হালদায় ওয়াসার কোপ, বিশেষজ্ঞদের আপত্তি উপেক্ষা করে পানি শোধনাগার

মাত্র কয়েকদিন আগেই ‘বঙ্গবন্ধু জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ ঐতিহ্য’ ঘোষণা করা হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীকে। সেটি যদি হয়ে থাকে মুদ্রার এক পিঠ তাহলে মুদ্রার অন্যপিঠ হচ্ছে হালদায় মিরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরে পানি সরবরাহের জন্য চট্টগ্রাম ওয়াসা চালু করতে যাচ্ছে মোহরা পানি শোধনাগার ফেস-২ নামে একটি প্রকল্প। এর জন্য দৈনিক ১৪ কোটি লিটার পানি উত্তোলন করা হবে হালদা নদী থেকে।

এতে নদীটির জীববৈচিত্র্যের উপর বড় ধরণের প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন গবেষকরা। ওয়াসার এ প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব যাচাই করে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম)। আইডব্লিউএম প্রকল্পকে ঘিরে হালদা নদীর পরিবেশগত প্রভাব যাচাইয়ের পর ১৮৪ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। প্রতিবেদন অনুযায়ী হালদায় পরিবেশগত কোনো সমস্যা না থাকায় ছাড়পত্রের জন্য চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদফতর কার্যালয়ে প্রতিবেদনটি পাঠায় ওয়াসা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর ড. মনজুরুল কিবরিয়া প্রতিবেদনটির বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, হালদা ছাড়া অন্য যে কোন নদী থেকে ওয়াসা পানি নিতে পারে। কিন্তু হালদা থেকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলন করলে হালদার জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে।

প্রতিবেদনটির উপর ২০২০ সালের নভেম্বরে পরিবেশ অধিদফতরের একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন হালদা নিয়ে কাজ করা একাধিক গবেষক। তবে প্রতিবেদনটি উপস্থাপনের পর এ বিষয়ে গবেষকদের মধ্যে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।

গবেষকদের দাবি আইডব্লিউএম এর তৈরি করা এ প্রতিবেদন আগের প্রতিবেদনের কপি। নতুন করে নদীতে কোনো সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়নি। এমনকি প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে কোনো বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। তাই তড়িঘড়ি করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে মনগড়া প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করেন।

ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, হালদা নদী থেকে চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রস্তাবিত প্রকল্পসহ প্রতিদিন ৫৬.১ কোটি লিটার পানি উত্তোলনের পরও প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে ২.০৫ শতাংশ পানি উত্তোলন করা হবে। অথচ ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক চট্টগ্রামের একটি দৈনিকে ২০২০ সালের ১৮ অক্টোবরের সাক্ষাৎকারে ৩.৫ শতাংশ পানি উত্তোলনের কথা বলেন।

এমনকি আইডব্লিউএম এর প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী হালদার মোহরা অংশে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে পানি দেখানো হয়েছে ১৬০০-২১৫০ এমএলডি (মিলিয়ন অব লিটার পার ডে)। যার গড় পরিমাণ ১৮৭৫ এমএলডি। একই সময়ে নদী থেকে পানি উত্তোলন করা হবে ৫৬১ এমএলডি। সেই হিসেবে নদী থেকে পানি উত্তোলনের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৯.৯২ শতাংশ। অর্থাৎ নদীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পানি উত্তোলন করা হবে।

এর আগে হালদা দূষণের দায়ে পরিবেশ অধিদফতর ও হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসনের যৌথ অভিযানে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ১০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট ও এশিয়ান পেপার মিল।

আইডব্লিউএমর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হালদা থেকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলন করা হলেও মাছের স্বাভাবিক প্রজননে সমস্যা হবে না। এর প্রেক্ষিতে ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা কিংবা তথ্য-উপাত্ত ছাড়া এমন বক্তব্য দেয়া হয়েছে। যেখানে উল্লেখ করা হয়নি কী পরিমাণ পানি থাকলে হালদা প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননের উপযুক্ত থাকবে। এছাড়া ডলফিনের জন্য কী পরিমাণ পানি প্রয়োজন তার কিছুই প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই।

গত বছরের ২৪ নভেম্বর নদী রক্ষা কমিশনের আরেকটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনার পরবর্তী জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, সেমিনারে অংশ নেওয়া অধিকাংশের মতে হালদার স্বাভাবিক পরিবেশ বিনষ্ট করে নতুন কোনো প্রকল্প স্থাপন করা ঠিক হবে না। তারা হালদার প্রকল্পটি নিয়ে আরও যাচাই-বাছাইয়ের আহ্বান জানান। একই সঙ্গে বিকল্প উৎস থেকে পানি উত্তোলন করা যায় কী না দেখতে বলা হয়েছে।

ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, আমরা ওয়াসাকে মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরে পানি সরবরাহের বিকল্প উৎসের কথা বলেছি। তারা চাইলে কর্ণফুলী নদী, ফেনী নদী, ডাকাতিয়া নদী, মিরসরাই লেক, কাপ্তাই লেক কিংবা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে পানি সরবরাহ করতে পারে। অথবা সমুদ্রের পানিকে লবণমুক্ত করে ব্যবহার করতে পারে। শুধু পানি উত্তোলনের জন্য জাতীয় সম্পদ হালদা ধ্বংস হতে দেয়া যায় না।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইন্সটিটিউটের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন একটি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, বৃক্ষনিধনের কারণে উপর থেকে পানি আসা কমে গেছে। ফলে হালদাতে কর্ণফুলী থেকে অনেক পানি প্রবেশ করছে। আইডব্লিউএম-এর গবেষণাতেও দেখানো হয়েছে যে পানি কম আসছে। এই নদী থেকে ইতোমধ্যেই দুইটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট দিয়ে পানি উঠাচ্ছি আমরা। এখন ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে, হালদাকে টিকিয়ে রাখার জন্য নতুন করে পানি না তোলা উচিত।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জানান, চট্টগ্রাম ওয়াসা হালদার যে পয়েন্ট থেকে পানি উঠায় সেখানে কর্ণফুলীর প্রভাব অনেক বেশি। প্রতিদিন জোয়ার ভাটার সাথে পানি আসে-পানি চলে যায়। নদীর এ অংশ নিম্নাঞ্চল। অর্থাৎ হালদা-কর্ণফুলীর মিলনস্থলের এক কিলোমিটারের মধ্যেই পানি উঠাচ্ছি।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!