মহালয়া ঘিরে বোয়ালখালীর আশ্রমে সংঘাতের শঙ্কা, ‘গুন্ডামি’ সইবে না স্থানীয় হিন্দু সমাজ

বোয়ালখালী গিয়ে রাউজানের ‘গরম’ দেখান একজন, আরেকজন মন্ত্রীর

চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার করলডেঙ্গা পাহাড়ে অবস্থিত সনাতন হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম জনপ্রিয় তীর্থস্থান মেধস মুনি আশ্রম। প্রতিবছর মহালয়া ও দুর্গাপূজা উপলক্ষে প্রায় ১৫ হাজার ভক্তের সমাগমে মুখরিত থাকে ঋষি মেধসের এই আশ্রম। তবে এই আশ্রমে এবারের দুর্গাপূজায় মহালয়ার আয়োজনকে ঘিরে গতবারের মত এবারও সংঘাতের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সংঘাত এড়াতে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন স্থানীয় হিন্দু সংগঠনের নেতারা।

স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, এবারের মহালয়ার দিনে অনুষ্ঠান আয়োজনকে ঘিরে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের চট্টগ্রাম জেলা শাখার নেতৃবৃন্দ ও স্থানীয় হিন্দু সমাজ। জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের নেতারা অবৈধভাবে অনুষ্ঠানে অনুপ্রবেশ করলে তা কঠোরভাবে প্রতিহতের ঘোষণা দিয়েছেন স্থানীয় হিন্দু সমাজের নেতৃবৃন্দ।

সরেজমিনে দেখা গেছে, শুক্রবার (২৩ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যার পর থেকে মেধস মুনি আশ্রম ঘিরে পাহারা বসিয়েছে স্থানীয় হিন্দুরা। মধ্যরাত পেরিয়ে গেলেও অন্তত ৩০০ লোককে মন্দিরের নিচে অবস্থান করতে দেখা গেছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশ পুজা উদযাপন পরিষদের নেতারা মেধস মুনি আশ্রমে আগের মতো অনুষ্ঠান করতে ডেকোরেশনের জিনিসপত্র পাঠিয়েছে ট্রাকে করে। তবে ডেকোরেশন সামগ্রী নিয়ে আসা ট্রাকটি স্থানীয় হিন্দুদের বাধার মুখে পড়ে সন্ধ্যায় মন্দিরের সামনে থেকে ফিরে গেছে।

জানা যায়, গত বছরের দুর্গাপূজায় মহালয়ার দিন এই আশ্রমে ঘটেছিল এক ন্যাক্কারজনক ঘটনা। সেদিন আলোচনা সভার অজুহাতে যজ্ঞ বন্ধ করে দেয় চট্টগ্রাম জেলা পূজা উদযাপন পরিষদ। ২০২১ সালের মহালয়ার দিন অনুপ্রবেশ করে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি শ্যামল কুমার পালিত এবং বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক ও আনোয়ারা ৭ নম্বর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অসীম কুমার দেব আশ্রমের সেবায়েত বুলবুল নন্দ মহারাজকে মারধর করেছিলেন। এবার কোনভাবে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি চায় না স্থানীয় হিন্দু সমাজ।

বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের বোয়ালখালীর আমুচিয়া ইউনিয়ন শাখা কমিটির আহবায়ক সঞ্জয় চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ও ভারতীয় সহকারী হাই কমিশনারের কাছে স্থানীয় হিন্দু সমাজ স্মারকলিপি দিয়েছে ইতিমধ্যে। কমিটি গঠনের আগে সেবায়েতের লিখিত অনুমতি লাগে। কিন্তু হঠাৎ নিয়মনীতি না মেনেই অবৈধ কমিটি দিয়েছে একটি চক্র। তারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। হিন্দুদের অসহায়ত্বের সুযোগে এখানকার হিন্দুদের ‘পুতুল’ বানিয়ে খেলা করছে। মেধস মনি আশ্রম বোয়ালখালী সংসদীয় আসনের আওতায়। অথচ কথায় কথায় শ্যামল পালিত ভয় দেখাচ্ছে রাউজানের সাংসদ ফজলে করিমের। বোয়ালখালীর মন্দিরে রাউজানের সাংসদের কাজ কী? এছাড়া আনোয়ারা সদরের চেয়ারম্যান অসীম কুমার দেবও ভয় দেখান আরেক মন্ত্রীর। এসব তামাশা বোয়ালখালীর হিন্দু সমাজ মেনে নেবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘মেধস মুনি আশ্রমে যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে কোন কমিটি নেই, পূজা কমিটির নেতাদের আমন্ত্রণ জানাবে সেবায়েত। কিন্তু আমন্ত্রণ ছাড়াই আশ্রমে এসে মাইক বাজিয়ে, হঙ্কার দিয়ে বক্তব্য রাখবে কেন তারা? তাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বোয়ালখালীর হিন্দু সমাজ ঐক্যবদ্ধ। আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য ও নৈতিক দাবি আমরা ইতিমধ্যে প্রশাসনকে জানিয়েছি। এরপরও যদি কেউ অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে, তাহলে যেকোন ধরনের পরিস্থিতির জন্য তারাই দায়ী থাকবে।’

স্থানীয় হিন্দু সংগঠনের একাধিক নেতা বলেন, মেধস মুনি আশ্রম দখলে নিতে পাঁয়তারা করছে মন্দিরের দখলদাররা। তারাই হিন্দু সমাজকে বিভক্ত করে টুকরো টুকরো করে রেখেছে। প্রতিবছর দুর্গাপূজা আসলেই হঠাৎ জেগে উঠে তারা। শহর থেকে গায়িকা এনে গান গাওয়া কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান না। পূজা উদযাপন পরিষদের নেতাদের তো এখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। গত বছর মন্দিরে অনুপ্রবেশ করে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি শ্যামল কুমার পালিত এবং বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক ও আনোয়ারা ৭ নম্বর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অসীম কুমার দেব আশ্রমের সেবায়েত শ্রীমৎ স্বামী বুলবুলানন্দ মহারাজকে মারধর করেছিলেন।

হিন্দু নেতারা প্রশ্ন রাখেন, কী স্বার্থে এরা এখানে অনুপ্রবেশ করছে? আমরা স্থানীয়রা কি মরে গেছি? এবার এ ধরনের কেউ অনুপ্রবেশ করে ইজ্জত নিয়ে মন্দির থেকে ফিরে যেতে পারবে না। জীবনের বিনিময়ে হলেও এবার অনুপ্রবেশকারীদের প্রতিরোধ করা হবে।

দেবীভাগবত পুরানের মতে, দেবী দুর্গা দুনিয়ায় সর্ব প্রথম ঋষি মেধসের এই আশ্রমে নেমে এসেছিলেন। তাই সনাতনী ধর্মাবলম্বীদের কাছে এই আশ্রম অন্যতম শ্রেষ্ঠ তীর্থস্থান। প্রতিদিন অসংখ্য ভক্ত ও দর্শনার্থীতে মুখরিত থাকে এ আশ্রম। তবে দুর্গা পূজার উৎপত্তিস্থল হিসেবে স্বীকৃত মেধস মুনি আশ্রমে এবারের দুর্গাপূজায় মহালয়ার আয়োজনকে ঘিরে সংঘাতের আশঙ্কা তৈরির পেছনে এবারও জেলা পূজা উদযাপন কমিটির নেতৃবৃন্দের হাত রয়েছে বলে জানিয়েছেন আশ্রমের সেবায়ত শ্রীমৎ স্বামী বুলবুলানন্দ মহারাজ।

বুলবুলানন্দ মহারাজ বলেন, ‘মেধস মুনি আশ্রমে আমি ২০০২ সাল থেকে টানা ২০ বছর ধরে সেবায়ত হিসেবে রয়েছি। গত ২৫ আগস্ট আমি ভারত গিয়েছিলাম। আমার ভারত যাওয়ার পরের দিন তড়িঘড়ি করে নিয়মবহির্ভূত সভা করে একটা অবৈধ কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিধান অনুযায়ী কমিটি গঠনে স্থানীয় সাংসদ ছাড়াও উপজেলা প্রশাসন ও সেবায়েতের লিখিত অনুমতির প্রয়োজন থাকলেও তা মানা হয়নি। ওই সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য (চট্টগ্রাম-৮) মোছলেম উদ্দিন আহমদ দেশেই ছিলেন না। তিনি তখন সিঙ্গাপুর ছিলেন। তিনি দেশে ফিরে কমিটি গঠন করবেন বলে জানিয়েছিলেন। সেটাও না মেনে নিয়মবহির্ভূতভাবে অবৈধ কমিটি গঠন করা হয়েছে।। তবে তারা চাইলেও অবৈধ কমিটি এ আশ্রমে এবারের দুর্গাপূজায় মহালয়ার দিন অনুষ্ঠান করতে পারবেন না। এদিন বিভিন্ন যজ্ঞসহ শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে আশ্রমের পক্ষ থেকে। ভক্ত হিসেবে যে কেউই আসতে পারবে। তবে এখানে কাউকে অশাস্ত্রীয় কার্যকলাপ করতে দেওয়া হবে না।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের চট্টগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি শ্যামল পালিত বলেন, ‘মেধস মুনি আশ্রমের পূজা উদযাপন পরিষদের কোনো কমিটি গঠনে আমাদের হাত নেই। এখানে কমিটি দেওয়ার এখতিয়ার নেই আমাদের। আমরা গত ৩০ বছর ধরে এ আশ্রমে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছি। এবারও আমাদের আয়োজন থাকবে।’

গত বছরের মত এবারও মহালয়ার দিন এ আশ্রমে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে —এমন আশঙ্কার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি ‘ব্যস্ত আছি’ বলে মুঠোফোনের সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে দেন।

এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক ও আনোয়ারার ৭ নম্বর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অসীম কুমার দেবকে একাধিক ফোন করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।

এদিকে এ কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুকোমল চৌধুরী ১৩ বছর আগে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া কমিটিরও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া অবৈধভাবে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে ৫ বছরের জন্য। যদিও নিয়ম অনু্যায়ী সর্বোচ্চ ৩ বছরের জন্য কমিটি গঠন করার বিধান রয়েছে।

এ বিষয়ে সুকোমল চৌধুরী বলেন, আশ্রমে কেন্দ্রীয় পূজা কমিটির মাধ্যমে অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে থাকে। আমিও আগের কমিটিতেও ছিলাম, এবারও সাধারণ সম্পাদক পদে রয়েছি। এটা হচ্ছে খতিয়ানমূলে সেবায়েত শাসিত কমিটি। সেবায়তের পক্ষে একটা আশ্রম পরিচালনা কমিটি থাকে। সব কিছু এ কমিটির মাধ্যমে হয়ে থাকে। এ আশ্রম পরিচালনা কমিটির অনুমতি নিয়ে কেন্দ্রীয় পূজা কমিটি গত ৩০-৪০ বছর ধরে সেখানে যায়। আশ্রম দেখাশোনার কাজ করে সাধু। ব্যক্তিগতভাবে আমি এখন বয়সের ভারে সেখানে যেতেও পারি না। বর্তমানে আমার বয়স ৮৫ চলে। আগে সপ্তাহে দু-একবার আশ্রমে যেতাম, এখন তাও পারি না। আমাদের কমিটির সভাপতি সচ্চিদানন্দ রায় ওখানে যান। তাঁরও বয়স হয়ে গেছে, ৮২ বছর চলে।

তিনি বলেন, ‘এখানে কমিটি গঠনের জন্য স্থানীয় সাংসদ বা উপজেলা প্রশাসনের কারও অনুমতির দরকার পড়ে না। এখানে তো কোন সরকারি অনুদান নাই। লোকজন যায়, তাদের টাকায় এটা চলে। আগে তো ছোট ছিল, এখন হয়তো একটু বড় হয়েছে।’

বোয়ালখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রাজ্জাক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ বিষয়টা নিয়ে এর আগে মাননীয় সাংসদ, হিন্দু সংঠনের নেতৃবৃন্দ ও সেবায়েতসহ বৈঠক হয়েছিল। তখন তো সব ঠিকঠাক ছিল। এ ধরনের সংঘাতের আশঙ্কার বিষয়ে আমাদের কাছে তথ্য নেই।’

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ বিষয়টি নিয়ে আমাদের সাথে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের আলাপ হয়েছে। হিন্দু সংগঠনের নেতৃবৃন্দের স্মারকলিপি প্রদানের বিষয়টি জেনেছি। উপজেলা প্রশাসনে অনুলিপি পাঠালেও তা আমি এখনও পাইনি। মহালয়ার দিন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তো আমাদের কিছু করার নাই। তবে এ দিন কোন ধরনের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সম্ভাবনা দেখা দিলে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নেবো।’

জেএন/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!