চট্টগ্রাম ওয়াসার নষ্ট মিটারে পোয়াবারো রিডারদের, ঝিমিয়ে ৬ কোটির প্রকল্প

প্রতিমাসে সিস্টেম লস ৩০ শতাংশ

চট্টগ্রাম ওয়াসার স্মার্ট ওয়াটার মিটার লাগানোর ছয় কোটি টাকার প্রকল্পকাজ দু’বছরেও আলোর মুখ দেখেনি। ফলে মেকানিক্যাল মিটার নষ্ট হওয়ার সুযোগ কাজে লাগিয়ে বেড়েই চলেছে মিটার রিডারদের চুরি। গ্রাহককে মনগড়া বিল দেওয়া, গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে কম বিল দেওয়া থেকে শুরু করে নানান দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে তারা। এফলে এভারেজ ও মিনিমাম বিলের কারণে প্রতিমাসে ওয়াসার সিস্টেম লস হচ্ছে ৩০ থেকে ৩১ শতাংশ।

ওয়াসার রাজস্ব বিভাগের হিসেবে নষ্ট মিটারের সংখ্যা ৩ হাজার। কিন্তু এ সংখ্যা প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজারের কাছাকাছি বলে জানা গেছে বিশ্বস্ত সূত্রে।

জানা গেছে, ব্যক্তি পর্যায়ে লাগানো বেশিরভাগ মেকানিক্যাল মিটারের কার্যকারিতা চলে গেছে। ফলে এসব নষ্ট মিটার হয়ে উঠেছে মিটার রির্ডারদের টাকা কামানোর হাতিয়ার। মিটার নষ্ট হলে নতুন মিটার লাগাতে বড় অংকের খরচ হয় গ্রাহকের। তাই মিটার রিডাররা গ্রাহকদের নতুন মিটার লাগাতে নিরুৎসাহিত করেন। মিটার নষ্ট থাকলে ইচ্ছেমতো পানি তোলার পরও রিডিং মিটারে তা ওঠে না। এমন চুরি ধামাচাপা দিতে মাসোহারা নেন মিটার রিডাররা। আর বাড়ির মালিকরা পান এভারেজ বিল।

চট্টগ্রাম ওয়াসায় বর্তমানে প্রায় ৭৮ হাজার গ্রাহক রয়েছে। এর মধ্যে ১২ শতাংশ অনাবাসিক আর ৭৮ শতাংশ আবাসিক গ্রাহক। চট্টগ্রাম ওয়াসায় উৎপাদিত পানি সরবরাহের জন্য মোট পাইপলাইন রয়েছে ৯৬২ কিলোমিটার। এর মধ্যে পুরোনো বা নষ্ট পাইপলাইন ৩৩২ কিলোমিটার।

অভিযোগ রয়েছে, যেসব মিটার ভালো, সেসবের রিডিং দেখে বিল না করেন না মিটার রিডাররা। অনেকে মিটার রিডিং দেখতেও যান না গ্রাহকের বাড়িতে। ফলে তারা এভারেজে বিল দিয়ে থাকেন গ্রাহককে। এছাড়া মিটার রিডারদের মধ্যে অনেকে সিবিএ নেতা। এসব নেতা মিটার রিডিংয়ের কাজে আলাদা লোক নিয়োগ দেন। তাদের ভাষায় এসব লোককে ‘বদি আলম’ হিসেবে ডাকা হয়। এই ‘বদি আলম’ গিয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে মাসোহারা নেন, আর বিল দেন এভারেজ হিসেবে।

চট্টগ্রাম ওয়াসার ৪১ জন মিটার রিডারদের মধ্যে প্রায় থেকে ২৫ জনই সিবিএ নেতা। তারা সরাসরি চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি কর্তৃক পদায়নকৃত। এমডির প্রিয়ভাজন ও সিবিএ নেতা হওয়ার সুবাদে তারা ইচ্ছেমত ‘বদি আলম’ রেখে অফিসে বসে বিল তৈরি করে থাকেন। এই ধরনের প্রায় ২০ জন লোক মিটার রিডারদের নিয়োগ দেওয়া সহকারী (বদি আলম) হিসেবে কাজ করেন বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিটার রিডার মো. এনায়েত চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘৭৮ হাজার গ্রাহকের জন্য মাত্র ৪১ জন মিটার রিডার। আমরা এত কম লোকবল দিয়ে কাজ করতে পারি না বলে সহকারী (বদি আলম) রেখেছি। আর নষ্ট মিটার দেখতে গ্রাহকের বাড়ি যাওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তাই আমরা অফিসে বসেই এভারেজ বিল করে থাকি।’

চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম ফজলুল্লাহ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘শুধুমাত্র মেকানিক্যাল মিটারের কারণে চট্টগ্রাম ওয়াসার অর্জন হুমকির মুখে। গ্রাহকদের অসন্তোষ কমছে না। কমছে না মিটার রিডারদের দুর্নীতি। নতুন পাইলট প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে এ সমস্যা থেকে উত্তোরণ মিলবে।’

সিবিএ নেতাদের মিটার রিডার হিসেবে পদায়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এসব অপপ্রচার। যে যার যোগ্যতা দিয়ে নিজের পদে আছেন।’

আলোর মুখ দেখেনি ৬ কোটির প্রকল্প

মেকানিক্যাল মিটার পরিবর্তন করে পাইলট প্রকল্পের আওতায় ৩ হাজার স্মার্ট ওয়াটার মিটার লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয় চট্টগ্রাম ওয়াসা। এজন্য ২০২২ সালের জানুয়ারিতে দরপত্র আহ্বান করে ওয়াসা। ৫ কোটি ৮০ লাখ টাকায় ওই দরপত্র পায় ‘অটোমেটেড মিটার রিডিং ফিচার’ নামের প্রতিষ্ঠান। কিন্তু দরপত্র পাওয়ার দু’বছর হতে চললেও এখনও শুরু হয়নি মিটার লাগানোর কাজ।

তবে প্রকল্প নিয়ে হতাশা ঝেরেছেন ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, এ প্রকল্পের দরপত্র সম্পন্ন হলেও এখনও কাজ শুরু হয়নি। প্রথম পর্যায়ে ৩ হাজার গ্রাহক এ প্রকল্পের আওতায় আসবে। কিন্তু ৭৮ হাজার গ্রাহককে এ প্রকল্পের আওতায় আনা এবং পানি চুরি বন্ধ করাটা দুরাশা।

এই ব্যাপারে চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৗশলী মাকসুদ আলম বলেন, ‘পাইলট প্রকল্পের অধীনে স্মার্ট ওয়াটার মিটার সরবরাহ করবে ‘অটোমেটেড মিটার রিডিং ফিচার’। মিটার সরবরাহের পাশাপাশি স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও পালন করতে হবে তাদের।’

তিনি বলেন, ‘স্মার্ট মিটারের কাজ খুব শিগগিরই শুরু হবে বলে আশা করছি। আসলে মিটারগুলো পরীক্ষার জন্য বুয়েটে পাঠানো হয়েছে। সেখানে থেকে পজিটিভ রিপোর্ট আসলে আমরা কাজ শুরু করব। আমরা বুয়েটে পাঠানোর পর থেকে তাগাদা দিয়ে যাচ্ছি। পাইলট প্রকল্প হিসেবে প্রথমে আমরা চান্দগাঁও এবং আশপাশের এলাকায় ৩ হাজার স্মার্ট মিটার বসাবো। এরপর পুরো নগরী কাভার করব। তবে বুয়েটের স্বীকৃতির উপরই নির্ভর করছে, মিটরে কবে বসবে। ধাপে ধাপে পুরো নগরীতে সব গ্রাহকদের আমরা স্মার্ট মিটারের আওতায় নিয়ে আসবো।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!