চট্টগ্রাম থেকে গার্মেন্টস ভিসায় রোমানিয়া পাঠানোর টোপ, প্রতারিত ৪০ নারী-পুরুষ ভারত থেকে ফেরত

ফেসবুকের টোপে আড়াই কোটি টাকা হাওয়া

ফেসবুকে ‘চলো যাই ইউরোপের দেশ রোমানিয়াতে’—এমন চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে অন্তত আড়াই কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এক প্রতিষ্ঠান। বিদেশে লোক পাঠানোর অনুমোদন দেখাতে না পারলেও এভাবেই মানুষকে এখনও প্রতারিত করছে চট্টগ্রাম নগরীর ইপিজেডের ‘আরএনআর হিউম্যান রিসোর্চ কন্সালন্টেন্ট’ নামের ওই প্রতিষ্ঠান। ৪০ জন নারী-পুরুষকে রোমানিয়া পাঠানোর কথা বলে তারা ভারত নিয়ে গেলেও কাউকে ভিসা দিতে পারেনি। ফলে আবারও দেশে ফিরে আসে ভুক্তভোগীরা।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, রোমানিয়ায় পাঠানোর কথা বলে শতাধিক লোক থেকে প্রায় আড়াই কোটি টাকা নিয়েছে আরএনআর হিউম্যান রিসোর্চ কন্সালন্টেন্ট নামের প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি রোমানিয়ার ভিসার জন্য দু’ধাপে ৪০ জনকে ভারতে নিয়ে গেলেও কাউকে ভিসা দিতে পারেনি তারা। প্রতিগ্রাহকের কাছ থেকে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা নিলেও বিপরীতে তাদের রশিদ দেওয়া হয়েছে মাত্র ৫০ হাজার, আবারও কাউকে এক লাখ টাকার। বাকি টাকার জন্য মৌখিক চুক্তি বলে গ্রাহকদের ওপর প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে অযৌক্তিক শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়।

শুক্রবার (১৯ জানুয়ারি) সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, ভিসা না পেয়ে ভারত থেকে ৪০ জন ফিরে আসার খবরে ইপিজেডের সিমেন্ট ক্রসিংস্থ রহমান টাওয়ারের ৪র্থ তলায় প্রতিষ্ঠানটির অফিসে শ’ খানেক লোক জড়ো হয়। তখন তাদের জমাকৃত টাকা ফেরত এবং ওইসব টাকার যথাযথ রশিদ প্রদানের দাবিতে বাকবিতণ্ডায় জড়ায় গ্রাহকরা। এসময় সাংবাদিকের উপস্থিতি টের পেয়ে আরএনআর কন্সালন্টেন্টের ক্যাশিয়ার শাখওয়াত পালিয়ে যায়। প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন প্রতিষ্ঠানটির কম্পিউটার অপারেটর মো. সোহাগ। এসময় গ্রাহকদের যাথাযথ টাকার রশিদ প্রতিষ্ঠান দেয়নি বলে স্বীকার করেন তিনি। ফোন দেওয়া হলে ক্যাশিয়ার শাখওয়াত মুঠোফোন বন্ধ করে দেন। এজেন্সি হিসেবে প্রতিষ্ঠানের সরকারি অনুমোদনের বিষয়ে জানতে চাইলে তার কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেনি।

তোহফা নামের এক ভুক্তভোগী নারী জানান, তিন মাসের মধ্যে রোমানিয়ায় পাঠানোর জন্য প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে তার সাড়ে তিন লাখ টাকার চুক্তি হয়। একবছর পর ভিসা দিতে ভারতে নিয়ে গেলেও তাকে ভিসা দিতে ব্যর্থ হয় আরএনআর নামের প্রতিষ্ঠানটি। চুক্তির দুই লাখ টাকা প্রতিষ্ঠানটিকে দেওয়া হলেও তাকে রশিদ দেওয়া হয়েছে মাত্র এক লাখ টাকার।

বাকি এক লাখ টাকার রশিদের বিষয়ে তিনি জানান, শুরুতে ৫০ হাজার টাকা প্রতিষ্ঠানের এমডি মোরশেদকে দেওয়া হয়। তখন আরও এক লাখ টাকা দিলে দেড় লাখ টাকার রশিদ দিবে বলে জানান তিনি। পরে এক লাখ টাকা নিয়ে গেলে প্রতিষ্ঠানটির ক্যাশিয়ার শাখাওয়াত তা গ্রহণ করেন এবং রশিদ দেন। এসময় আগের ৫০ হাজার টাকার রশিদ চাইলে মোরশেদ রোমানিয়ায় চলে গেছেন, ওই টাকার রশিদ শাখাওয়াত দিতে পারবেন না বলে জানান। পরে আরও ৫০ হাজার টাকা শাখাওয়াতকে দেওয়া হলেও তারও রশিদ দেওয়া হয়নি বলে জানান ওই গ্রাহক।

হাসিনা বেগম নামের আরেক ভুক্তভোগী জানান, তার স্বামী প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে রোমানিয়া গিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটি তিনমাসের মধ্যে তাকে রোমানিয়ায় পাঠাবে বলে চুক্তি হয়। এজন্য দেড় লাখ টাকা প্রদানও করা হয়। প্রায় ৭ মাস পর রোমানিয়ার ভিসার জন্য নিজ খরচে ভারতে যাওয়ার জন্য বলে তারা। প্রতিষ্ঠানটি ভিসা দেওয়ার শতভাগ নিশ্চিতের কথা দিলেও খালি হাতে তাকে দেশে ফিরে আসতে হয়েছে। এজন্য তার প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এছাড়া তাদের দেওয়া দেড় লাখ টাকার কোনো রশিদ দেওয়া হয়নি। রোমানিয়ায় থাকা স্বামীকে এজন্য কোনো রশিদ দেওয়া হয়েছে কিনা, জানা নেই।

আরফাতুল ইসলমা ভুইয়া নামের আরেক ভুক্তভোগী জানান, তাদের তিন বন্ধুর প্রতিজনকে ৭ লাখ টাকায় রোমানিয়ায় নিয়ে যাওয়ার কথা হয়। এজন্য এজেন্সি আরএনআর এর ফাহিম নামের একজনকে তিন লাখ টাকা দেওয়া হয়। ভিসার জন্য ভারতে নিয়ে গেলেও তাদেরও খালি হাতে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে প্রতিষ্ঠানটি। তিন লাখ টাকারও যথাযথ রশিদ দেওয়া হয়নি।

মো. বেলাল নামের আরেকজন বলেন, ‘রোমানিয়ায় যাওয়ার জন্য আরএনআর হিউম্যান রিসোর্চ কন্সালন্টেন্টকে আমি দেড় লাখ টাকা দিয়েছি। তারা আমাকে ডকুমেন্টস দিয়েছে ৫০ হাজার টাকার। বাকি লাখ টাকার ডকুমেন্টস চাইলে তারা একেক সময় একেক কথা বলে। কখনও বলে আপনাকে দেওয়া ডকুমেন্টসই যথেষ্ট, আর লাগবে না।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আরএনআর হিউম্যান রিসোর্চ কন্সালন্টেন্ট নামের প্রতিষ্ঠানটির প্রধান দুবাই প্রবাসী রিপন। তার গ্রামের বাড়ি কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া এলাকায়। প্রতিষ্ঠানটির এমডি হিসেবে আছেন রিপনের ছোট ভাই রোমানিয়া প্রবাসী ইমাম হাসান ইমন, তাদের চাচা মোরশেদ আলম। ক্যাশিয়ার পরিচয়ে অফিসের দেখভাল করেন শাখাওয়াত হোসেন ও কম্পিউটার অপারেটর মো. সোহাগ। তারা সবাই পারিবারিক সূত্রে পরস্পরের আত্মীয়। সবাই কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া উপজেলার স্থায়ী বাসিন্দা।

আরএনআর হিউম্যান রিসোর্চ কন্সালন্টেন্টের কর্ণধার দুবাই প্রবাসী রিপনের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘ভারতে পাঠানো ৪০ জনের ভিসা রোমানিয়া অ্যাম্বেসি রিজেক্ট করেছে, এখানে আমাদের কোনো দায় নেই। গ্রাহক আমাদের যতো টাকা দিয়েছে, তার ডকুমেন্টস আমরা দিয়েছি। এর বাইরে দালালদের কতো টাকা দিয়েছে, তা আমার জানা দরকার নেই।’

অফিসে গিয়ে দেওয়া টাকা দালাল কিভাবে নেয়, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনার মতো সাংবাদিকরা আমাদের কোম্পানিটি বন্ধ করে দিবেন। ওখানে যারা গেছেন তারা সবাই সন্ত্রাসী। তাদের বিরুদ্ধে আমরা মামলা করবো। আপনার বিরুদ্ধেও মামলা করা হবে। আপনাদের আসামি করে থানায় এজহার জমা দেওয়া আছে বলেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইপিজেড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ হোছাইন বলেন, ‘আরএনআর হিউম্যান রিসোর্চ কন্সালন্টেন্ট নামের এজেন্সিটির কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে আমার জানা নেই। অভিযোগ বা মামলা নিয়ে তাদের কোনো গ্রাহক বা কোম্পানিটির মালিক পক্ষের কেউ থানায় এসেছে বলেও আমি জানি না। গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণার বিষয়টি আমি খো্ঁজ নিয়ে দেখবো।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!