‘পুলিশের প্রশ্রয়ে’ পথে পথে চাঁদাবাজি চকবাজারে

চকবাজারে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ছিনতাইকারী চাঁদাবাজরা। অলি-গলিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কিশোর গ্যাং। অটোরিকশা, ব্যাটারীচালিত রিক্সা, ভাসমান হকার থেকে শুরু করে ঠিকাদার কেউ রেহাই পাচ্ছে না চাঁদাবাজের কবল থেকে। অবাক করা বিষয় হল, থানার নতুন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) রুমে বসেই আড্ডায় মেতে উঠে কিশোর গ্যাং কিংবা সোর্স নামধারী অনেক অপরাধী। এমন অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। অপরাধীদের সঙ্গে পুলিশের বিশেষ সখ্যতায় ভুক্তভোগীরা থানা যেতেও ভয় পাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

জানা গেছে, তানভীর মেহেদী মাসুদ নামের এক ঠিকাদারের কাছে ৮ লাখ টাকা চাঁদা দাবি চকবাজারের ‘কথিত যুবলীগ নেতা’ মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে।মহিউদ্দিন চকবাজারের অন্তত ৫০ জনের একটি কিশোর গ্যাং লিডার। তারা এ চাঁদার দাবিতে একটি নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। চাঁদা না দিলে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, চকবাজারের আলী করিম ভবন চাঁন মিয়া মুন্সি লেইন এলাকার বাসিন্দা শেখ মহিউদ্দিন এ চাঁদা দাবি করেন। শেখ মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলাও রয়েছে খোদ চকবাজার থানায়। নগর গোয়েন্দা পুলিশের সূত্রে জানা যায়, মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে কিশোর গ্যাং মদদের অভিযোগ এলাকাবাসীর।

ভুক্তভোগীর অভিযোগ, চকবাজারের খাল পাড়ে ব্যক্তি মালিকানাধীন ৯ তলা একটি ভবনের নির্মাণ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। দায়িত্ব পাওয়ার পর কাজ শুরু করতে গেলে শেখ মহিউদ্দিন এসে বলে, কাজ করতে হলে তার কাছ থেকে ইট, বালি, পাথর কিনতে হবে অতিরিক্ত দামে। আর না কিনলে যেন কাজ না করি। এমনকি একটি ঘাসও জায়গায় নেওয়া যাবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘একপর্যায়ে ভবনের মালিকের অনুরোধে তার কাছ থেকে ইট, বালি, পাথর কিনতে করতে রাজি হই। প্রথমে ভাল মানের নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে আসলেও একপর্যায়ে ১০ হাজার ইটের মধ্যে ৮ হাজার দুই নাম্বার ইট দেয়। এরপর তার কাছ থেকে নির্মাণ সামগ্রী নিবো না বললে তখন থেকে শুরু হয় হুমকি। একপর্যায়ে নির্মাণ সামগ্রী না নিলে ৮ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। চাঁদা না দিলে কি করে কাজ করি দেখে নিবে বলে মেরে ফেলার হুমকি দিতে থাকে। প্রতিদিন তার ছেলেপেলে নিয়ে এসে শোডাউন দেয়। চকবাজার থানায় এ ঘটনায় লিখিত অভিযোগ করা হলেও কোন প্রতিকার পাচ্ছি না।

তিনি জানান, ১২ নভেম্বর থানায় অভিযোগের পর আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে চাঁদাবাজরা। পুলিশের সঙ্গে তাদের বেশ সখ্যতা দাবি করে পরিনামে ভয়াবহ হবে বলেও হুমকি দেন। বিষয়টি থানা পুলিশকে মৌখিক জানানোর পরও তারা কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বরং পুলিশের পরামর্শেই আমার অভিযোগের পরদিন আমার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী মহিউদ্দিনের স্ত্রী একটি কথিত অভিযোগ করেন চকবাজার থানায়।

স্থানীয়দের অভিযোগ, চকবাজার থানায় নতুন ওসি যোগ দেওয়ার পরপরই হঠাৎ বেড়ে গেছে কিশোর গ্যাং ও চাঁদা দাবির ঘটনা। প্রতিদিনই ঘটছে চাঁদা দাবি থেকে শুরু করে ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা। তবে হামলার শিকার বা আঘাতে রক্তাক্ত হলেও কেউ থানায় যেতে চায় না। কারণ থানা পুলিশের হয়রানির ভয় চকবাজারেই বেশি। এই থানায় নতুন ওসি যোগ দেওয়ার পর থেকে এই ভয় আরও বেড়েছে। অভিযোগ করে উল্টো ঝামেলায় পড়তে হবে, এমন আশঙ্কায় থানার ধারেকাছেও পারতপক্ষে যান না ভুক্তভোগীরা।

তারা আরও বলেন, ‘চকবাজারে কথায় কথায় অস্ত্র দেখানো কিংবা গুলিবর্ষণ যেন তুচ্ছ বিষয়। টার্গেট ব্যক্তিকে ধরে এনে গোপন টর্চার সেলে নির্যাতনের ঘটনাও অহরহ। আবার অনেকের কাছ থেকে আদায় করা হয় নগদ টাকা। হোটেল রেস্টুরেন্টে খাবারের বিল চাইলেই চলে ভাঙচুর। চকবাজার এলাকায় গত কয়েক বছরে অন্তত ৪০ জন ছুরিকাঘাত ও গুরুতর জখম হয়েছে সন্ত্রাসীদের হাতে।’

চকবাজারে চাঁদাবাজির সাম্রাজ্য

পুলিশের তৈরি করা চট্টগ্রাম নগরের ৪৮ জন কিশোর গ্যাং গডফাদারের তালিকায় নাম আছে নূর মোস্তফা টিনুর। আর এসব কিশোর অপরাধীদের ব্যবহার করে তার মাসিক আয় ছিল অন্তত ৫০ লাখ টাকা। তবে কারাগারে থাকায় অবৈধ আয় কিছুটা কমেছে। অভিযোগ আছে, টিনুর চাঁদাবাজির টাকার ভাগ যায় রাজনৈতিক নেতাসহ স্থানীয় থানায়। তাই বছরের পর বছর টিনু ও তার সহযোগীরা নির্বিঘ্নে নানা অপরাধ করেও পার পেয়ে যায়।

এ বিষয়ে ভুক্তভোগী তানভীর মাসুদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার কাছ থেকে ৮ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করছে। আমি জীবন নিয়ে হুমকিতে আছি। আমাকে প্রতিনিয়ত সামনাসামনি ও মোবাইলেও প্রাণনাশের হুমকি ধামকি দিয়ে যাচ্ছে। খুব আতঙ্কে আছি। আমি তার বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগও করেছি।’

এ বিষয়ে জানতে অভিযোগ তদন্তকারী কর্মকর্তা চকবাজার থানার এএসআই তোজাম্মেল চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘মাসুদ নামের এক ব্যক্তি ব্যবসায়ী মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ করেছে। আমরা উভয় পক্ষকে রোববার (১৫ নভেম্বর) রাতে আসার জন্য বলেছি। উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনার পর আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!