চট্টগ্রামে ৪০০ টাকার ‘বড় ডাক্তার’ আলো জ্বালছেন মমতা দিয়ে

‘৩০০ বা ৪০০ টাকা—ফিস যাই হোক, এটি নেওয়ার পেছনে সারাজীবন আমার নিজস্ব মতধারা কাজ করেছে। আমার মা সবসময় বলতেন, বেশি ফিস নেবে না। পরে আমার স্ত্রী-সন্তানরাও একই কথা বলে এসেছেন আমাকে। আমি তো কখনও চাপে পড়িনি। ভালোভাবেই তো জীবন কাটছে। মানুষের আশীর্বাদ আমার জন্য রয়েছে। সেটা নিয়েই আমি আমার জীবন পার করে দিতে চাই।’

মঙ্গলবার (২ আগস্ট) সকালে চট্টগ্রাম প্রতিদিনের মুখোমুখি হয়ে কথাগুলো বলছিলেন অধ্যাপক ডা. প্রদীপ কুমার দত্ত। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল থেকে দীর্ঘ চিকিৎসাজীবন শেষে গেছেন অবসরে। ছিলেন নেফ্রোলজি (কিডনি) বিভাগের প্রধান। এখন মেরিন সিটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান।

এ যুগে যখন প্রায়ই শোনা যায় রোগীদের কাছ থেকে গলাকাটা ফি নেওয়ার অভিযোগ সেখানে স্রোতের বিপরীতে চলা ডা. প্রদীপ দত্ত রোগীদের কাছ থেকে ফি নেন ৪০০ টাকা। আগে সেটা ছিল ৩০০ টাকা। করোনার সময় ১০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে।

সপ্তাহে চারদিন তিনি রোগী দেখেন লাইফ কেয়ারে। মেরিন সিটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে রোগী দেখেন বৃহস্পতিবার।

মেরিন সিটিতে যোগ দিয়ে তিনি নেফ্রোলজি বিভাগ চালু করেন। এখানে ১৮টি বেড করা হয়েছে, আগে ছিল ১৪টি। প্রতিদিন আটজনকে ডায়ালাইসিস করা হয়ে এখানে।

কর্মজীবন, ব্যক্তিজীবন এবং পারিবারিক জীবন নিয়ে খোলামেলা আলাপ করেছেন এ চিকিৎসক।

১৯৬০ সালে চট্টগ্রাম নগরীর দেওয়ানজী পুকুরপাড় এলাকায় জন্ম ডা. প্রদীপ দত্তের। বাবা প্রয়াত রবীন্দ্রলাল দত্ত ও মা কিরণবালা দত্ত। সাত বোন ও দুই ভাই তারা। বড় বোন ও ছোট ভাই ডাক্তার। ছোট ভাই অনুপ দত্ত বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ।

চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে তিনি ১৯৭৫ সালে মেট্রিক পাস করেন। সেবার কুমিল্লা বোর্ড থেকে মেধাতালিকায় তৃতীয় হন তিনি।

মা কিরণবালা দত্ত ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। কিন্তু বাবা ছিলেন স্বদেশি আন্দোলনের সক্রিয় নেতা। এজন্য স্বদেশি আন্দোলন করতে গিয়ে টানা আট বছর জেল খেটেছেন। জেলে বসেই তার বাবা বিএ পাস করেছেন। সেসুবাদে ছোটবেলা থেকেই রাজনীতির আবহে বেড়ে ওঠা প্রদীপ দত্তের।

এরপর ১৯৭৭ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসিতে ‘থার্ড স্ট্যান্ড’ করেন।

ডা. প্রদীপ দত্ত বলেন, ‘বড় বোন ডাক্তার হওয়ায় মা চাইতেন, আমিও যেন ডাক্তার হই। ঢাকা মেডিকেলেও তিনি ভর্তি হয়েছিলাম। তখন মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা হতো কলেজভিত্তিক। তাই চট্টগ্রাম মেডিকেলে পরীক্ষা দিয়ে মেধাতালিকায় প্রথম হই। এরমধ্যে আবার বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায়ও থার্ড হই। তখন বড় বোন পড়তেন চট্টগ্রাম মেডিকেলে। বড় বোনের কথামত আমি চট্টগ্রাম মেডিকেলে ভর্তি হই।’

এমবিবিএস পড়ার সময় প্রতিটি বর্ষে তিনি ভালো ফলাফল করেন। পাস করে বের হন ১৯৮৩ সালে। এরপর এক বছরের ইন কোর্স ট্রেনিং শেষ করেন তিনি। ট্রেনিং শেষে পরের বছর বিসিএস দিয়ে টিকে যান।

১৯৮৫ সালে তার পোস্টিং হয় উখিয়ায়। এ সময় তিনি প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেননি। দু’বছর তিনি শুধু রোগীদের সেবা দিয়ে গেছেন।

এ প্রসঙ্গে ডা. প্রদীপ দত্ত বলেন, ‘তখন মানুষ কম ছিল। পরিবেশ ছিল অনুকূলে। ডাক্তারের কথা, আদেশকে রোগী সম্মান করত।’

এরপর তিনি এফসিপিএস করতে যান ঢাকার পিজিতে। সে সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘তখন এফসিপিএস কোর্সে পরীক্ষা দিয়ে টিকতে হতো। ১৯৮৬-৮৭ সালে এফসিপিএস পার্ট-১ শেষ হলো। এরপর ৩ বছরের ট্রেনিং পড়ে যায়। ১৯৯১ সালের জুলাইয়ে শেষ করি এফসিপিএস পার্ট-২। এফসিপিএস (মেডিসিন) শেষ করে চট্টগ্রাম মেডিকেলের নেফ্রোলজি বিভাগে রেজিস্ট্রার হিসেবে যোগ দিই।’

এরপর ১৯৯৮ সালে পিজি থেকে নেফ্রোলজিতে এমডি করে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে তিনি থিতু হন চট্টগ্রাম মেডিকেলে।

এরমাঝে দু’বছর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পোস্টিং নিয়ে চলে যান ডা. প্রদীপ দত্ত। পরে আবার ফিরে আসেন চট্টগ্রাম মেডিকেলে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন সহকারী অধ্যাপক। ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে অবসরে যান তিনি।

ময়মনসিংহ মেডিকেলে থাকাকালীন সেখানে নেফ্রোলজি বিভাগ প্রতিষ্ঠায় বড় ভূমিকা রাখেন ডা. প্রদীপ দত্ত।

চিকিৎসা জীবনে সন্তুষ্টি নিয়ে তিনি বলেন, ‘রিসার্চে জড়িত ছিলাম। সিনসিয়ারলি রোগী দেখেছি। রিসার্চ করেছি। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের গবেষণাপত্রের ৭০ শতাংশ আমার করা।’

পরিবার নিয়ে এ কিডনি বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আমার স্ত্রী সুপ্তি দত্ত গৃহিণী। আমাদের দুই মেয়ে। দু’জনই ডাক্তার।’

স্ত্রীর অবদান সম্পর্কে এ চিকিৎসক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার স্ত্রী সুপ্তি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমেস্ট্রিতে মাস্টার্স করেছে। কিন্তু সংসারে মন দিতে গিয়ে ক্যারিয়ারের দিকে তাকায়নি। দুই মেয়েকে সুপ্তি নিজে পড়িয়েছে। বাচ্চাদের কোনো টিউটর ছিল না।’

তিনি আরও বলেন, ‘এফসিপিএস পার্ট-১ শেষ করার পর আমি বিয়ে করি। ১ হাজার টাকা ৮০০ টাকা যেটা সম্মানী পেতাম তা দিয়ে সংসার চলত। এমনও দিন গেছে, সারা সপ্তাহ তরকারিতে শুধু ছোট চিংড়ি দিয়ে রান্না করে খেয়েছি আমরা। বড় মাছ, মাংস পাতে পড়েনি। আমার স্ত্রীর তেমন কোনো চাহিদা ছিল না। আমি টাকা জমালেই বই কিনতাম। আমার স্ত্রীর একটাই চাওয়া ছিল, আমি যেন বড় ডাক্তার হই। আমার রিসার্চের অনেক কাজে সে হেল্প করেছে। সবসময় রোগীদের কাছ থেকে বেশি ফি না নিতে বলেছে সে।’

বর্তমানে কিডনি রোগ ও রোগীদের অবস্থা নিয়ে তিনি বলেন, ‘কিডনি প্রায় ৯০ ভাগ নষ্ট হলে রোগী ডাক্তারের কাছে আসেন। সংক্রমণ, ডায়াবেটিকস, প্রেসার থেকেই কিডনি রোগের শুরু। তাই বছরের সবার একবার প্রস্রাব ও প্রেসার পরীক্ষা করা উচিত। সব মিলিয়ে এ পরীক্ষায় দুই থেকে আড়াইশ টাকা খরচ হয়। কিন্তু আমরা সেটাই করতে চাই না।’

তিনি বলেন, ‘আমি চাই আমার কাছে রেফারেল রোগীরা আসুক। কারণ আমি ২০টির বেশি রোগী দেখতে পারব না। আমার শারীরিক সেই সামর্থ্য নেই। কারণ এর বেশি হলে রোগীদের পর্যাপ্ত সময় দিতে পারবো না।’

অবসরে কী করেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অবসর সময় কাটে পড়াশোনা করে। বড় মেয়ের ঘরের নাতনি লাবণ্য সরকার পালকির সঙ্গে সময় কাটাই। বয়স তার তিন বছর। বাসায় যতক্ষণ থাকি, ততক্ষণ আমার সঙ্গে তার সময় কাটানো চায়। হাজারো প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় আমাকে। ভালোই সময় কাটে আমার। বাকি জীবন রোগী দেখে, পড়াশুনা করে, রিসার্চ করে, স্টুডেন্ট পড়িয়ে কাটাতে চাই। কাজেই আমার শান্তি।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান নূরুল হক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘নেফ্রোলজি বিভাগকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে সেবামুখি করতে ডা. প্রদীপ কুমার দত্তের অবদান ছিল মনে রাখার মতো। এমডি যারা করছে, তাদের বড় হেল্পিং সোর্স তার রিসার্চ পেপার। আর তার কম ফিস নেওয়া এ যুগে বিরল।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!