পিতৃহারা তরুণকে থানায় অত্যাচারের প্রমাণ মিলেছে, ‘ছোতরা পাতা’র দোষ দিচ্ছেন পাঁচলাইশের ওসি

দুই পায়ে ‘শারীরিক নির্যাতন’ হয়েছে, জানালেন ডাক্তাররা

চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানার ভেতরে পিতৃহারা তরুণ মুস্তাকিমকে অকথ্য নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পর ওসি নাজিম উদ্দিন মজুমদার নির্যাতনে মুস্তাকিমের দুই পায়ের মাংসে পচন ধরার বিষয়টিকে ‘ছোতরা পাতা’ বা বিছুটি গাছের পাতার দাগ বলে দাবি করেছেন।

ওসির এমন দাবি যে মিথ্যা ও হাস্যকর, তার প্রমাণ মিলেছে মুস্তাকিমের ডাক্তারি পরীক্ষায়। মঙ্গলবার (১৭ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় পুলিশি নির্যাতনের দুই পা প্রায় অবশ হয়ে আসা মুস্তাকিম চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে যান ডাক্তারের পরামর্শ নিতে। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা দুই পায়ে ‘ফিজিক্যাল অ্যাসল্ট’ বা শারীরিক নির্যাতন শনাক্ত করেন। প্রাথমিকভাবে ডাক্তাররা তাকে কিছু ওষুধ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়েছেন পরবর্তী চিকিৎসার পদক্ষেপ হিসেবে। তবে ডাক্তাররা উন্নত চিকিৎসার জন্য মুস্তাকিমকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু পুলিশের ভয়ে মুস্তাকিম পাঁচলাইশ থানার আওতাধীন ওই হাসপাতালে ভর্তি হতে রাজি হচ্ছেন না।

চট্টগ্রাম মেডিকেলে মায়ের ডায়ালাইসিস করাতে গিয়ে পাঁচলাইশ থানা পুলিশের অভাবনীয় রোষের শিকার সৈয়দ মুস্তাকিমকে কোনো রিমান্ড ছাড়াই পুলিশি হেফাজতেই নির্মমভাবে অত্যাচার করা হয়। পাঁচলাইশ থানার একটি রুদ্ধদ্বার কক্ষে হাতে-পায়ে পেটানো ছাড়াও পুলিশ তার পুরুষাঙ্গে আঘাত করে। টানা দুদিন তার পুরুষাঙ্গ দিয়ে রক্ত ঝরেছে। এমনকি মুখে দাড়ি থাকায় কটুক্তি করেও তাকে পেটানো হয়। থানায় পুলিশের নির্যাতনে মুস্তাকিমের দুই পায়ের মাংসে এরই মধ্যে পচন ধরে গেছে।

মুস্তাকিমের বাবা মারা গেছেন। মা কিডনি রোগী। এক বোন প্রতিবন্ধী। ফটিকছড়ি তার গ্রামের বাড়ি হলেও তিনি হাটহাজারীর একটি ভাড়া বাসায় মাকে নিয়ে থাকেন।

মঙ্গলবার (১৭ জানুয়ারি) দুপুর পৌনে ১২টায় ফেসবুকে নিজের আইডি থেকে দেওয়া এক পোস্টে পাঁচলাইশ থানার ওসি নাজিম উদ্দিন মজুমদার দাবি করেছেন, ‘পুলিশ যদি লাঠি দিয়ে পিটায় তার দাগ কি এমন হয়…? ছোট বেলায় আমরা গাছের একটা পাতাকে খুব ভয় পেতাম…নোয়াখালীর ভাষায় এটাকে ছোত্তা পাতা (চুতরা পাতা) বলে…যেখানেই লাগে চুলকাবে আর লালবর্ণের হয়ে যায়…১০ তারিখে পুলিশি নির্যাতনের আঘাত ১৬ তারিখ পর্যন্ত কিভাবে এতো সতেজ থাকে?’

চট্টগ্রাম মেডিকেলে মায়ের ডায়ালাইসিস করাতেন সৈয়দ মুস্তাকিম। হঠাৎ ডায়ালাইসিসের ফি বাড়ানোর প্রতিবাদ করেন রোগী ও রোগীর স্বজনরা। এই আন্দোলনে যোগ দেওয়ার পর মঙ্গলবার (১০ জানুয়ারি) চট্টগ্রাম মেডিকেলের প্রধান ফটক থেকে দুপুর ১টার দিকে আটক করার পর মুস্তাকিমকে নিয়ে যাওয়া হয় পাঁচলাইশ থানায়। রাত ১টা পর্যন্ত তার কিডনি রোগী মা একমাত্র অবলম্বন সন্তানকে ছাড়িয়ে নেওয়ার আশায় পাঁচলাইশ থানায় ছিলেন। মা থানা থেকে বের হয়ে আসার পরপরই মুস্তাকিমকে নিয়ে যাওয়া হয় পাঁচলাইশ মডেল থানার একটি ‘টর্চার সেলে’। ওইদিন রাত দেড়টার দিকে তাকে নির্যাতন করা শুরু হয়।

রোববার (১৫ জানুয়ারি) জামিনে মুক্ত হন মুস্তাকিম। জামিনে বেরিয়ে আসার পর সাংবাদিকদের কাছে থানার ভেতরে পুলিশি নির্যাতনের বর্ণনা দেন তিনি।

মুস্তাকিম বলেন, ‘প্রথমে সাধারণ সেলে রাখা হলেও ঘণ্টাখানেক পর এক পুলিশ সদস্য এসে আলাদা একটি রুমে আমাকে নিয়ে যান। যেখানে আমি ছাড়া আরও কয়েকজন পুলিশ ছিল। প্রথমেই ওরা আমার দাড়ি দেখে জানতে চায়, আমি জামায়াত-শিবিরের লিডার কিনা? আমি বলি না। তারপর ওরা আবার বলে, তাহলে দাড়ি এত বড় কেন? এটা তো শিবিরের দাড়ি। তখন আমি বলি, আমাকে কিছু এনে দেন; আমি দাড়িটা কেটে ফেলি। এটা বলার পরপরই একটি কালো লাঠি দিয়ে আমাকে লাঠি দিয়ে বেধড়ক মারতে থাকে। ওরা এমনভাবে মারছিল যে, কোথায় আঘাত লাগছে সেটাও দেখছিল না।’

‘আর এখনতো মেডিসিন দিয়েও এসব দাগ বানানো যায়’— ফেসবুকে নিজের আইডি থেকে দেওয়া এক পোস্টে এমন যুক্তি দেখিয়ে পাঁচলাইশ থানার ওসি নাজিম বলেন, ‘এই ছেলেটা যদিও ইসলামী ছাত্র সেনার সদস্য…কিন্তু জামাত শিবিরের সাথে তার সখ্যতা আছে…এর প্রমাণ তার আশেপাশে যারা তাকে সহযোগিতা করছে সবাই সরকারবিরোধী উস্কানিদাতা এবং পুলিশ বিদ্বেষী…মোট কথা এখন আর বিষয়টা ডায়ালাইসিস রোগী, মুস্তাকিমের মাঝে সীমাবদ্ধ নাই…এটাকে একটা জাতীয় ইস্যু তৈরি করে কিছু সুবিধাবাদী তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার সুযোগ নিচ্ছে…।’

জানা গেছে, মুস্তাকিম ‘জামায়াত-শিবিরবিরোধী’ হিসেবে পরিচিত ইসলামী ছাত্রসেনার চট্টগ্রাম নগরের ১ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ড শাখার আহ্বায়ক। তিনি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গাউসিয়া কমিটির সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন।

এদিকে ফেসবুক পোস্টে ওসি নাজিম উদ্দিন মজুমদার দাবি করেন, ‘পুলিশি হেফাজতে ছেলেটিকে নির্যাতন করা হয়নি…এটা একটা সাজানো ড্রামা…এই ড্রামা আরও কিছুদিন চলবে তবে সবকিছুরই শেষ আছে…দিনশেষে সত্যেরই জয় হয় আল্লাহ ভরসা।’

জামিনে মুক্ত হওয়ার পর মুস্তাকিম বলেন, ‘লাঠির মারে কোমরের নিচ থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত লাঠির আঘাতে লাল হয়ে যায়। উরু ও পায়ে মারার পর যখন আর যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না, এরপর হাত দিয়ে আমার উরু বাঁচাতে যাই; তখন হাতে মারা শুরু করে। পেটানোর সময় এক পুলিশ বারবার বলছিল, ‘ওসি স্যারের সঙ্গে আর বেয়াদবি করবি?’

মুস্তাকিম বলেন, ‘তারা এতটাই অমানবিক যে, আমার পুরুষাঙ্গেও আঘাত করে। যখন আমি অনেকটা অজ্ঞানের মতো হয়ে যাই, তখন আমাকে আবার আগের সেলে নিয়ে যায়। পুরুষাঙ্গের ব্যথায় আমি দু’দিন প্রস্রাব করতে পারিনি। রক্তও যায় পুরুষাঙ্গ দিয়ে।’

এদিকে পাঁচলাইশের ওসি নাজিম ফেসবুক পোস্টে আরও দাবি করেছেন, ‘যে ছেলেটি জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর শুধু আমার সাথে দেখা করার জন্য অফিসে আসে…আমার পা ধরে সালাম করতে চায়… ভেবেছিলাম অনুশোচনা বোধ থেকে হয়তো…ছেলেটির মাকে নিজেই মা বলে সম্বোধন করলাম…ডায়ালাইসিসের জন্য ছেলে হিসেবে আর্থিক সহযোগিতা করলাম…অথচ কিনা সেই ছেলেটিরই এতো নাটক… তোমাকে যদি থানা হেফাজতে এতোই নির্যাতন করা হয়… আদালতেতো একটি বারও সে কথা বললে না…জামিনে আসার পর একটি বারও কাউকে বললে না…।’

জানা গেছে, জামিন পাওয়ার পর মোবাইল আনতে মা-বোনসহ পাঁচলাইশ থানায় যান মুস্তাকিম। ওই সময় ওসি যথেষ্ট আপ্যায়ন এবং ভালো নাস্তা খেতে দেন বলে জানান মুস্তাকিম।

মুস্তাকিম বলেন, ‘নাস্তা খাওয়ার পর দেখি, কোন একটা টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক ক্যামেরা নিয়ে আসছে। জিজ্ঞেস করছে আমাদের কেউ নির্যাতন করেছে কি-না। এর আগে ওসি এবং ক্যামেরাম্যান আমাদের বলে দিয়েছে, ‘বলবা কেউ মারেনি’। তাই আমরা বাধ্য হয়ে ওসির শেখানো কথামতো মিথ্যা জবানবন্দি দিই।’

কেন মিথ্যা বলতে গেলেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে মুস্তাকিমের মা বলেন, ‘কী করব বাবা? ওরা ৭-৮ জন পুলিশ আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, তখন থানা থেকে বের হওয়াটাই ফরজ হয়ে দাঁড়াইছে আমাদের জন্য। যদি ওদের কথা মতো না বলি, তখন যদি আবার আমার ছেলেকে মারে? সেই ভয়ে মিথ্যা বলতে বাধ্য হয়েছি।’

মুস্তাকিমের আইনজীবী ও বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের কেন্দ্রীয় মহাসচিব অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘মুস্তাকিমের সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে, তা সম্পূর্ণ বেআইনি। পুলিশ কখনও আসামির গায়ে হাত তুলতে পারে না। পুলিশের কাজ আসামিকে আটক করে আদালতে পাঠানো, আদালতই তার বিচার করবেন। পুলিশকে কেউ বিচার করার অধিকার দেয়নি। কিন্তু অনেক সময় পুলিশের কিছু অতি উৎসাহী সদস্য এমন কাজ করে বসেন, যার কারণে ‘ইমেজ সংকটে’ পড়ে ইউনিটটি।’

একই কথা বলেছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও। পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন করার আইন আছে কি-না, এমন প্রশ্নের উত্তরে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের সহকারী উপ-পুলিশ কমিশনার (উত্তর) মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘না, ওই রকম কোনো আইন নেই। আর পুলিশ আসামিকে মারতে যাবেইবা কেন? পুলিশকে আসামি নির্যাতনের কোনো নির্দেশ দেওয়া হয় না।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!