এশা ত্রিপুরার রহস্যজনক ‘মৃত্যু’ কি ঠান্ডা মাথার খুন?

আদালতে চার্জগঠনের পর শুরু হবে বিচারকাজ

পাহাড়ি জেলা খাগড়াছড়ির আলোচিত স্কুল শিক্ষিকা এশা ত্রিপুরা ওরফে নবীনার রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশের অভিযোগপত্র দাখিলের পর মামলার বাদি এশার ভাই খোকা রঞ্জন ত্রিপুরাকে শুনানিতে ডেকেছেন আদালত। আদালতকে মামলার বাদি খোকা অভিযোগপত্র (চার্জশিট) নিয়ে তার কোনও আপত্তি নেই জানিয়ে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেছেন। এখন জেলা ও দায়রা জজ আদালতে চার্জগঠনের (অভিযোগ) পরই শুরু হবে আলোচিত এই হত্যামামলার বিচার কার্যক্রম। এদিকে রহস্যজনক এই মৃত্যুকে ‘হত্যা’ দাবি করে ন্যায়বিচার চেয়েছেন পরিবার ও নারী অধিকারকর্মীরা।

২০২৩ সালের ২১ জুলাই ভোরে ৪২ বছর বয়সী এশা ত্রিপুরা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে মারা গেছেন দাবি করে এশাকে হাসপাতালে নিয়ে যান তার স্বামী উদ্দীপন ত্রিপুরা (৪৫) এবং প্রতিবেশীরা। কিন্তু হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা এটিকে ‘স্ট্রোকে’র মৃত্যু নয় বলে জানালে উদ্দীপন লাশের ময়নাতদন্ত না করার জন্যও সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন বলে জানিয়েছেন এশার স্বজনরা। পরে পুলিশ লাশের ময়নাতদন্ত করতে বাধ্য করে এবং ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়।

ওই সময়ে এশার সুরতহাল প্রতিবেদনে শরীরে আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট দেখা যায়। এশা ত্রিপুরা বাথরুমে পড়ে আঘাত পেয়েছে— তার স্বামী উদ্দীপন ত্রিপুরা এমন দাবি করলেও এশার ভাই খোকা রঞ্জন ত্রিপুরা রহস্যজনক এই ঘটনায় একটি হত্যামামলা দায়ের করেন। এই মামলায় ঘটনার পরদিন ২২ জুলাই এশার স্বামী উদ্দীপন ত্রিপুরাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে নেওয়া হয় দুইদিনের রিমান্ডে। বর্তমানে এশার স্বামী উদ্দীপন ত্রিপুরা কারাগারে আছেন।

জানা গেছে, এশার স্বামী উদ্দীপন ত্রিপুরা খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ৫ নম্বর ভাইবোনছড়া ইউনিয়নের লম্বাপাড়ার মনোরঞ্জন ত্রিপুরার ছেলে। তবে দুই সন্তান নিয়ে এই দম্পতি জেলা শহরের পশ্চিম মহাজন পাড়ায় বোধিস্বত্ত্ব দেওয়ানের বাসায় ভাড়ায় থাকতেন। এশা ত্রিপুরা খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার তপ্ত মাস্টার পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা ছিলেন। এশা আর উদ্দীপনের ১৫ বছরের দাম্পত্য জীবনে মুগ্ধ ও প্রাচী নামের এক ছেলে ও এক কন্যাসন্তান রয়েছে।

এদিকে মামলা অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার বাদি ও স্কুল শিক্ষিকা এশা ত্রিপুরার ভাই খোকা রঞ্জন ত্রিপুরা (৫৫) জানিয়েছেন, ‘বিজ্ঞ আদালত আমার কাছ থেকে জানতে চেয়েছেন পুলিশ যে চার্জশিট দিয়েছে; সেটির ওপর আমার কোনও আপত্তি রয়েছে কিনা। আদালতকে বলেছি আমার কোনও আপত্তি নেই। আমি বোন হত্যার ন্যায়বিচার চাই এবং বিচার কার্যক্রম যেন দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয় সেই দাবি জানিয়েছি।’

কী আছে অভিযোগপত্রে?
গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ি চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) ও খাগড়াছড়ি সদর থানার পরিদর্শক উৎপল বিশ্বাস। পুলিশের অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, হত্যাি মামলার বাদী খোকা রঞ্জন ত্রিপুরার বোনের (এশা ত্রিপুরা) মাথায় আঘাতের চিহ্ন দেখে বোঝা যায় কে বা কারা পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করেছে। এ ঘটনায় এশার স্বামী উদ্দীপন এশার মৃত্যুকে ভিন্ন খাতে তথা ‘দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু’ বলে প্রচারের চেষ্টা করেন।

অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, এশা ত্রিপুরা ও তার বেকার স্বামীর দাম্পত্যজীবনে কলহ ছিল। একে-অপরকে পরকীয়া জড়িত বলে সন্দেহ করতেন। পুলিশের রিমান্ডে এশার স্বামী উদ্দীপন হত্যার বিষয়টি স্বীকার না করলেও ময়নাতদন্ত রিপোর্ট, সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তি, সুরতহাল ও আলামত দৃষ্টে ঘরের ভেতর ধারালো অস্ত্র দ্বারা এশা ত্রিপুরা প্রকাশ নবীনার মাথাসহ শরীরের অন্যত্র কুপিয়ে হত্যা করে মর্মে প্রতীয়মান হয়।

খাগড়াছড়ি সদর থানার পরিদর্শক ও মামলার আইও উৎপল বিশ্বাস বলেন, ‘ময়নাতদন্ত রিপোর্ট, সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তি, সুরতহাল ও আলামত; সবকিছু পর্যালোচনা করে আদালতে আমি চার্জশিট দাখিল করেছি। এ ঘটনায় আদালত আমাকে এখনও ডাকেননি; যে কারণে আপাতত চার্জশিট দাখিলের পরবর্তীতে নতুন কোন তথ্য আমার জানা নেই।’

যা বলছেন আইনজীবী ও বিশিষ্টজনরা
মামলার বাদিপক্ষের আইনজীবী বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শহীদুল্লাহ ভূঁঞা বলেন, ‘এই মামলায় চার্জশিট দাখিলের পর আদালতে চার্জশিটের শুনানি হয়েছে। এখন নিম্ন আদালত থেকে জজ কোর্টে মামলা স্থানান্তর হয়েছে। এরপর আদালত চার্জ গঠনের পর বিচার কার্যক্রম শুরু হবে। আমরা আশাবাদী বাদিপক্ষ ন্যায়বিচার পাবেন।’

খাগড়াপুর মহিলা কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক (ইডি) ও উইমেন রিসোর্স নেটওয়ার্কের প্রাক্তন আহ্বায়ক শেফালিকা ত্রিপুরা বলেন, ‘ঘটনার দিন বাসায় এশার স্বামী ও পরিবার ছাড়া অন্য কেউ ছিল না। পুলিশের অভিযোগপত্রেও এশার স্বামীকে দায়ী করা হয়েছে। আমরা মনে করি আইন আইনের গতিতে চলছে, চলুক। আমাদের প্রত্যাশা ভিকটিমের (এশা ত্রিপুরা) পরিবার ন্যায়বিচার পাবেন। এমন ঘটনার যদি বিচার না হয় তবে এটি সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ঘরে-ঘরে এমন জঘন্য ঘটনা ঘটতেই থাকবে। আমার এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই এবং আইনের প্রতি আমাদের আস্থা রয়েছে।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!