চট্টগ্রামে ‘রাস্তার ছেলে’রা করোনার টিকা পায় না জন্মনিবন্ধনের অভাবে

বেশিরভাগই জানে না বাবা-মা কোথায়

চট্টগ্রামে জন্মনিবন্ধনের সুযোগ পায় না সুবিধাবঞ্চিত ছিন্নমূল শিশুরা— যাদের বসবাস বস্তি কিংবা পথের ধারে। এর ফলে তাদের কেউই পাচ্ছে না করোনার টিকা। কারণ জন্মনিবন্ধন না থাকলে টিকার রেজিস্ট্রেশন করানোর সুযোগ নেই কারও। সরকার ইতিমধ্যে সকল নাগরিককে টিকা নিতে উৎসাহ দিলেও সুযোগ রাখা হয়নি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য। ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিনেশনের আওতায় আনা গেলেও এই বয়সী সুবিধাবঞ্চিত শিশু যাদের জন্মনিবন্ধনই হয়নি তারা পড়েছে বিপাকে। জন্মনিবন্ধন ছাড়া তাদের টিকা পাওয়ার বিষয়ে কোনো আশার বাণীও এখন পর্যন্ত নেই।

কালাম বলে, ‘বাবা মারা না গেলে হয়তো আজকে আমার জন্মনিবন্ধন থাকতো। আমি স্কুলে ভর্তি হতে পারতাম।’
কালাম বলে, ‘বাবা মারা না গেলে হয়তো আজকে আমার জন্মনিবন্ধন থাকতো। আমি স্কুলে ভর্তি হতে পারতাম।’

তুহিন, হাসান, সাহেদ, নবাব ও জসিম— ওরা সবাই সুবিধাবঞ্চিত পথশিশু হলেও খেলার মাঠের সাথী। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত রাস্তাঘাট কিংবা ফুটপাতে কাটে তাদের সময়। কেউ থাকে চট্টগ্রাম নগরীর মতিঝর্না, কেউ সিআরবি, কেউবা আবার কাজীর দেউড়ি, গোয়ালপাড়া ও ঝাউতলা বস্তিতে। তাদের কারও মা আছে, বাবা নেই। কারও আবার মা-বাবা কেউই নেই। কারও কারও বাবা-মায়ের একাধিক বিয়ে— যোগাযোগই নেই সন্তানের সঙ্গে।

সরকারি নির্দেশে ১৫ জানুয়ারির মধ্যে করোনা থেকে সুরক্ষা পেতে ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিনেশনের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর গত ১২ জানুয়ারি থেকে চট্টগ্রামের এমএ আজিজ স্টেডিয়াম ও রীমা কমিউনিটি সেন্টারে টিকা নিতে আসা হাজারও শিক্ষার্থী ভিড় জমায়। একই বয়সীরা টিকা পাচ্ছে— এই ভেবে স্কুল শিক্ষার্থীদের সাথে দীর্ঘক্ষণ ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুরাও। কিন্তু শেষপর্যন্ত তারা জেনে যায় যে, তাদের জন্মনিবন্ধন নেই, তাই তারা টিকা পাবে না। নিরাশ মনে আবার তারা সিআরবি কিংবা ফুটপাতে ফিরে যায়।

আইন অনুযায়ী শিশুর জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্মনিবন্ধন বাধ্যতামূলক। সবার জন্মনিবন্ধন বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। কিন্তু এখনও দেশের সুবিধাবঞ্চিত বড় একটি জনগোষ্ঠী রয়েছে জন্মনিবন্ধনের বাইরে। নানা জটিলতার কারণে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্মসনদ নিয়ে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে।

দেখা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন এনজিওর পাশাপাশি ব্যক্তিগত ও সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে প্রাথমিকভাবে পথশিশুদের অক্ষরজ্ঞান শিক্ষা দিলেও জন্মনিবন্ধন না থাকায় এসব শিশু বেশিদূর এগোতে পারে না। তাদের পিতা-মাতার পরিচয়পত্রসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় জন্মনিবন্ধন করাতে গেলে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয় বলে জানান একাধিক সংগঠনের উদ্যোক্তারা। পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে— চট্টগ্রাম নগরীতে সক্রিয় এমন বেসরকারি সংগঠন বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন, ব্র্যাক, চারুলতা, উপলব্ধি, নগরফুল, পথফুল, আলোর ঠিকানার সংগঠকদের সঙ্গে আলাপ করে এ তথ্য জানা গেছে।

সিআরবি এলাকার ফুটপাতে দেখা মিলল তুহিন নামের এক ১২ বছর বয়সী শিশুর সঙ্গে। বাবা-মা তার কেউই নেই। জন্মনিবন্ধন হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তুহিন উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়লো— ‘এইডা আবার কী? জন্মনিবন্ধন দিইয়া কী হইবো? আমগো জন্মনিবন্ধন কেডা করবো? আমগো ঘর-দুয়ার, বাবা-মা কিছুই তো নাই। দুই বেলা ঠিক মতন খাওন জোটে না। কাগো এত সময় আছে আমাগোরে লইয়া চিন্তা করার।’

নগরীর বন্দর থানাধীন আনন্দবাজার ময়লার ডিপো এলাকায় বসবাসরত ফরিদা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলের বয়স ১৩ বছর। ওর জন্মনিবন্ধন আছে। সে বোতল কুড়ায়, স্কুলে যায় না, লেখাপড়া করে না। তাহলে কি আমার ছেলে টিকা পাবে না?’

জঙ্গল সলিমপুর ছিন্নমূলে বসবাসরত ১৫ বছরের কিশোর কালাম বলে, ‘ঘূর্ণিঝড়ের (সিডর) সময় আমি ছোট ছিলাম। বাবা মারা গেছে তখন। মা আমাদের তিন ভাইবোনকে নিয়ে শহরে চলে আসে। এখন গার্মেন্টসে কাজ করে। আমি রিকশা চালাই। সারাদিন রিকশা চালানোয় জন্মনিবন্ধন করার সময় পাই না। শুনছি জন্মনিবন্ধন করতে অনেক খরচ লাগে, মাসের পর মাস সময় লাগে।’

কালাম বলে, ‘বাবা মারা না গেলে হয়তো আজকে আমার জন্মনিবন্ধন থাকতো। আমি স্কুলে ভর্তি হতে পারতাম। যাদের মা-বাবা আছে তারা স্কুলে লেখাপড়া করে। করোনাভাইরাস খুব খারাপ রোগ। মানুষ মরে যায়। টিকা দেয়ার দরকার ছিল। কিন্তু কী করবো এখন?’

ওদের মত হাজারও পথশিশু রয়েছে চট্টগ্রাম শহরের নগর ও উপজেলার বাসস্টেশন, রেলস্টেশন, টার্মিনাল, অফিস চত্বর, পার্ক, ফুটপাতে। বর্তমান সময়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভাসমান সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে। জন্মনিবন্ধন না থাকায় বিভিন্ন ধরনের সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এসব পথশিশু। জন্মনিবন্ধন না থাকায় ওরা একদিকে যেমন প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, অন্যদিকে করোনা ভাইরাসে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকা এই পথশিশুদের টিকার আওতায়ও আনা যাচ্ছে না।

নগরীর গুরুত্বপূর্ণ ইপিজেড এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ইপিজেড এলাকায় রয়েছে গার্মেন্টস শিল্প সিইপিজেড, কেইপিজেড, নৌবাহিনী, বেপজা কলেজসহ গুরুত্বপূর্ণ সব স্থাপনা। এই ওয়ার্ডের জনসংখ্যা বেশি হবার কারণে করোনা মোকাবেলায় আমাদেরকে সবসময় সচেতন থাকতে হয়। আপাতত শিক্ষার্থীরা টিকা পেলেও সরকারি সহযোগিতায় তৃণমূল পর্যায়ে অন্য শিশুদের টিকার আওতায় আনা হবে।’

বেসরকারি এনজিও সোসাইটি ফর সোশ্যাল এডভান্সমেন্ট অব রুরাল পিপলের (সার্প) নির্বাহী পরিচালক আবুল হোসেন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত ১২ হাজার ৫০০ শিশুকে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণের জন্য সরকার ২০টি এনজিও নিযুক্ত করেছে। প্রত্যেক এনজিও পৃথকভাবে ৩৬টি শিক্ষাকেন্দ্রের মাধ্যমে সমানসংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ করে তাদেরকে ৬ মাস পাঠদান করবে। এরপর তাদের মধ্য থেকে বাছাই করে ২০ জন করে ৪৫টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে বিভিন্ন দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

তিনি জানান, বেসরকারি এনজিও সার্প বন্দর-পতেঙ্গা এলাকায় ৩৬টি, সোশ্যাল এডভান্সমেন্ট এন্ড ভিলেজ ইকনোমি (সেভ) ৩৬টি এবং লক্ষ্মী সোসাইটি সাতটি শিক্ষাকেন্দ্র তত্ত্বাবধান করবে। আরও ২৯টি শিক্ষাকেন্দ্র হবে কক্সবাজার জেলায়।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াস চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, নিবন্ধনের মাধ্যমে প্রথম ধাপে ১২ থেকে ১৭ বছরের শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় আনা হয়েছে। তবে সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুরাও পর্যায়ক্রমে টিকার আওতায় আসবে। বিশেষ করে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বা জন্ম নিবন্ধন সনদ না থাকাসহ বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে টিকার জন্য অনলাইনে যাদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ নেই এবং যারা রেজিস্ট্রেশন করতে পারেননি এ ধরনের জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনতে কার্যক্রম চলছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউশন অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) ও ইউনিসেফের ২০০৫ সালে পরিচালিত জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট ৯ লাখ ৭৯ হাজার ৭২৮ জন পথশিশু রয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে রয়েছে ৫৫ হাজার ৮৫৬ জন।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!