‘সিংহের সাহস’ নিয়ে চট্টগ্রামে ১০৭ কারখানা চলছেই

কর্মরত শ্রমিক ও তাদের পরিবারে করোনার আতঙ্ক

‘এতো ঝুঁকির মধ্যে মালিকরা সিংহের সাহস নিয়ে চালু রেখেছে কারখানা’— বলছিলেন শিল্প পুলিশ চট্টগ্রাম অঞ্চলের পুলিশ সুপার উত্তম কুমার পাল। তার কথাই সত্য। করোনাভাইরাসের সর্বোচ্চ ঝুঁকির মধ্যে থাকা চট্টগ্রামে চালু রয়েছে ১০৭টি কারখানা। সংক্রমণ ঝুঁকি নিয়ে চট্টগ্রামে উৎপাদন চালু করা এসব কারখানায় কাজ করছেন অর্ধলক্ষাধিক শ্রমিক। কারখানাগুলোর পক্ষ থেকে কর্মরতদের ঝুঁকিমুক্ত রাখতে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হলেও শিল্প পুলিশ বলছে, মুখে মাস্ক এবং সাবান দিয়ে হাত ধোয়া ছাড়া অধিকাংশ কারখানায় অন্য কোনো ব্যবস্থা নেই।

দেশজুড়ে ঘোষিত সাধারণ ছুটির মধ্যেও কারখানাগুলো খোলা থাকায় কর্মরত শ্রমিক ও তাদের পরিবারে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।

শিল্প পুলিশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রাম জেলায় সচল শিল্প কারখানা আছে ১ হাজার ২২৯টি। এর মধ্যে সাধারণ ছুটিতে কারখানা চালু আছে ১০৭টি। বুধবার (১৫ এপ্রিল) এসব কারখানা পুরোদমে চালু ছিল। কারখানার মধ্যে ২০টি তৈরি পোশাক কারখানা এবং বাকি গুলো রড-সিমেন্টসহ বিভিন্ন খাতের।

সূত্রমতে, চট্টগ্রাম ইপিজেডে মোট কারখানা আছে ১৫৮টি। বুধবার খোলা ছিল ১০টি তৈরি পোশাক কারখানা। বুধবার সকালে চট্টগ্রাম ইপিজেডের মূল ফটক দিয়ে প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক প্রবেশ করেছেন। প্রবেশের সময় তাদের জীবাণুনাশক স্প্রে করা কিংবা সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে দেখেননি স্থানীয়রা। তারা অধিকাংশই বেতন ভাতা উত্তোলনের জন্য গিয়েছিল। ইপিজেডে দুটি কারখানা পুরোদমে চলছে। ওই দুটি কারখানায় বানানো হচ্ছে পিপিই।

তবে চট্টগ্রাম ইপিজেডের মহাব্যবস্থাপক খুরশিদ আলম জানিয়েছেন, শুধুমাত্র শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের জন্য কারখানাগুলো খোলা রাখা হয়েছিল। এর বাইরে দুটিতে পিপিই বানানো হচ্ছে। তবে কোনো গার্মেন্টসের শিপমেন্ট থাকলে বা শেষ পর্যায়ের কাজ থাকলে অনুমতি সাপেক্ষে কারখানা খোলা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম ইপিজেডের অদূরে কর্ণফুলী ইপিজেডে কিছু কারখানা বুধবার চালু ছিল। সেখানে প্রায় ৬ হাজার শ্রমিক সকালে প্রবেশ করেছেন। কর্ণফুলী ইপিজেডের কারখানাগুলোর অধিকাংশই তৈরি পোশাক কারখানা। এছাড়া নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি শিল্প এলাকায় চালু আছে ৪৮টি কারখানা।

কর্ণফুলী ইপিজেডের ব্যবস্থাপক মসিউদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, কর্ণফুলী ইপিজেডে ৫০ গার্মেন্টস কারখানা রয়েছে। এখন সব কারখানা বন্ধ রয়েছে। বেতন ভাতা দেওয়ার জন্য সেখানে ৬ হাজার শ্রমিক যোগ দিয়েছেন। এখানে একটি কারখানায় পিপিই বানানো হচ্ছে। এছাড়া আগামী ২২ এপ্রিল পর্যন্ত শ্রমিকরা বেতন গ্রহণ করবেন। তাই কারখানাও খোলা হবে।

শিল্প পুলিশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পুলিশ সুপার উত্তম কুমার পাল বলেন, ‘সিইপিজেডসহ জেলায় ১০৭ টি কারখানা চালু আছে। এতো ঝুঁকির মধ্যে মালিকরা সিংহের সাহস নিয়ে চালু রেখেছে কারখানা।

তিনি বলেন, ‘বেশকিছু এলাকায় কিছু গার্মেন্টস খোলা আছে। বেশিরভাগ বন্ধ। গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে একসঙ্গে অনেক শ্রমিক ঢোকেন এবং বের হন। সিইপিজেডে আজ (বুধবার) একসঙ্গে হুড়োহুড়ি না করে লাইন ধরে দূরত্ব মেনে ঢোকানোর চেষ্টা হয়েছে।’

চট্টগ্রামে বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলসের (বিএসআরএম) পাঁচটি কারখানায় কাজ করছেন অন্তত চার হাজার শ্রমিক। এখন সবগুলো কারখানা বন্ধ রয়েছে উল্লেখ করে বিএসআরএম’র উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, ‘সরকার যেভাবে সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে বলেছে, আমরা সেভাবেই করেছি। মাস্ক দিয়েছি, হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করেছি, সামাজিক দূরত্ব মেইনটেইন করা হচ্ছে। শ্রমিকদের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর আমাদের কারখানায় অটোমেটিক মিলে উৎপাদন হয়, কাউকে হাত লাগাতে হয় না। সুতরাং ঝুঁকির কোনো বিষয় নেই।’ এরপরও আমরা আর কারখানা খোলা রাখছি না কারণ সব দোকান তো বন্ধ। মাল তো সেল হচ্ছে না।’

এদিকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলায় জিপিএইচ ইস্পাতের কারখানাও চলছে পুরোদমে। সাধারণ ছুটির শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠানটি তাদের কারখানা একদিনের জন্যও বন্ধ রাখেনি। এতে ওই কারখানায় কর্মরত শ্রমিক-কর্মী থেকে এমনকি কর্মকর্তা পর্যায়েও করোনার আতঙ্ক রয়েছে। বিশেষ করে সীতাকুণ্ড অঞ্চলে করোনাভাইরাসের রোগী পাওয়া যাওয়ার পর থেকে কারখানার কর্মপরিবেশ আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে ক্রমশ। করোনার ঝুঁকি ঠেকাতে সরকারের নির্দেশনা না মেনে কারখানা খোলা রাখার ঘটনায় বিভিন্ন মহলে বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে।

জিপিএইচ ইস্পাতে কর্মরত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। লকডাউন চলছে। অথচ আমাদের অফিস খোলা রাখা হয়েছে। আমাদের পরিবার আতঙ্কিত অবস্থায় আছে। শ্রমিকরাও নিয়মিত এসে তাদের আতঙ্কের কথা আমাদের জানাচ্ছেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের কারণে ঝুঁকি নিয়েও আমাদের কাজ করতে হচ্ছে।’

একই এলাকায় একেএস স্টিলসহ খ্যাতনামা শিল্পগ্রুপগুলোরও অধিকাংশই তাদের কারখানা চালু রেখেছে বলে জানা গেছে।

প্রসঙ্গত চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন শুরুতেই জানিয়েছিলেন, সমুদ্রবন্দর এবং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থাকায় চট্টগ্রাম করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে আছে। ইতিমধ্যে চট্টগ্রামে করোনা পজিটিভ রোগীর সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ জনে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!