র‌্যাব বলছে ‘বন্দুকযুদ্ধ’, পরিবারের দাবি ‘চুক্তির খুন’ (ভিডিও জবানবন্দি)

সাদা পোশাকের লোক ধরে নিয়ে যায় দুদিন আগে

চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে র‌্যাবের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মোরশেদ (৩৫) নামে একজনের নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) পক্ষ থেকে মোরশেদ ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন বলে জানানো হলেও মোরশেদের পরিবারের সদস্যরা বলছে ওয়াকফ স্টেটের একটি মসজিদের পরিচালনা ও পারিবারিক বিরোধের জের ধরে টাকার বিনিময়ে হত্যা করানো হয়েছে মোরশেদকে।

মোরশেদের পরিবারের সদস্যরা জানান, ঘটনার একদিন আগে (২৫ জানুয়ারি) ভোরে মোরশেদকে ধরে নিয়ে যায় সাদা পোশাকধারী একদল লোক। পরে এই ঘটনায় বাঁশখালী থানায় জিডি করতে গেলেও জিডি নেয়নি থানা কর্তৃপক্ষ। এরপর র‌্যাবের সাথে যোগাযোগ করা হলেও মোরশেদকে আটকের কথা স্বীকার করেনি র‌্যাব। এর একদিন পর ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মোরশেদের নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। বাঁশখালী থানার সাথে কথা বলে পরিবারের এই দাবির সত্যতা পাওয়া গেছে।

এদিকে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনার পর র‌্যাব ৭ এর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রোববার (২৬ জানুয়ারি) ভোরে বাঁশখালীর বাণীগ্রাম লটমণি পাহাড় এলাকায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে মোরশেদ। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে চারটি অস্ত্র, তিনটি রাম দা ও ১৯ রাউন্ড গুলি জব্দ করা হয়। নিহত মোরশেদ আলমের বিরুদ্ধে বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়া এলাকায় ৩১ জেলেকে পানিতে ফেলে হত্যা মামলাসহ দুই ডজনের অধিক মামলা রয়েছে বলে জানান র‌্যাব ৭ এর সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) মাহমুদুল হাসান মামুন।

তবে মোরশেদের ছোট ভাই সেলিম র‌্যাবের এই দাবি নাকচ করে দিয়েছেন। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি জানান, ২৫ মার্চ ভোরে স্থানীয় ইলিয়াস, ফারুক ও আহমদ নূরের নেতৃত্বে একদল সাদা পোশাকধারী লোক বাঁশখালী উপজেলার চাম্বল এলাকার নিজ বাড়ি থেকে মোরশেদকে ধরে নিয়ে যায়। এ সময় তারা নিজেদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বলে পরিচয় দেয়। মোরশেদকে নিয়ে যাওয়ার সময় বাধা দেওয়ায় মোরশেদের মা ও স্ত্রীকে মারধর করা হয় বলেও জানান তিনি।

তিনি বলেন, ‘আমার ভাইকে নিয়া গেছে ২৫ জানুয়ারি ভোর ৩টা ৪৫ মিনিটের সময়। আমি তখন ৬টা বাজে বাঁশখালী থানায় হাজির হই। বাঁশখালী থানায় আমকে বলতেছে ‘আমাদের কোন অভিযান ওখানে চলে নাই’। আমি তখন ৯৯৯ এ হেল্পলাইনে কল দিয়া হেল্প চাইছিলাম। তখন সেখান থেকেও আমাকে বাঁশখালী থানার ওসির নাম্বার দেয়। আমি যখন ওসি স্যারের সাথে কথা বলি ওসি স্যার আমার ভাইকে কোন জাগায় কারা নিয়া গেছে আমাকে তদন্ত করে জানাবে বলছে। আমি তখন একটা জিডি করতে চাইছি। আমার জিডি কপিটা ওরা গ্রহণ করে নাই। আমি সারা দিন থানায় ছিলাম। রাত ১০ টা বাজে আমি থানা থেকে বাড়িতে যাই। যখন রাত ১ টা হয়, তখন আমার ছোট ভাই মিজানকে র‌্যাবে ফোন করে বলে আমার ভাই ক্রসফায়ার হয়ে গেছে। লাশটা নিয়ে নিতে।’

তিনি জানান, রুহু জান বিবি জামে মসজিদের ওয়াকফ সম্পত্তি জবরদখলে বাধা দেওয়ায় স্থানীয় ইউনুস , ফারুক ও আহমদ নূরের রোষানলে পড়ে মোরশেদ। এই ঘটনার জের ধরে মোরশেদের বিরুদ্ধে ৭-৮ টা মিথ্যা মামলা দায়ের করে তারা। তাদের করা একটা মামলায় ৬ বছর জেল খেটে জামিনে বের হয় মোরশেদ। বের হওয়ার পরও তারা বিভিন্ন সময়ে মোরশেদকে হুমকি ধামকি দিত। এসব বিষয়ে বাঁশখালী থানায় একটি জিডিও সে সময় দায়ের করেছিলেন মোরশেদ। ফারুক, ইলিয়াস, আজাদ সহ ৭ জনের নাম উল্লেখ করে করা সেই জিডির তদন্তে বাঁশখালী থানা থেকে দেওয়া একটি প্রতিবেদনে অভিযুক্তদের স্বভাব চরিত্র খুব খারাপ বলেও উল্লেখ করা হয়। ওই প্রতিবেদন দেওয়ার ৩ মাসের মাথায় কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হলেন মোরশেদ।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে বাঁশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, ২৫ জানুয়ারি মোরশেদের পরিবারের সদস্যরা থানায় এসেছিলেন জিডি করতে। জিডি না নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা বলেছে অপহরণ করে নিয়ে গেছে এই কারণে জিডি নেওয়া হয়নি।

মোরশেদের করা জিডির বিষয়ে তিনি বলেন, এই ধরনের একটি জিডি করেছিলেন মোরশেদ। তদন্ত করে এই বিষয়ে প্রতিবেদনও দেওয়া হয়েছিল। তবে এই বিষয়ে কোন মামলা দায়ের করা হয়নি।

র‌্যাব-৭ এর সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) মাহমুদুল হাসান মামুন বলেন, ‘আগের দিনের ঘটনার বিষয়ে কিছু জানা নেই আমাদের। আমাদের সাথে আজকেই (২৬ জানুয়ারি) বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে।’

অন্যদিকে মোরশেদকে ধরে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ফারুক ও আহমেদ নুর। মো. ফারুক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘মোরশেদ আমার পিতাকে খুন করেছে। সেই মামলায় জেল খেটে হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে এসেছে। এসে এলাকায় আবার সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু করেছে। আহমদ নূরের একটা সিএনজি ছিনতাই করেছে। এসব নিয়ে আহমদ নূর মামলা করেছে সংবাদ সম্মেলন করেছে। ওর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অভিযোগ ছিল। আমাদের বিরুদ্ধে যা বলা হচ্ছে তা মিথ্যা। প্রশাসনের সাথে আমরা জড়িত হতে যাব কেন? আমরা এই বিষয়ে কিছু জানি না।’

আহমেদ নূর বলেন, ‘আমার সাথে মোরশেদের কোন বন্ধুত্ব বা শত্রুতা কিছু ছিল না। ফারুকদের সাথে একটা জায়গা নিয়া তাদের দ্বন্দ্ব ছিল। সেসব কারনে সে জেল খেটে বের হয়েছে। গত মাসে সে আমার একটা সিএনজি আটক করে চাঁদা দাবি করে। তখন আমি আইনের আশ্রয় নিই। কালকে শুনেছি সে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। এর বাইরে এই বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।’

প্রসঙ্গত মোর্শেদ আলম (৩৫) চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার ২নম্বর ওয়ার্ড পশ্চিম চাম্বল এলাকার মৃত ছিদ্দিক আহম্মদ সওদাগরের পুত্র। দীর্ঘদিন ধরে পারিবারিকভাবে একই এলাকার মৃত বুজুরুজ ও তার ছেলেদের সাথে বিরোধ ছিল মোরশেদের পিতা ও ভাইদের। দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি অনেকগুলো মামলা হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে স্থানীয় সূত্রে পাওয়া গেছে। এর মধ্যে একটি মামলায় ২০১৩ সাল থেকে টানা ৬ বছর জেল খেটে মুক্তি পেয়েছিলেন মোরশেদ। তার ৬ বছর বয়সী একটি মেয়ে রয়েছে। বর্তমানে তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!