২০০ কোটি টাকা নিয়ে হাওয়া চট্টগ্রামের ‘হায় হায়’ সমিতি, গার্মেন্টসকর্মীরাই মূল গ্রাহক

দ্বিগুণ লাভের ফাঁদে পড়ে বড় সর্বনাশ

চট্টগ্রাম নগরের ইপিজেড এলাকায় রূপসা কো-অপারেটিভ মাল্টিপারপাসের পর এবার গ্রাহকের টাকা মেরে পালিয়েছে ‘প্রাইম স্টার সঞ্চয় ও ঋণদান কো-অপারেটিভ সোসাইটি’ নামের আরেক সমবায় সমিতি।

গ্রাহকের প্রায় ২০৯ কোটি টাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানসহ কর্মকর্তারা দেড়মাস ধরে লাপাত্তা হলেও সমবায় অফিসসহ সংশ্লিষ্টদের কোনো উদ্যোগ নেই। জামানত ফেরত পেতে প্রতি শুক্রবার প্রতিষ্ঠানটির অফিসের সামনে ভিড় করছেন প্রায় আড়াই হাজার গ্রাহক।

২০০ কোটি টাকা নিয়ে হাওয়া চট্টগ্রামের ‘হায় হায়’ সমিতি, গার্মেন্টসকর্মীরাই মূল গ্রাহক 1

তবে জেলা সমবায় কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠানটির হিসেব বুঝে নিতে ইতোমধ্যে অবসায়ক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির স্থাবর সম্পত্তি ও ব্যাংকের টাকা ট্রান্সফার বন্ধে ভূমি অফিস ও ব্যাংকগুলোতে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, দুই বছর আগে (২০২০ সালে) দেড় লাখ গার্মেন্টস শ্রমিকের চার হাজার কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে যায় রূপসা কো-অপারেটিভ মাল্টিপারপাস। এরপর থেকে প্রাইম স্টার কো-অপারেটিভ সোসাইটি (রেজি-১২১২০/১৪) গ্রাহকদের টাকা নিয়ে নয়ছয় শুরু করে। মেয়াদ পূর্ণ হলেও গ্রাহককে তাদের জামানত ফেরত দিতে গড়িমাসি করতে থাকে। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মাকসুদুর রহমান গত আড়াই মাস ধরে গ্রাহকের টাকা মেরে দুবাই গিয়ে বসে আছেন। গত ২২ জুলাই অফিসে তালা ঝুলিয়ে অন্যান্য কর্মকর্তারাও হঠাৎ লাপাত্তা হয়ে যান।

২০০১ সালে নগরীর ইপিজেডে কার্যক্রম শুরু করে প্রাইম স্টার কো-অপারেটিভ সোসাইটি নামের প্রতিষ্ঠানটি। সেখানকার চৌধুরী মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় তাদের হেড অফিস এবং ইপিজেড নিউমুরিং সড়কের ভেতরে আরেকটি অফিস করে তারা। এরপর আশপাশের বিভিন্ন গার্মেন্টস শ্রমিকদের দ্বিগুণ লাভের আশ্বাস দিয়ে অর্থ হাতানো শুরু করে। লোভ দেখিয়ে ওই এলাকার দেড় হাজারের মতো গ্রাহকের কাছ থেকে প্রায় শতকোটি টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতিষ্ঠানটি।

এছাড়া প্রায় এক যুগ আগে চান্দগাঁওয়ের কাপ্তাই রাস্তার মাথার কাজীর বাজার এলাকায়ও অপর একটি শাখা অফিস গড়ে তোলে তারা। সেখানকার হাজারের অধিক গ্রাহক থেকেও শতকোটি টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। ইপিজেড ও কাপ্তাই—দুই ইকোনোমিক জোন থেকে আড়াই হাজারের অধিক গ্রাহক থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা নিয়ে গত ২২ জুলাই থেকে সমিতির কার্যালয় বন্ধ করে লাপাত্তা প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মাকসুদসহ তার সহযোগীরা।

গত দেড়মাস ধরে ভুক্তভোগীরা সমিতির চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাদের কোনো খোঁজখবর পাচ্ছেন না গ্রাহকরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সমিতির চেয়ারম্যান মাকসুদুর রহমান বাঁশখালী উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি বেশ কিছুদিন ধরেই দুবাইয়ে অবস্থান করছেন।

স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানসহ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আদালতে ১৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলা তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে রিপোর্ট দিয়েছে ইপিজেড থানা পুলিশ। এসব মামলায় তাদের বিরুদ্ধে এখন আদালতের পরোয়ানা রয়েছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ইপিজেড থানায়ও একটি মামলা রয়েছে। এ মামলার তদন্ত করছে পুলিশ।

ভুক্তভোগী শাহিনা আক্তার জানান, তিনি একজন গার্মেন্টসকর্মী। মেয়ের বিয়ের জন্য মাসে দুই হাজার করে ১০ বছরে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা প্রাইম স্টার কো-অপারেটিভ সোসাইটিতে জমা রেখেছিলেন। ১০ বছর পর লভ্যাংশসহ মূল টাকা বুঝিয়ে দেওয়ার চুক্তি থাকলেও মেয়াদপূর্ণ হওয়ার ৫ মাসেও এখনো তার পাওনা বুঝে পাননি তিনি। পরের মাসে টাকা দেওয়ার কথা বলে তিন মাস ধরে সময় নেওয়ার পর গত দুই মাস আগে অফিসটি বন্ধ করে দেয় প্রতিষ্ঠান কর্মকর্তারা।

সুমন নামের অপর গার্মেন্টসকর্মী জানান, স্ত্রী রোজিনা বেগমসহ দু’জনই গার্মেন্টসে চাকরি করেন। বেতনের কিছু অংশ জমিয়ে দশ বছর মেয়াদে লভ্যাংশসহ দ্বিগুণ পাওয়ার আশায় নিজের নামে ১ লাখ ও স্ত্রী রোজিনার নামে ১ লাখ এফডিআর করেন তারা। মেয়াদ শেষে ৪ লাখ টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও এখন মূল টাকাটা পাওয়া নিয়ে চিন্তা তাদের।

এ বিষয়ে প্রাইম স্টার কো-অপারেটিভ সোসাইটির চেয়ারম্যান ও বাঁশখালী উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাকসুদুর রহমানের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার মোবাইল নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে ওই নম্বরে হোয়াটসঅ্যাপে ফোন ও এসএমএস দেওয়া হলেও তিনি সাড়া দেননি।

চট্টগ্রাম জেলা সমবায় অফিসের পরিদর্শক (দায়িত্বপ্রাপ্ত অবসায়ক) সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘প্রাইম স্টার কো-অপারেটিভ সোসাইটি কর্তৃপক্ষকে সকল হিসেবে বুঝিয়ে দিতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারা এ বিষয়ে কোনো সাড়া দেয়নি। পরে তাদের স্থাবর সম্পত্তি যেন বিক্রি করতে না পারে এজন্য প্রতিটি ভূমি অফিসে আমরা চিঠি দিয়েছি। তাদের ব্যাংকগুলোতেও লেনদেন যেন না করতে পারে সেখানেও চিঠি দেওয়া হয়েছে।’

চট্টগ্রাম জেলা সমবায় অফিসার মুরাদ আহম্মেদ বলেন, ‘গ্রাহকদের জামানত কিভাবে ফিরিয়ে দেওয়া যায়, সে চেষ্টা আমরা করছি। ইতোমধ্যে অফিসের পক্ষ থেকে অবসায়ক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাদের সম্পত্তি এবং ব্যাংকের টাকা স্থানন্তর ঠেকাতে স্থানীয় ভূমি অফিস ও ব্যাংকের চিঠি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া তাদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগের চেষ্টা করছি।’

এনইউএস/ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!