আগুনে ঘরহারা হাজারো মানুষের রাত কাটবে খোলা আকাশের নিচে

প্রতিবন্ধী লিপির ৯ বছরের সঞ্চয় আগুনে ছাই

হাতে সবুজ-সাদা রঙের একটা প্যাকেট। কেউ একজন হাতে দিয়ে গেলো। অন্যদিন এই খাবার প্যাকেট পেলে একমাত্র মেয়ে মাহিমাকে নিয়ে মজা করে খেতো। কিন্তু আজ তার খাবারের প্যাকেটের দিকে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। হুইলচেয়ারে বসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লিপি। চোখজোড়া স্থির হয়ে আছে। ভিক্ষা করে নয় বছর ধরে তিলে তিলে গড়া সব সঞ্চয় পুড়ে ছাই হয়ে গড়িয়ে পড়ছে ময়লা পানিতে।

তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে চট্টগ্রাম নগরের শুলকবহর বস্তিতে থাকেন শারীরিক প্রতিবন্ধী কাজী লিপি আক্তার। স্বামী থেকেও নেই। মেয়েকে নিয়ে মানুষের দয়ায় চলে লিপির সংসার। ভিক্ষা আর প্রতিবন্ধী ভাতায় গড়া ৯ বছরের সহায় সম্বল আগুনে পুড়ে ছাই।

‘সামনের মাসে দশ তারিখ টাকা দিবে। আমি বই ছাড়া কি দিয়ে টাকা নিবো!’ পাশে থাকা কয়েকজন মহিলা লিপিকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন- ‘দেবে দেবে’ বলে।

‘ভাতার বই ছাড়া টাকা তুলতে পারবো না। আমার মেয়ের বই, স্কুলের ড্রেস সব…..। এখন নতুন করে স্কুলের ড্রেস সেলাইতে হবে— ছলছল চোখে কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন লিপি।

এদিকে ছোট দুই ছেলেকে ঘরে রেখে প্রতিদিনের মতন সকালে কাজে বের হন গৃহপরিচারিকা রোকেয়া আক্তার। ঘন্টা দুয়েক পরে খবর পান কলোনিতে আগুন লেগেছে। ছুটে আসলেও কিছুই বের করতে পারেনি আগুনের থাবা থেকে। অন্যের বাসায় কাজ করলেও ঘরে কোনও জিনিসের কমতি ছিল না।

লিপি, রোকেয়ার মতন শুলকবহরের বস্তিতে সকালের আগুনে গৃহহীন হয়েছে প্রায় তিনশ’ পরিবার। সব হারিয়ে এক কাপড়ে ঠাঁই হয়েছে খোলা আকাশের নিচে। এই বস্তির বাসিন্দাদের সবাই নিম্ন আয়ের মানুষ। দিনমজুর, গৃহকর্মী, রিকশা চালক-এসব পেশার মানুষের বসবাস সেখানে। অধিকাংশ ঘর থেকেই আগুন লাগার পর কোনও আসবাবপত্র বের করা যায়নি। কেউ কেউ সামান্য কিছু জিনিসপত্র বের করতে পারলেও মাথা গোঁজার ঠাঁই গেছে সবার।

শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) সকালে আগুন লাগার খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের বিভিন্ন স্টেশন থেকে পাঁচটি ইউনিটের ১৫টি গাড়ি নগরীর পাঁচলাইশ থানার মির্জাপুল সংলগ্ন ডেকোরেশন গলির বাবু কলোনি বস্তি এলাকায় যায়। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও গৃহহীন হয়েছে প্রায় তিনশ’ পরিবার।

আগুন লাগার কারণ
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত। তবে বস্তিবাসীদের দাবি চুলার আগুন থেকেই আগুনের সূত্রপাত। এদিকে, আগুন লাগার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গেলেও দেড় ঘন্টা পর্যন্ত আগুনের ধারে কাছে পৌঁছাতে পারেনি ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, কলোনির গলি সরু ও সংকীর্ণ হওয়ায় আগুন নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হয়েছে।

তবে আগুনে গৃহহীন মানুষের দাবি রাস্তা সরুর জন্য দায়ী বাড়ির মালিকেরা। তারা মালিকদের বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও কলোনিতে প্রবেশের মুখে নতুন সেলুন দোকান তৈরি করে রাস্তা সংকীর্ণ করে ফেলে। পাশে থাকা বৈদ্যুতিক খুঁটি আর দোকানের কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঘটনাস্থলে আগুনের কাছে যেতে সক্ষম হয়নি।

বেলাল নামের এক রিকশাচালক বলেন, ‘আমগো তো সব শেষ। কত কইছি মালিকদের। আল্লাহ না করুক আগুন লাগলে একজনেও বাঁচতো না। দুই মাস আগে কইছিলাম। সেই তো আগুন লাগছে। আমগো সব শেষ! সব শেষ! সব শেষ।’

মরিয়ম বিবি নামের একজন বলেন, ‘খাইরুল ইনচার্জ মালিককে বারবার বলছে তাও হেরা শুনে নাই। আইজ তাগো লাই আমরা ঘরছাড়া। এই শীতে পোলা-মাইয়া লই কই থাকুম। আমরারে কিছু সাহায্য করেন।’

চট্টগ্রামের ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক ফরিদ উদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রায় সাড়ে এগারোটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে আগুন পুরোপুরি নেভাতে বেজে যায় বিকেল তিনটা। বস্তির সামনে রাস্তা ছিল খুব সরু। এজন্য আমাদের সব গাড়ি প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে মূল সড়কে রাখতে হয়েছে। সেখান থেকে পাইপ নিয়ে যেতে হয়েছে বস্তিতে। আশপাশে পানির কোনও ব্যবস্থা না থাকায় নিজস্ব উৎসের পানি ব্যবহার করতে হয়েছে আর সে জন্য আগুন নেভাতে আমাদের একটু সময় লেগেছে। তদন্তের স্বার্থে আর বেশি কিছু বলা যাচ্ছে না। ‘

ক্ষয়ক্ষতির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আগুন নেভাতে সময় বেশি লাগার কারণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে। সবগুলো ঘর ছিল কাঁচা। টিনের ছাউনি ও বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি। সেজন্য আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে।’

এসএ/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!