগ্রাফার। তাই অনেকসময় শুধুমাত্র কফ পরীক্ষা করেও যক্ষা রোগ নিরুপণ করা যাচ্ছে না। অনেক রোগীকে বাইরের কোন ল্যাবে এক্সরে করার পরামর্শ দিলেও অনেক গরীব রোগীর পক্ষে তা করা সম্ভব হয় না।

অভিযোগ আছে, এ ক্লিনিকের কনসালট্যান্ট রোগীদের হাতে কার্ড ধরিয়ে দিয়ে চেম্বারে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কনসালট্যান্টের ভিজিটিং কার্ডে যে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চেম্বার করেন শুধু সেটির ঠিকানা দেওয়া আছে। এদিকে বক্ষব্যাধি ক্লিনিক থেকে বিনামূল্যে সরকারি ওষুধ ও যক্ষা রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও রোগীকে ডটস কর্নারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু ডটস কর্নারে গিয়ে রোগী নিয়মিত ওষুধ সেবন করেন না। মূলত যক্ষায় আক্রান্ত হওয়ার পর অনিয়মিত ওষুধ সেবন এবং চিকিৎসার পূর্ণ কোর্স শেষ না করার কারণে জটিল আকার ধারণ করে। আর এ রোগীকে বলা হচ্ছে এমডিআর রোগী। যার চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদী।

বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যক্ষ্মার জীবাণু পুরোপুরি ধ্বংস করতে সঠিক মাত্রায় ছয় মাস পূর্ণ মেয়াদে ওষুধ সেবন করতে হয়। অনেকে এক-দুই মাস ওষুধ খেয়ে একটু সুস্থ হওয়ার পর ওষুধ ছেড়ে দেয়। তখন ওষুধের মাত্রা ঠিক না থাকায় অথবা কোর্স শেষ না হলে জীবাণু ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। তখন নতুন মাত্রায় প্রায় দুই বছর ওষুধ সেবন করতে হয়। যা ব্যয়বহুল। আবার যারা এমডিআর যক্ষ্মার রোগী, তারা সরাসরি এমডিআর যক্ষ্মার জীবাণু ছড়ায়।

চট্টগ্রাম বক্ষব্যাধি ক্লিনিকের কনসালট্যান্ট ডা. মোস্তফা নূর মোর্শেদ বলেন, এমডিআর যক্ষা শনাক্ত হলে রোগীকে ২৪ মাসের চিকিৎসার জন্য ফৌজদারহাট বক্ষ্যব্যধি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়ার নিয়ম রয়েছে। সেখানে বিনামূল্যে ওষুধ, ইঞ্জেকশন দেয়া হয়। কিন্তু রোগীরা সেখানে যেতে চান না। আবার অনেক রোগীকে প্রয়োজনে ৬ মাসের চিকিৎসার পর বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। বাসায় তাকে হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মী বা ডটস কর্নারের কর্মীরা ওষুধ খাওয়ানো এবং নিয়মিত ইঞ্জেকশন দিয়ে আসার নিয়ম। কিন্তু ডটস কর্মীদের তা না করার অভিযোগ রয়েছে। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা করোনার কারণে রোগীর উপস্থিতি কম ছিল। যার ফলে আমরা ট্রেসিং করতে পারিনি। রোগীকে ডায়াগনসিস করা যায়নি। তবে অবস্থার এখন কিছুটা উন্নতি হয়েছে। রোগীরা আগের তুলনায় বেশি আসছেন বক্ষব্যাধি ক্লিনিকে, বলেন ডা: মোস্তফা নূর মোর্শেদ।

কেএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!