শুলকবহরের আগুনে সব হারাল পরিবারগুলো

রোকেয়া মানুষের বাসাবাড়িতে কাজ ঝিয়ের কাজ করেন আর নুরনবী রাজমিস্ত্রী। কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দির রোকেয়া বেগম আর কিশোরগঞ্জের ছেলে নুর নবীর এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে ছোট্ট সংসার। শুক্রবার হওয়ায় নুরনবী বাসা থেকে বের হননি। স্ত্রী যথারীতি চট্টগ্রাম নগরীর সুগন্ধা আবাসিক এলাকায় গিয়েছিলেন কাজ করতে। তখনই খবর পান, নগরীর শুলকবহরের পুরাতন ওয়াপদা সংলগ্ন ডেন্টাল মেডিকেলের পাশে ডেকোরেশন গলির বাবু কলোনিতে আগুন লেগেছে।
খবর পেয়ে বাসায় আসতে গিয়ে আটকা পড়েন উৎসুক জনতার ভীড়ে। ভীড় পার হয়ে বাসার কাছে যেতে চেয়ে পারেন নি। দাউ দাউ জ্বলছে নিজের সাজানো ঘর। খোঁজাখুজি শুরু করলেন স্বামী সন্তানদের। স্বামীকে পেলেন রেডক্রিসেন্টের মোবাইল চিকিৎসা কেন্দ্রে। স্বামী নুরনবীর পাশেই ছিল তাদের দুই সন্তান।

নুরনবী বললেন, ‘আল্লাহ প্রাণ ফিরাই দিসে, এডাই বহুত। অনেকে তো ঘুমেই কইলা (কয়লা) হই যায়।’ তবে মন ভেঙে গেছে রোকেয়া বেগমের— টিভি, ফ্রিজসহ তার দেড় থেকে দুই লাখ টাকার মালামাল ছাই হয়ে গেছে।

২০ বছর বয়সী রনি হোসেন নিভু নিভু আগুনের দিকে তাকিয়ে কাঁদছেন। তার মুখে কোন শব্দ নেই। জানতে চাইলে অনেক কষ্টে জানালেন, সব শেষ আমাদের। তিন বাসার ছয়টা কক্ষে তাদের পরিবারের ১০ জন সদস্য ছিলেন। সবাই অক্ষত থাকলেও সকাল ১০টার আগের সাজানো গোছানো ঘরগুলো এখন ছাই ছাপা। রনির কাঁধে হাত দিয়ে পঞ্চাশোর্ধ এক নারী এসে শান্তনা দিলেন, ‘মরদ পোয়া এইল্যা গরি ন কাঁন (কাঁদো)। হামাই গইত্যি পারিবি। আল্লাহয় দিবো।’

রিক্সাচালক মোহাম্মদ হানিফ বললেন, ‘বস্তির ৩ নম্বর গলির শেষ দিকে থেকে আগুন ধেয়ে আসছে। আমরা তখন দোকানে আড্ডা দিচ্ছিলাম। ওই লাইনের ঘরগুলোতে কাঠের চুলোয় রান্না হয়। চোখের পলকে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের কেউ কেউ পানি নিয়ে দৌঁড়াচ্ছিলাম, কেউ কাদামাটি, বালি নিয়ে। কিন্তু আগুনের কাছে আমরা অসহায় ছিলাম। অল্প সময়ের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এসে পৌঁছেছে। গাড়ি যদি স্পটে ঢুকতে পারতো ক্ষয়ক্ষতি ৩০ ভাগও হতো না।’

শুলকবহরের আগুনে সব হারাল পরিবারগুলো 1

সরেজমিনে দেখা যায়, পাঁচলাইশ থানা মোড় থেকে মির্জারপুল পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি গাড়ি দাঁড়ানো। ডেকোরেশন গলিতে ঢুকে দেখা যায় রাস্তার ওপরই একটি দোকান। দোকানের আগে আটকেপড়া আরও একটি পানিভর্তি গাড়ি। গাড়ির পাশে একটা গলিতে মাদুর বিছিয়ে রেডক্রিসেন্ট কর্মীরা হাত-পা কাটা নারী পুরুষের প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছেন। উপস্থিত রেডক্রিসেন্ট কর্মী মো. ফয়সাল জানালেন দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত তারা ৩৬ জন নারী পুরুষকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছেন।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সে চট্টগ্রামের উপ-সহকারী পরিচালক ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, ‘সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে আমরা ফোন পাই কাতালগঞ্জ ডেকোরেশন গলিতে আগুন লেগেছে। তখন থেকে আমরা তিনটা ইউনিটের গাড়ি আসা শুরু করি। আমরা এসে প্রথম বাঁধা পাই সড়কটা সরু। আবার সড়কেই বিদ্যুতের খুঁটি। শেষ মাথাগিয়ে পাই সড়কের উপর দোকান! স্পট পর্যন্ত আমাদের গাড়ি যেতে পারেনি। আমাদের গাড়িতে থাকা পানি, একটা বাড়ির রিজার্ভ ট্যাংকিতে থাকা পানি শেষ হতে হতে একটি ডোবার সন্ধান আমরা পাই। সেই ডোবা থেকে পানি টেনেছি। ১১ টা ২৫ মিনিটে আগুন আমাদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে আমাদের টিম কাজ করছে। তদন্ত কমিটিও হতে পারে।’

আগুন নিয়ন্ত্রণের পর দুপুর সাড়ে ১২টায় স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোরশেদুল ইসলাম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. কামাল হোসেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে ক্ষতিগ্রস্থদের সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন।

নগর পুলিশের পাঁচলাইশ জোনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার দেবদূত মজুমদার, পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল কাশেম ভূঁইয়ার নেতৃত্বে আইনশৃংখলা বাহিনী নিরাপত্তা বলয় তৈরি করেছেন।

দেবদূত মজুমদার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, ক্ষতিগ্রস্থদের কেউ কেউ তাদের কিছু মালামাল খোলা আকাশের নিচে সরাতে সক্ষম হয়েছে। অন্তত ওগুলো যাতে নিরাপদ থাকে আমরা সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!