সাকিবের ব্যাটে অবশেষে আফগানিস্তানকে হারালো বাংলাদেশ
ক্রিকেট বলেন আর ফুটবল বলেন বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের সাক্ষাত যমে পরিণত হওয়া আফগানিস্তানকে বধ করলেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। শনিবারের চট্টগ্রামের ম্যাচের আগে কিছুতেই হারানো যাচ্ছিল না তাদেরকে। সেই বিশ্বকাপে তাদেরকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। তার আগে পরে আফগানিস্তান মানেই বাংলাদেশের জন্য দুঃখগাথা। বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাইয়ে তাজিকিস্তানের মাটিতেও আফগানিস্তানের কাছে হেরে বসে বাংলাদেশ। ভারতের মাটিতে আফগানিস্তানের কাছে হোয়াইট ওয়াশ হওয়ার লজ্জাকর রেকর্ডের শিকারও হতে হয়েছিল বাংলাদেশ। এরপর অনূর্ধ্ব-১৯, ‘এ’ দল কিংবা জাতীয় দল সবজায়গাতেই বাংলাদেশের সামনে অপরাজেয় হয়ে রয় আফগানিস্তান। ত্রিদেশীয় সিরিজের ঢাকার মোকাবেলায় বাংলাদেশকে সববিভাগে নাকানি-চুবানি দিয়ে জয় তুলে নিয়েছিল আফগানিস্তান। তাই শনিবারের চট্টগ্রাম পর্বের শেষ ম্যাচটি বাংলাদেশের জন্য ছিল মর্যাদা ফিরে পাওয়ার লড়াই। আর তাতে দারুণভাবে মর্যাদা ফিরে পেলেন সাকিব ও তার দল।
বিশ্বকাপের পর থেকে সাকিবের ব্যাটে রানখরা। অবশ্য সাকিব বিশ্বকাপের পরপর অনুষ্ঠিত শ্রীলঙ্কা সফরে নিজেকে বিশ্রামে রেখেছিলেন। এরপর ত্রিদেশীয় সিরিজ দিয়ে আবারও তার ম্যাচে ফেরা। সাকিব ফিরলেও দেখা যায়নি সাকিবের সেই ব্যাটিং দ্যুতি। খুব বাজেভাবে আউট হয়ে যান বাংলাদেশের প্রথম তিন ম্যাচে। চতুর্থম্যাচে এসে উদ্ধার করলেন নিজের স্বল্প সময়ের জন্য হারানো ব্যাটিং ও বাংলাদেশের সম্মান। ১৩৯ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশ ৬ বল হাতে রেখেই জয় তুলে নিয়েছে। টাইগারদের জয় ৪ উইকেটের ব্যবধানে। টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের নবম ফিফটি তুলে নেন সাকিব। বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডারের ব্যাটে অবশেষে ঘরের মাঠে আফগানদের আরেকবার হারালো বাংলাদেশ।
টি-টোয়েন্টিতে মুখোমুখি দুই দলের ৬ দেখায় বাংলাদেশ জিতলো দুটিতে। আফগানদের বিপক্ষে টানা চার ম্যাচ হারের পর জিতলো লাল-সবুজের জার্সিধারীরা। ৫ বছর পর আফগানদের এই ফরম্যাটে হারালো বাংলাদেশ।১৩৯ রানের টার্গেটে ব্যাটিংয়ে নেমে দলীয় ৯ রানের মাথায় বিদায় নেন ওপেনার লিটন দাস। মুজিব উর রহমানের বলে আসগর আফগানের তালুবন্দি হওয়ার আগে লিটন করেন ৪ রান। দলীয় ১২ রানের মাথায় বিদায় নেন আরেক ওপেনার নাজমুল হোসেন শান্ত। অভিষিক্ত নাভিন উল হকের বলে রশিদ খানের হাতে ধরা পড়ার আগে শান্ত ব্যাট থেকে আসে ৫ রান। ইনিংসের প্রথম বাউন্ডারি আসে ষষ্ঠ ওভারে সাকিবের ব্যাট থেকে। মোহাম্মদ নবীর বলে ব্যক্তিগত ১৪ রানে ক্যাচ তুলে দেন মুশফিক। সহজ ক্যাচ মিস হলে জীবন পান মুশফিক। জীবন পেলেও বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি, দলীয় ৭০ রানের মাথায় করিম জানাতের বলে ক্যাচ তুলে নিজের বিদায় ঘণ্টা বাজান মুশফিক। বিদায়ের আগে ২৫ বলে এক ছক্কায় করেন ২৬ রান। সাকিবের সঙ্গে জুটিতে আসে ৫৮ রান।
দলীয় ১৩তম ওভারে সাকিবের বিরুদ্ধে এলবির আবেদন আম্পায়ার নাকচ করে দেন। রিভিউ নিয়েও লাভ হয়নি আফগানদের। এরপর বেশ কিছুক্ষণ ফ্লাডলাইটের আলোক স্বল্পতায় ম্যাচটি বন্ধ থাকে। ১৩ ওভার শেষে বোলিংয়ে প্রথমবার আসেন রশিদ খান। নিজের প্রথম ওভারেই এলবির ফাঁদে ফেলেন ৬ রান করা মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে। দলীয় ৯৩ রানের মাথায় চতুর্থ উইকেট হারায় বাংলাদেশ। এক ম্যাচ পড়ে সুযোগ পেয়ে আবারও ব্যর্থ সাব্বির রহমান। ব্যক্তিগত ১ রানে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরের পথ ধরেন তিনি। সাকিবকে সঙ্গ দিতে পারেননি আফিফ হোসেন ধ্রুব। রশিদ খানের দ্বিতীয় শিকারে বোল্ড হয়ে বিদায় নেওয়ার আগে করেন ২ রান। দলীয় ১০৪ রানের মাথায় বাংলাদেশ ষষ্ঠ উইকেট হারায়।
এরপর সাকিব-মোসাদ্দেক মিলে দলকে জয়ের বন্দরে নিয়ে যান। এই জুটিতে আসে অবিচ্ছিন্ন ৩৫ রান। ৪৫ বলে আটটি চার আর একটি ছক্কায় সাকিব করেন অপরাজিত ৭০ রান। ১২ বলে ১৯ রান করে অপরাজিত থাকেন মোসাদ্দেক।মুজিব উর রহমান ৪ ওভারে ১৯ রান দিয়ে নেন একটি উইকেট। নাভিন উল হক ৪ ওভারে ২০ রান দিয়ে পান দুটি উইকেট। করিম জানাত ৩ ওভারে ৩১ রান খরচায় নেন একটি উইকেট। গুলবাদিন নাইব ২ ওভারে ১৬ এবং মোহাম্মদ নবী ৩ ওভারে ২৪ রান দিয়ে কোনো উইকেট পাননি। রশিদ খান ৩ ওভারে ২৭ রান দিয়ে পান দুটি উইকেট।
এর আগে টসে জিতে বোলিং করতে এসে ইনিংসের প্রথম বলেই আফগানিস্তানকে নো বল দিয়ে স্বাগত জানান বাংলাদেশের পেস বোলিং অলরাউন্ডার সাইফউদ্দিন। যদিও ফ্রি হিট থেকে একরানের বেশি নিতে পারেননি আফগানিস্তানের রাহমানুল্লাহ গুরবাজ। প্রথম ওভারটি রয়েসয়ে খেলে পার করে দেন আফগানিস্তানের দুই ওপেনার। নিজের প্রথম ওভারে শফিউলকে উইকেট বঞ্চিত করেছেন মাহমুদুল্লাহ। ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারের পঞ্চম বল, ব্যাটসম্যানকে পরাস্ত করতে শর্ট বল করেছিলেন শফিউল। যাতে করে ব্যাটসম্যান খেলতে গেলে মিস টাইমিংয়ের শিকার হয়। হয়েছিলও তাই। গুরবাজের মিস টাইমিং হয়ে বল আকাশে, শর্ট থার্ডম্যানে দাঁড়ানো মাহমুদুল্লাহ তালুবন্দি করতে পারেননি সহজ বলটি। তখন আফগানিস্তানের দলীয় সংগ্রহ ৮ রান। ইনিংসের প্রথম তিন ওভার অধিনায়কের আস্থার প্রতিদান দিয়ে বল করেন সাইফউদ্দিন ও শফিউল। কিন্তু চতুর্থ ওভারে এসে হাত খুলে খেলতে শুরু করে আফগানিস্তান। শফিউলের করা ইনিংসের চতুর্থ ওভারে ৩ বাউন্ডারিসহ ১৩ রান তুলে নেয় তারা।
এরপর তারা তরতর করে এগিয়ে যায়। পাওয়ার প্লে’র প্রথম ছয় ওভারে কোন উইকেট না হারিয়ে ৪২ রান সংগ্রহ করে আফগানিস্তান। বাংলাদেশকে প্রথম উইকেটের জন্য অপেক্ষা করতে হয় ৯.৩ ওভার পর্যন্ত। ততক্ষণে আফগানদের রান গিয়ে দাঁড়ায় ৭৫ রানে। প্রথম উইকেট দেখার পর জেগে উঠে বাংলাদেশের বোলাররা। দলীয় ৭৫ রানের মাথায় বিদায় নেন হজরতউল্লাহ জাজাই। ত্রিদেশীয় সিরিজে প্রথমবারের মতো সাকিব বোলিং আক্রমণে আনেন আফিফ হোসেনকে। নিজের প্রথম ওভারেই জাজাইকে বিদায় করেন তিনি। আউট হওয়ার আগে জাজাই ৩৫ বলে ছয়টি চার আর দুটি ছক্কায় করেন ৪৭ রান। একই ওভারে আফিফ ফেরান আসগর আফগানকে। নিজের প্রথম ওভারে কোনো রান না দিয়েই আফিফ নেন জোড়া উইকেট। ইনিংসের দশম ওভারে আফিফ জোড়া আঘাত হানার পরের ওভারে আঘাত হানেন মোস্তাফিজ। তার কাটার বুঝতে না পেরে লিডিং এজে ফেরেন রহমানুল্লাহ গুরবাজ। তার আগে ২৭ বলে দুই চার, দুই ছক্কায় করেন ২৯ রান। ৬ বলে ৪ রান করা মোহাম্মদ নবীকে বিদায় করেন সাকিব।
দলীয় ৮৮ রানের মাথায় আফগানরা চতুর্থ উইকেট হারায়। দলীয় ৯৬ রানের মাথায় রানআউট হন ১ রান করা গুলবাদিন নাইব।ইনিংসের ১৬তম ওভারে আক্রমণে এসে সাইফউদ্দিন দুর্দান্ত এক ইয়র্কারে বোল্ড করেন ১৬ বলে এক ছক্কায় ১৪ রান করা নাজিবুল্লাহ জাদরানকে। দলীয় ১১৪ রানের মাথায় শফিউল ইসলামকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে মোস্তাফিজের হাতে ধরা পড়েন ৪ বলে ৩ রান করা করিম জানাত। শফিকুল্লাহ ১৭ বলে ২৩ এবং রশিদ খান ১৩ বলে ১১ রানে অপরাজিত থাকেন। শেষ পর্যন্ত আফগানদের দৌঁড় থামে ১৩৮ রানে।
সাকিব ৪ ওভারে ২৪ রান দিয়ে তুলে নেন একটি উইকেট। মাহমুদউল্লাহ ১ ওভারে ১৬ আর মোসাদ্দেক ১০ রান দিয়ে কোনো উইকেট পাননি। আফিফের বোলিং ফিগার ৩-১-৯-২। মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন ৪ ওভারে ২৩ রান খরচায় তুলে নেন একটি উইকেট। শফিউল ইসলাম ৪ ওভারে ২৪ রান দিয়ে নেন একটি উইকেট। মোস্তাফিজ ৩ ওভারে ৩১ রানের বিনিময়ে তুলে নেন একটি উইকেট।
এখন দেখার বিষয় আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর মিরপুরে ফাইনালে রশিদ খানের আফগানিস্তানের বিপক্ষে চট্টগ্রামের সুখস্মৃতি ধরে রাখতে পারে কিনা? পারলেই কিন্তু চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ।