কক্সবাজারে হোটেল—মোটেলে হাত বাড়ালেই ইয়াবা, একমাসে তিন পর্যটকের মৃত্যু

কক্সবাজার শহরের কলাতলী হোটেল-মোটেল জোনের আবাসিক হোটেল ও কটেজ গুলোতে হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় ইয়াবা। দিন-রাত এসব হোটেল-মোটেল ও কটেজ রুমে বসে ইয়াবা সেবনের আসর। শুধু স্থানীয় মাদকাসক্তরা নয়, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বেড়াতে আসা পর্যটকেরাও হোটেল ও কটেজগুলোতে বসায় ইয়াবা সেবনের আসর।

এর ফলে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে ইয়াবা সেবনে পর্যটক শিক্ষার্থীদের মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। অতিরিক্ত ইয়াবা সেবন ও মদপানের পর বিষক্রিয়ায় গত এক মাসেই মৃত্যু হয়েছে ৩ শিক্ষার্থীর। তবে এখনো ইয়াবা সেবনে স্থানীয় কারো মৃত্যু না হলেও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে কয়েকজন। তাছাড়া গত এক মাসে হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেছে অন্তত ২০ থেকে ২৫ জন।

সর্বশেষ ২ ফেব্রুয়ারি অতিরিক্ত ইয়াবা সেবনে মৃত্যু হয় দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের। এরা হলো-ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবির রহমান রুমি (২৪) ও তার বন্ধু ঢাকার ইন্ডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মোহাম্মদ আরিফিন (২৫)।

এদের মধ্যে আবির কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ও আরিফিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।

এর আগে চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি অতিরিক্ত ইয়াবা সেবন করে স্বর্ণা রশিদ (২২) নামের এক ছাত্রীর মৃত্যু হয়। ব্রিটিশ কাউন্সিলে প্রাইভেট পড়ুয়া ওই তরুণী ঢাকা চকবাজারের ৭ নম্বর বেগমবাজার এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হারুন-উর-রশিদ পাপ্পুর মেয়ে। এছাড়া ২০১৯ সালের ২২ ডিসেম্বর অতিরিক্ত ইয়াবা সেবনে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন লাজিম খান (২৫) নামে এক পর্যটক। আশঙ্কাজনক অবস্থায় ওই পর্যটককে প্রথমে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়।

ইয়াবা সেবী পর্যটক লাজিম পুরান ঢাকার আবুল হাসেমের পুত্র। সে ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সাইন্স বিভাগের ছাত্র। অভিযোগ রয়েছে হোটেল-মোটেল ও কটেজের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারি পর্যটকদের মাঝে ইয়াবা সরবরাহ করে।

নিরবেই তারা চাকরির আড়ালে ইয়াবা বাণিজ্য করে আসছে বলে জানান স্থানীয়রা। মাদকাসক্ত পর্যটক ছাড়াও শখের বশে আবেগপ্রবণ হয়েও অনেক পর্যটকরা মিলে মিশে আসর বসিয়ে ইয়াবা সেবন করে।

এদিকে কক্সবাজারে বেড়াতে এসে হোটেল কক্ষে আসরে বন্ধুদের সাথে মাত্রারিক্ত ইয়াবা সেবন পর্যটকদের একের পর নিহতের ঘটনায় বেশ আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এতে কক্সবাজারের হোটেল কটেজ গুলোতে কতটুকু পর্যটন পরিবেশ রয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, শহরের কলাতলীর অধিকাংশ হোটেল ও কটেজে ইয়াবা বিকিকিনি চলে। হোটেল কর্তৃপক্ষ ও হোটেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরাসরি এই ইয়াবা বিকিকিনির সাথে জড়িত। তারা টার্গেট করে পর্যটকসহ হোটেল উঠা অতিথিদের ইয়াবা বিক্রির প্রস্তাব দেয়। আবার স্থানীয় মাদকসেবীরা নির্দিষ্ট সময় মাফিক কক্ষ ভাড়া নিয়ে হোটেল ও কটেজ গুলোতে নিয়মিত ইয়াবার আসর বসায়।

কক্সবাজারে হোটেল—মোটেলে হাত বাড়ালেই ইয়াবা, একমাসে তিন পর্যটকের মৃত্যু 1

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন হোটেল ও কটেজ পরিচালনকারী কর্মকর্তা জানান, পর্যটনের অফ সীজনে যখন খালি থাকে তখন হোটেল ও কটেজ গুলো ইয়াবা সেবন, জুয়ার আসর ও পতিতায় ভরে থাকে। স্থানীয় মাদক সেবী ও জুয়াখোররা প্রতিনিয়ত হোটেল ও কটেজ গুলোর কক্ষে কক্ষে এসব আসর বসায়। এসব ইয়াবা আসরের অধিকাংশই হোটেল ও কটেজের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাধ্যমে সরবরাহ হয়। তাই হাত বাড়ালেই মিলে ইয়াবা। কিন্তু পর্যটন মৌসুম শুরু হলে পর্যটক ভাড়া থাকায় স্থানীয়দের ইয়াবা সেবনের আসর অনেকটা কমে আসে। কিন্তু ইয়াবা সরবরাহকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ইয়াবার বিকিকিনিতে লিপ্ত থাকে।

হোটেল ও কটেজের পরিচালনকারী ওই কর্মকর্তা আরো জানান, হোটেল ও কটেজ গুলোতে পর্যটক উঠলে তাদেরকে টার্গেট করে ইয়াবা বিকিকিনির সাথে জড়িত হোটেল কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। বন্ধু-বান্ধব মিলে যে সব পর্যটক আসে তাদেরকে টার্গেট করে ইয়াবা সরবরাহ করে। মাদকাসক্ত না হলেও অনেক পর্যটক ‘মজা’ করার জন্য বন্ধুদের নিয়ে হোটেল কক্ষে ইয়াবা সেবনে লিপ্ত হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে শহরের কলাতলীর হোটেল ও কটেজ কেন্দ্রীক জমজমাট ইয়াবা ব্যবসা চলে আসছে। মূলত পর্যটকদের টার্গেট করেই সেখানে এই ইয়াবা ব্যবসা চলে আসছে। হোটেল ও কটেজের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এই ইয়াবা ব্যবসা মূল নিয়ন্ত্রক। পাশাপাশি হোটেল ও কটেজ সংলগ্ন পানের দোকানগুলোতে ইয়াবা মিলে। পাইকারী ইয়াবা ব্যবসায়ীরা হোটেল ও কটেজের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ব্যবহার করে কক্সবাজারের পর্যটন জোন কলাতলীকে এক প্রকার ইয়াবার অঞ্চল বানিয়েছে। অনেকটা প্রকাশ্যে এই ইয়াবার বিকিকিনি চললেও দায়িত্বরত পুলিশ বা অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা রহস্যজনক কারণে নীরব ভূমিকা পালন করে-এমন অভিযোগও রয়েছে।

কক্সবাজার হোটেল-মোটেল ও গেস্ট হাউজ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার জানান, হোটেল-মোটেল ও কটেজ গুলোর ইয়াবার নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা সব সময় চেষ্টা করি। আমরা এবং প্রশাসন মিলে অনেক কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। কিন্তু তারপরও তা প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে। মূলত অসাধু এবং নিন্ম শ্রেণির হোটেল কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এই অপকর্মের সাথে জড়িয়ে পড়ে। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি, অন্তত তা নিয়ন্ত্রণে হলে থাকবে।

কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. শাহীন আবদুর রহমান চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান-বিভিন্ন সময় তিনি অর্ধশত পর্যটককে চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন, যারা কক্সবাজার বেড়াতে এসে অতিরিক্ত মাদক সেবন করে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

তিনি বলেন, চিকিৎসা নিয়ে অনেকে ভালো হয়েছেন। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় অনেক পর্যটককে উন্নত চিকিৎসার জন্য রেফার করা হয়েছে। মাদকাসক্ত সব রোগীর সিমটম একই। অতিরিক্ত ইয়াবা সেবনের কারণে সবার শরীরে বিষক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে। রোগীর শরীরে বিষক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ার মাত্রা বেশি হলে রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয় না। আবার দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসা হলে চিকিৎসা দিয়ে সারিয়ে তোলা যায়।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, অতিরিক্ত মদ পান ও ইয়াবা সেবনে কয়েকজন পর্যটকের মৃত্যুর পর বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে পুলিশ। ইতিমধ্যে আবাসিক হোটেলগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি পর্যটকদেরও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, পুলিশের পক্ষে প্রতিজন পর্যটককে পাহারা দেয়া সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সবার আগে পর্যটকদের সচেতন হতে হবে।

এসএইচ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!