চট্টগ্রামে ৭ দিনের ‘টর্চার সেলে’ চরম নিষ্ঠুরতার নালিশ বাবুল আক্তারের, ২১ পাতার অভিযোগ

অভিযোগের আঙ্গুল ৬ জনের ওপর

স্ত্রী খুনের ঘটনায় সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তার চাকরি থেকে অব্যাহতি নেওয়ার পর পুলিশেরই কয়েকজন কর্মকর্তা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য একাট্টা হয়ে ষড়যন্ত্রের পট তৈরি করেন। আর এরই অংশ হিসেবে স্ত্রী খুনের মামলাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে প্রতিহিংসামূলক কর্মকাণ্ড শুরু করেন তারা। এ ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) দুই কার্যালয়ে টানা আটদিন ধরে নির্যাতন করা হয়েছে বাবুলকে। এ সময় স্ত্রী হত্যার ঘটনায় মিথ্যা স্বীকারোক্তি দেওয়ার জন্য তার সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়। হাতকড়া পরিয়ে চোখ বেঁধে চালানো হয় নির্যাতন।

এমন সব অভিযোগ এনে বৃহস্পতিবার (৮ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ ড. বেগম জেবুন্নেছার আদালতে মামলার আবেদন করেন বাবুল আক্তার। গত বছরের ১৭ মে স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলায় জবানবন্দি দেওয়ার জন্য বাবুল আক্তারকে চট্টগ্রামের আদালতে নিয়ে আসা হলে সেখানে তিনি আইনজীবীদের কাছে রিমান্ডে থাকাকালীন তার চালানো নির্মম নির্যাতনের ওই বিবরণ দেন।

বাবুলের আবেদনে আসামি করা হয়েছে ছয়জনকে। এরা হলেন— পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার, পিবিআই চট্টগ্রাম জেলা ইউনিটের এসপি নাজমুল হাসান, চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিটের এসপি নাঈমা সুলতানা, পিবিআইয়ের সাবেক পরিদর্শক (বর্তমানে খুলশী থানার ওসি) সন্তোষ কুমার চাকমা ও একেএম মহিউদ্দিন সেলিম (বর্তমানে পাহাড়তলী জোনের সহকারী কমিশনার) এবং চট্টগ্রাম জেলা ইউনিটের পরিদর্শক কাজী এনায়েত কবির।

২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরের ওআর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তদের গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন হন মাহমুদা খানম মিতু। এ ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচিত হয়। ঘটনার সময় মিতুর স্বামী পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার অবস্থান করছিলেন ঢাকায়। পিবিআই বলে আসছে, বাবুলের নির্দেশেই খুনিরা তার স্ত্রীকে খুন করেছে।

বৃহস্পতিবার (৮ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ বরাবরে দেওয়া হেফাজতে নির্যাতনের ফৌজদারি অভিযোগে যা বলা হয়েছে, তার সংক্ষিপ্তসার এখানে তুলে ধরা হল—

‘এতো কৈফিয়ত দেবার সময় নেই’

গত বছরের ৮ মে আগে মিতু হত্যামামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা (বর্তমানে চট্টগ্রামে খুলশী থানার ওসি) বাবুল আক্তারের হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠিয়ে পিবিআইয়ের চট্টগ্রাম মেট্রো অফিসে যাওয়ার অনুরোধ জানান। ওই সময় সন্তোষ চাকমা জানান, ‘পিবিআই প্রধান বনজ স্যার বলেছেন, আপনি আসলে বনজ স্যারকে জানাবেন।’ বাবুল আক্তার তখন সন্তোষ চাকমাকে জানান, তিনি ১০ মে আসবেন। তবে আগের দিন সন্তোষ চাকমার কথামতো বনজ কুমার মজুমদারকে বাবুল আক্তার কয়েকবার ফোন করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

১০ মে সেহেরি খাওয়ার পর ভোর চারটার দিকে বাবুল আক্তার ঢাকার মোহাম্মদপুরের ভাড়া বাসা থেকে রওনা হয়ে সকাল সাড়ে নয়টার দিকে পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো অফিসে পৌঁছান। অফিসের দোতলায় তিনি সন্তোষ চাকমার কক্ষে যাওয়ার পর তাকে মিতু হত্যামামলার খসড়া চার্জশিটটি দেখতে দেওয়া হয়। খসড়া ওই চার্জশিটে আসামি হিসেবে তিনি সাতজনের নাম দেখতে পান। এরা হলেন— মোতালেব, আনোয়ার, ভোলা, সাইদুল ইসলাম শিকদার, শাহজাহান, কামরুল ইসলাম শিকদার প্রকাশ মুছা ও খায়রুল ইসলাম প্রকাশ কালু। কপিটি দেখার সময়ই তদন্ত কর্মকর্তা সন্তোষ চাকমা ‘স্যার আমি একটু ফোনে কথা বলে আসি’ বলে রুমের বাইরে চলে যান।

১৫-২০ মিনিট পর সন্তোষ চাকমা বাবুল আক্তারকে পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর এসপি নাঈমা সুলতানার রুমে নিয়ে যান। তখন ওই রুমে আগে থেকে উপস্থিত ছিলেন পিবিআই চট্টগ্রাম জেলার এসপি নাজমুল হাসান, পুলিশ পরিদর্শক একেএম মহিউদ্দিন সেলিম (বর্তমানে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার) ছাড়াও পিবিআইয়ের অন্তত ১৫ জন কর্মকর্তা। এর মধ্যে এসপি নাঈমা ও নাজমুল এবং পরিদর্শক মহিউদ্দিন সেলিম বাবুল আক্তারকে আগে থেকেই চিনতেন। এসপি নাজমুল এ সময় বাবুল আক্তারকে বলেন, ‘তোমাকে আমার অফিসে যেতে হবে।’ প্রতি উত্তরে বাবুল আক্তার জানতে চান, কেন ওই অফিসে যেতে হবে? তখন এসপি নাজমুল বলেন, ‘এতো কৈফিয়ত দেবার সময় নেই, বনজ স্যারের নির্দেশ।’

পাহাড়তলী থেকে খুলশী : ‘পরে বুঝবা’

এরপর এসপি নাজমুল ও নাঈমা সুলতানার নির্দেশে পরিদর্শক একেএম মহিউদ্দিন সেলিম ও সন্তোষ চাকমা জোর করে বাবুল আক্তারকে দোতলা থেকে নামিয়ে একটি মাইক্রোবাসে তোলেন। সেখানে বাবুল আক্তারকে মাঝখানে রেখে একপাশে এসপি নাজমুল ও অন্য পাশে সন্তোষ চাকমা বসেন।

পরে তারা পিবিআই চট্টগ্রাম জেলা অফিসে পৌঁছানোর পর বাবুল আক্তারকে নিয়ে যাওয়া হয় তৃতীয় বা চতুর্থ তলার একটি রুমে। বাবুল আক্তার এ সময় মোবাইল ফোনে তার মেজো ভাই সাহাবুল হকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে এসপি নাজমুল ফোনটি কেড়ে নেন। বাবুল তখন নাজমুলকে জিজ্ঞেস করেন, কেন তাকে এখানে আনা হয়েছে, কেন কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হচ্ছে না? প্রতিউত্তরে নাজমুল বলেন, ‘পরে বুঝবা।’ এ কথা বলার পর সবাই রুম ছেড়ে যান। তবে রুমের ভেতরে সাদা পোশাকের সশস্ত্র দুজন প্রহরীকে রেখে যান। এসপি নাজমুল এ সময় বলেন, ‘শালারে দেইখা রাখ।’

১০ মে থেকে ১২ মে দুপুর ১টা পর্যন্ত বাবুল আক্তারকে পিবিআই জেলা অফিস ভবনের ওই রুমেই আটকে রাখা হয়। তবে নির্দিষ্ট সময় পর পর সশস্ত্র প্রহরা পরিবর্তন করা হতো।

‘শালা, তুই আমার বিরুদ্ধে রিপোর্ট দিয়েছিলি’

১০ মে বিকেলের দিকে আসরের আজানের পর এসপি নাজমুল ও নাঈমা সুলতানা ওই রুমে আসেন। বাবুল আক্তারকে এ সময় নাজমুল বলেন, ‘বনজ স্যারের নির্দেশ, তোমাকে তোমার স্ত্রী হত্যামামলায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে হবে।’ বাবুল আক্তার তখন বলেন, ‘আমি কেন স্বীকারোক্তি দেবো, কিসের স্বীকারোক্তি দেবো, আমি তো কোনো অন্যায় করি নাই।’ নাজমুল তখন বলেন, ‘অন্যায় করো আর না করো, স্বীকারোক্তি তোমাকে দিতেই হবে। কিভাবে স্বীকারোক্তি আদায় করতে হয় আমরা জানি। বনজ স্যার চাইলে সব হয়।’ বাবুল আক্তার এ সময় বারবার তার দুটো শিশু সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে এসপি নাজমুল বলেন— ‘১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিলে সবার সাথে কথা বলতে পারবা।’

এরপর নাজমুল ও নাঈমা দুজনেই চলে যান। পরে রুমে ঢোকেন পুলিশ পরিদর্শক একেএম মহিউদ্দিন সেলিম ও কাজী এনায়েত কবির। পুলিশ পরিদর্শক এনায়েত কবির এ সময় বাবুল আক্তারকে উদ্দেশ্য করে গালাগাল করতে করতে বলেন, ‘শালা, তুই আমার বিরুদ্ধে রিপোর্ট দিয়েছিলি। এবার তোর মজা দেখাবো। কোন বাপ তোরে এবার বাঁচাতে পারবে না।’ মহিউদ্দিন সেলিম বলেন, ‘বনজ স্যার চাইলে বাঘে মহিষে একঘাটে পানি খায়। আপনি কোনোভাবে বাঁচতে পারবেন না। আপনাকে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিতেই হবে। ১৬৪ ধারার জবানবন্দি না দিলে আপনি আরও বড় বিপদে পড়বেন। আপনার পরিবারের অন্য সদস্যদের ডিস্টার্ব করা হবে।’ একথা শুনে বাবুল আক্তার কান্না করতে থাকেন আর তার পরিবারের সঙ্গে একটিবার কথা বলিয়ে দেওয়ার জন্য আকুতি জানাতে থাকেন।

শ্বশুরের বাসায় পিবিআইয়ের গাড়ি: ‘এখন নতুন মামলা হবে’

১০ মে মাগরিবের আজানের পর পরিদর্শক সন্তোষ চাকমা ওই রুমে ঢুকেই বাবুল আক্তারকে বলেন, ‘আপনার মামলা শেষ। আপনার বিরুদ্ধে এখন নতুন মামলা হবে। বনজ স্যার আপনার শ্বশুরের বাসায় পিবিআইয়ের গাড়ি পাঠিয়েছে। আপনার শ্বশুর আসলে তাকে দিয়ে আপনার বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা নেওয়া হবে।’ সন্তোষ চাকমা এ সময় বলেন, ‘আপনি যদি এখন বলেন ১৬৪ ধারার জবানবন্দি দেবেন, তাহলে আর রিমান্ডে নেওয়া হবে না। আপনি চাইলে বাচ্চাদের সাথে আপনাকে দেখা করানোর ব্যবস্থা করা হবে। মহিউদ্দিন সেলিম স্যারের বাগানবাড়িতে বাচ্চাদের সাথে দেখা করানোর ব্যবস্থা করা হবে— বনজ স্যার বলেছেন। আর ১৬৪ ধারার জবানবন্দি কিভাবে আদায় করতে হয়, আমাদের ভালোভাবে জানা আছে।’ এ কথা বলে সন্তোষ চাকমা চলে গেলেও কিছু সময় পরেই প্রথমে পরিদর্শক এনায়েত কবির, এরপর মহিউদ্দিন সেলিম আসেন। এর কিছু সময় পর প্রথমে এসপি নাঈমা এবং পরে এসপি নাজমুল এসে ভয় দেখাতে থাকেন— ১৬৪ ধারার জবানবন্দি না দিলে বাবুল আক্তারের বিপদ আছে। পরিবারেরও বিপদ আছে।

ওই দিন রাত ১১টার পর আর কেউ না আসলেও সাদা পোশাকে অস্ত্রধারী পিবিআই সদস্যরা সর্বক্ষণ ছিল। বাবুল আক্তার এ সময় একটু ঘুমিয়ে পড়লেই তাকে জাগিয়ে দিতো তারা।

এভাবে ১০ মে থেকে ১২ মে দুপুর ১টা পর্যন্ত ওই রুমে আটকে রেখে মানসিকভাবে নির্যাতন করা হতে থাকে। একইসঙ্গে ভয় ও প্রলোভনও দেখানো হয়।

‘এখন আপনি আসামি, কোর্টে চলেন’

১২ মে বেলা ১২টার দিকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সন্তোষ চাকমা রুমে ঢুকে বাবুল আক্তারকে বলেন, ‘আপনার দায়ের করা মামলা শেষ। এখন আপনি আসামি, কোর্টে চলেন। রিমান্ডে আসলে বুঝবেন। ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি আপনাকে দিতেই হবে।’ এরপর বাবুল আক্তারকে খুলশীর পিবিআই চট্টগ্রাম জেলা অফিস থেকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করার পর বেলা ২টার দিকে বাবুল আক্তারকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় পাহাড়তলীতে পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো অফিসে।

ওই অফিসের দোতলায় নিয়ে যাওয়ার পরই বাবুল আক্তারের চোখ বেঁধে ফেলা হয়। হ্যান্ডকাপ লাগানো ও চোখ বাঁধা অবস্থায় একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বাবুলকে বসিয়ে রাখা হয়। কিছু সময় পর পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর এসপি নাঈমা সুলতানা এসে বলেন, ‘আপনার ভাই আজ দুই দিন ধরে ঘুরছে আপনার সাথে দেখা করার জন্য। আপনি যদি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিতে রাজি হন, তাহলে আপনার ভাইয়ের সাথে দেখা করতে পারবেন এবং বাচ্চাদের সাথেও দেখা করানোর ব্যবস্থা করে দেবো।’ প্রতি উত্তরে বাবুল আক্তার বলেন, ‘আমি কোনো অন্যায় করি নাই, আমি কেন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেবো?’ তখন নাঈমা বলেন, ‘কিভাবে ১৬৪ ধারার জবানবন্দি আদায় করতে হয় তা পিবিআই জানে।’

ঢাকা থেকে মনিটরিং সিসিটিভি ক্যামেরায়

এরপর থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করতে সারাক্ষণ হ্যান্ডকাপ পরিয়ে ও চোখ বেঁধে নিষ্ঠুর, অমানবিক ও লাঞ্ছনাকর আচরণ করা হয় বাবুল আক্তারের সঙ্গে। এজন্য ২-৩ জন অফিসারের সঙ্গে অনেকগুলো টিম গঠন করা হয়। মামলা তদন্তভার পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর অধীনে হলেও এসব টিমে অফিসার রাখা হয় পিবিআই চট্টগ্রাম জেলা থেকেও। এসব টিমের কাজ ছিল জিজ্ঞাসাবাদের নামে মানসিক যন্ত্রণা দেওয়া এবং দিনরাত ২৪ ঘন্টা জাগিয়ে রাখা। কয়েক ঘন্টা পর পর বাবুলকে এক রুম থেকে আরেক রুমে নেওয়া হতো। চোখ বাঁধা থাকলেও জিজ্ঞাসাবাদকারী অফিসারদের কথোপকথন থেকে বাবুল আক্তার জানতে পারেন, তাকে কেমন মাত্রায় নির্যাতন করা হচ্ছে— সেটা ঢাকায় বসে সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে মনিটরিং করেছেন পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার। এ কারণে জিজ্ঞাসাবাদকারী অফিসাররাও মাঝে মাঝে দুঃখ প্রকাশ করতেন।

রিমান্ডে থাকাকালে তদন্ত কর্মকর্তাসহ অন্যান্যরা জিজ্ঞাসাবাদের নামে বাবুল আক্তারকে গালিগালাজ ও অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করতেন। বারবার তারা জিজ্ঞাসা করতেন— ‘তোর বাপের নাম কী?’ বারবার একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করায় বাবুল আক্তার জবাব না দিলে কেউ একজন তার মাথার বাম পাশে ধাক্কা দেয়, সাথে সাথে আরেকজন ডান পাশ থেকে ধাক্কা দেয়। এভাবে চলতে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। কেউ একজন হঠাৎ হঠাৎ বাবুল আক্তারের বসে থাকা প্লাস্টিকের চেয়ারের পেছনে লাথি মারে এবং বলে— ‘শালার সাহস কত? ১৬৪ ধারার জবানবন্দি দেবে না?’

শুধুমাত্র খাবার সময় চোখ খুলে দেওয়া হতো বাবুল আক্তারের। যে বা যারা চোখ খুলতো, তারা তার পেছনে দাঁড়িয়ে বলতেন— ‘পেছনে তাকাবি না, তাড়াতাড়ি খেয়ে নে।’ খাওয়া শেষ হবার সাথে সাথে চোখ বেঁধে আবার হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে দেওয়া হতো। ওজু করার জন্য পানি চাইলে বলতো, ‘তায়াম্মুম করে নামাজ পড়।’ বাথরুমে যাবার প্রয়োজন হলে প্যানের ওপর দাঁড় করিয়ে তারপর হ্যান্ডক্যাপ খুলতো, কিন্তু চোখ বাঁধা থাকতো। কেউ একজন বলতেন— ‘বাম পাশে বদনা আছে।’ পানি ব্যবহার করার পর সাবান দিয়ে হাত ধুতেও দিত না।

‘চাইলে লোহাও ১৬৪ ধারার জবানবন্দি করে’

রিমান্ডে নেওয়ার পরদিন সন্ধ্যার দিকে পিবিআই চট্টগ্রামের দুই এসপি নাঈমা সুলতানা ও নাজমুল হাসান, পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা, মহিউদ্দিন সেলিম ও এনায়েত কবির আসেন। তারা বাবুল আক্তারের পূর্ব পরিচিত হওয়ায় তাদের কণ্ঠ বুঝতে পারতেন তিনি। ওইদিন একপর্যায়ে বাবুলের বসা প্লাস্টিকের চেয়ারের পেছনে লাথি মেরে এসপি নাঈমা সুলতানা বলেন, ‘শালা হিজড়ার বাচ্চা, এখনও ১৬৪ ধারার জবানবন্দি দিতে রাজি হচ্ছে না?’ এসপি নাজমুল তখন বলেন, ‘সন্তোষ, শালারে লটকাইয়া ফেলেন তো।’ পরিদর্শক এনায়েত কবির বলেন, ‘স্যার চিন্তা করবেন না, শালাকে ১৬৪ ধারার জবানবন্দি দিতেই হবে, আমরা ব্যবস্থা করছি।’ অপর পরিদর্শক মহিউদ্দিন সেলিম বলেন, ‘স্যার আপনারা যান, আমরা জানি কিভাবে ১৬৪ ধারার জবানবন্দি করাতে হয়। আমরা চাইলে লোহাও ১৬৪ ধারার জবানবন্দি করে।’ এরপর এসপি নাজমুল ও নাঈমা চলে গেলে সন্তোষ, এনায়েত ও মহিউদ্দিন সেলিম ক্রমাগত বাবুলের আক্তারের সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে থাকে এবং বলতে থাকেন— ‘দে, না দেওয়া পর্যন্ত এরকম চলতে থাকবে। পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষ হলে আবার রিমান্ডে আনা হবে।’

দিনের পর দিন বাবুল আক্তারকে চেয়ারেই বসিয়ে রাখা হয়। একটু ঘুমানোর সুযোগ দেওয়ার জন্য বারবার কাকুতি জানালেও কাজ হয়নি। পরে কয়েকজন অফিসার বাবুল আক্তারকে অন্য রুমে নিয়ে গিয়ে ফ্লোরে ঘুমানোর ব্যবস্থা করেন। কিন্তু অল্পক্ষণ পরই কেউ একজন এসে চিৎকার করতে থাকে— ‘কেন একে শুতে দেওয়া হয়েছে?’ ঘুমানোর ব্যবস্থা করেছিলেন যেসব অফিসার, তাদেরও এ সময় গালাগাল করা হয়। এরপর জিজ্ঞাসাবাদের নামে শুরু হয় আবার নির্যাতন। জিজ্ঞাসাবাদকারী অফিসারদের কথোপকথনে বাবুল আক্তার শুনতে পান— ‘বনজ স্যার নির্দেশ দিয়েছেন— শরীরে আঘাতে চিহ্ন হয় এসব নির্যাতন ছাড়া সব করা যাবে।’

‘স্যারের নির্দেশ শরীরে দাগ পড়ে এমন নির্যাতন ছাড়া সব করা যাবে’

১৪ মে ছিল ঈদুল ফিতরের দিন। সেদিনও সারাক্ষণ চোখ বেঁধে, হ্যান্ডকাপ পরিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নিষ্ঠুর আচরণ ও গালিগালাজ চলতে থাকে। যে চেয়ারে বাবুলকে বসিয়ে রাখা হয়েছিল তার পেছনে হঠাৎ হঠাৎ লাথি দেওয়া, আচমকা মাথার পেছন থেকে, কখনওবা বাম থেকে, কখনওবা মাথার ডান কিংবা কখনও মাথার সামনে থেকে ধাক্কা দেওয়া হয়। এছাড়া অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক একই কথা বারবার জিজ্ঞাসা করে মানসিক ও শারীরিক কষ্ট দেওয়া হতে থাকে।

অনবরত এ ধরনের নির্যাতনে বাবুল আক্তার দুর্বল হয়ে একবার প্লাষ্টিকের চেয়ার থেকে নিচে পড়ে যান। তখন তাকে একটা হাতলওয়ালা চেয়ারে বসানো হয় এবং চোখ বাঁধা অবস্থায় হাতলওয়ালা চেয়ারের দুই হাতলের সাথে তার দুই হাতে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে দেওয়া হয়। এর কিছু সময় পর বাবুল টের পান, কেউ একজন তার নাড়ি পরীক্ষা ও প্রেসার মাপছেন। চোখ বাঁধা অবস্থায় উপস্থিত পিবিআই সদস্যদের তিনি বলতে শোনেন, পুলিশ হাসপাতাল থেকে মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট আনা হয়েছে পরীক্ষা করার জন্য— বাবুল আক্তার নির্যাতন সহ্য করার মতো ফিট আছেন কি না? এ সময় আরও বলতে শোনেন— ‘বনজ স্যারের নির্দেশ— শরীরে দাগ পড়ে এমন নির্যাতন ছাড়া সব নির্যাতন করা যাবে।”

১৫ মে জিজ্ঞাসাবাদকারী অফিসারদের একজন বাবুল আক্তারকে জানান, ‘আপনাকে যে অফিসাররা শুতে দিয়েছিল, সেই অফিসারদের শাস্তি হিসেবে চট্টগ্রাম থেকে দক্ষিণাঞ্চলের দূরবর্তী এক জেলায় বদলি করা হয়েছে।’

ঘুমের বিনিময়ে জবানবন্দি

এমন পরিস্থিতির একপর্যায়ে ১৫ মে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে রাজি হন বাবুল আক্তার। তখন জিজ্ঞাসাবাদরত অফিসাররা কিছু সময়ের জন্য কথা বলা বন্ধ রাখেন। চোখ বাঁধা থাকায় বাবুল আক্তার বুঝতে পারেননি। তবে তার ধারণা, ওই ব্যক্তিরা রুমের বাইরে গিয়ে কারও সাথে ফোনে কথা বলছিল। কিছু সময় পর তারা বলে, স্যারেরা আসলে সিদ্ধান্ত হবে। এর বেশ কিছুক্ষণ পর পরিদর্শক মহিউদ্দিন সেলিম ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সন্তোষ কুমার চাকমা আসেন। বাবুল আক্তার তাদেরকে বলেন, ‘১৬৪ ধারার জবানবন্দি দেবো, কিন্তু আমাকে একটু ঘুমাতে দিন। একটু ঘুমাব, ঘুম থেকে উঠলে কথা বলবো।’

ওইদিন মধ্যরাতে চোখ বাঁধা ও হ্যান্ডকাপ পরা অবস্থায় ফ্লোরে শুয়ে থাকা বাবুল আক্তারকে ডেকে তুলে খাবার খেতে দেওয়া হয়। এ সময় তার হ্যান্ডকাপ ও চোখের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়।

হঠাৎ টার্গেট দুজন সাবেক পুলিশ অফিসার

১৬ মে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে কী বলতে হবে, তা একটি কাগজে লিখে পড়ে শোনানো হয় বাবুল আক্তারকে। ওই সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন মহিউদ্দিন সেলিম। এ পর্যায়ে সন্তোষ চাকমা একটি ছোট ভিডিও ক্যামেরা বের করে বাবুল আক্তারকে বলেন, এখন বলবেন আর এই ক্যামেরায় রেকর্ড হবে। তখন বাবুল আক্তার বলেন, ভিডিও রেকর্ড করলে তিনি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেবেন না। তখন সন্তোষ বলেন, ‘বনজ স্যারের ডিজায়ার (ইচ্ছা)— রেকর্ড করতে হবে।’ কিন্তু তাতেও বাবুল রাজি না হলে আবার তার চোখে বেঁধে হাতে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে দেওয়া হয়। মহিউদ্দিন সেলিম এ সময় বলেন, ‘ক্যামেরার সামনে না বললে আবার রিমান্ডে নিয়ে আসা হবে। ১৬৪ ধারার জবানবন্দি যেহেতু দিতেই হবে, ক্যামেরার সামনে দিলে ক্ষতি কী? রাজি হয়ে যান, নইলে আরও কষ্ট পাবেন।’ সন্তোষ চাকমাও এ সময় বলেন— ‘আবার রিমান্ডে আনতে হবে।’

সন্ধ্যার দিকে মহিউদ্দিন সেলিম ও সন্তোষ আবার আসেন। তারা বলেন, ঠিক আছে ভিডিও করবো না, তবে ১৬৪ ধারার জবানবন্দি দিতে হবে। সেই রাতে বাবুলকে ঘুমাতে দেওয়া হয়। তবে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী দুজন সাবেক সিনিয়র পুলিশ অফিসারের নাম জড়িয়ে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিতে বলেন।

খয়েরি প্রাইভেট কারে পেছন দরজায় আদালতে

১৭ মে সকাল ১০টার দিকে (মিতু হত্যামামলায়) স্বীকারোক্তি দেওয়ার জন্য বাবুলকে নিয়ে পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো অফিস থেকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। এজন্য ব্যবহার করা হয় খয়েরি রঙের একটি প্রাইভেট কার। ওই কারে মহিউদ্দিন সেলিম ছাড়াও সাদা পোশাকে দুই জন পিবিআই সদস্য ছিলেন। আদালতের পেছন দিক দিয়ে বাবুলকে নেওয়া হয় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। পথে যেতে যেতে মহিউদ্দিন সেলিম বলতে থাকেন— ‘১৬৪ ধারার জবানবন্দি না দিলে আপনার অবস্থা কী হবে আল্লাহ জানে। আবার রিমান্ডে নিয়ে আসা হবে। আপনার বাচ্চাদের মুখ হয়তো আর দেখতে পাবেন না।’ কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট আসার পর বাবুল আক্তার তাকে বলেন, ‘ঘটনার বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’ এরপর বাবুলকে জেলহাজতে পাঠান ম্যাজিস্ট্রেট।

যেসব আইনে অভিযোগ

অভিযোগে বলা হয়, পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদারের নির্দেশ ও প্ররোচনায় অন্য আসামিরা ‘সরকারি কর্মকর্তা’ হয়েও সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অমান্য করেছেন এবং ‘নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারন) আইন, ২০১৩’ এর ১৫(১) ধারায় অপরাধ করেছেন। বাবুল আক্তারকে ১০ মে থেকে ১২ মে পর্যন্ত আটকে রেখে ১২ মে গ্রেপ্তার দেখানো হলেও কোন মেমোরেন্ডামে স্বাক্ষর নেওয়া হয়নি।

অভিযোগ তোলা হয়েছে, পিবিআই হেডকোয়ার্টারের নির্দেশে পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো ও পিবিআই চট্টগ্রাম জেলার অফিসারদের সমন্বয়ে ২৪ ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদের নামে মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে বাবুল আক্তারকে। এর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের নির্দেশনা অমান্য করা হয়েছে।

এতে বলা হয়, পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদারের নির্দেশে বাবুল আক্তারকে ২ দিন আটকে রেখে এবং ৫ দিন রিমান্ডে নিয়ে অমানবিক, নিষ্ঠুর ও লাঞ্ছনাকর ব্যবহার করা হয়।

অভিযোগে আরও বলা হয়, ৫৩ ঘন্টা পিবিআইয়ের চট্টগ্রাম অফিসে আটকে রেখে সাদা কাগজ ছাড়াও বিভিন্ন বইয়ের পাতায় বাংলা ও ইংরেজিতে নাজমুল ও নাঈমার বলা বিভিন্ন কথা বাবুল আক্তারকে দিয়ে লিখে নিতে বাধ্যও করেন তদন্ত কর্মকর্তা সন্তোষ কুমার চাকমা।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!